সর্বকালে অন্যতম জনপ্রিয় ফন্ট টাইমস নিউ রোমান
সর্বকালে অন্যতম জনপ্রিয় ফন্ট টাইমস নিউ রোমান

ফন্ট নিয়ে নানা গল্প

কম্পিউটারে নানা কাজে অনেক ধরনের অক্ষর বা ফন্ট ব্যবহার করি। কম্পিউটার আসার আগে টাইপরাইটারের জন্য বেশ কিছু ধাতব ফন্ট চালু ছিল। তার আগে মুদ্রণশিল্পের জন্য বেশ কিছু ফন্ট চালু হয়। ডিজিটাল দুনিয়া বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে নানা প্রয়োজনে নানা ফন্টের প্রচলন ঘটে। এসব ফন্ট আবার কাজের বিচারে কোনোটা জনপ্রিয় আবার কোনোটা অপ্রিয়।

কোনো কোনো ফন্টের নামে তো রীতিমতো আন্দোলন হয়, আবার কোনো কোনো ফন্টকে বিশ্বসেরা নকশার পুরস্কারও দেওয়া হয়। ফন্টের ইতিহাস পড়ার আগে ‘সেরিফ’ শব্দটি সম্পর্কে জেনে নিন। টাইপোগ্রাফি দুনিয়ায় সেরিফ একটি ছোট লাইন বা স্ট্রোককে বোঝায়, যা নির্দিষ্ট হরফ বা ফন্টের পরিবারের মধ্যে অক্ষর বা প্রতীকের শেষে যুক্ত থাকে। একটি টাইপফেস বা ফন্ট যে সেরিফ ব্যবহার করে, তাকে সেরিফ (বা সেরিফড) টাইপফেস বলা হয়। এটা অনেকটা বাংলা ভাষার বর্ণে মাত্রা দেওয়ার মতো। এ-কার দেওয়ার আগে আমরা যে বিন্দু থেকে লেখা শুরু করি, তাকে সেরিফ বলা হয়। এবার কয়েকটি আলোচিত লাতিন হরফের ফন্টের গল্প জানা যাক।

পত্রিকা থেকে ডিজিটাল দুনিয়ায় আসে টাইমস নিউ রোমান

টাইমস নিউ রোমান একটি সেরিফ টাইপফেস। ১৯৩১ সালে ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য টাইমস এই ফন্ট চালু করে। পত্রিকার বিজ্ঞাপন বিভাগের অক্ষরশিল্পী ভিক্টর লার্ডেন্টের সহযোগিতায় মুদ্রণ সরঞ্জাম নির্মাতা কোম্পানি মনোটাইপের উপদেষ্টা স্ট্যানলি মরিসন এই ফন্টের ধারণা দেন। সর্বকালের অন্যতম জনপ্রিয় টাইপফেস হিসেবে আলোচিত এই ফন্ট। বেশির ভাগ পারসোনাল কম্পিউটারে (পিসি) এই ফন্ট ইনস্টল করা হয়।

যদিও ১৯৯৪ সালে মুদ্রণ ইতিহাসবিদ মাইক পার্কার দাবি করেন টাইমস নিউ রোমান শৈলীর নকশা করেন উইলিয়াম স্টারলিং বার্গেস। বার্গেসের ১৯০৪ সালের নকশার ওপর ভিত্তি করে টাইমস নিউ রোমান তৈরি করা হয় বলে বিতর্ক আছে। ১৯২০–এর দশকে সেই সময়কার প্রচলিত নকশার মধ্যে পত্রিকায় কোন ফন্ট প্রকাশ করা হবে তা নিয়ে মরিসনের পরামর্শ চায় টাইমস পত্রিকা। মরিসন ফন্ট আরও শক্তিশালী করার পরামর্শ দেন। মরিসন প্রথমে প্ল্যান্টিন নামে একটি পুরোনো মনোটাইপ টাইপফেস প্রস্তাব করেছিলেন। টাইমস নিউ রোমান ফন্টের বেশির ভাগ অক্ষর প্লান্টিনের মাত্রার সঙ্গে মিলে যায়। কিছু ভিন্ন স্ট্রোকের জন্য নকশাটি আলাদা হিসেবে তৈরি করা হয়।

এরিয়েল ফন্টের ত্রিমাত্রিক উপস্থাপনা

নতুন নকশার ফন্টে ১৯৩২ সালের ৩ অক্টোবর দ্য টাইমসে প্রকাশিত হয়। প্রকাশের এক বছর পর নতুন নকশা বাণিজ্যিকভাবে বিক্রির জন্য প্রকাশ করা হয়। টাইমস নিউ রোমান শব্দে রোমান শব্দটি নিয়মিত বা রোমান শৈলীর একটি সূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পঞ্চদশ শতকের শেষের দিকে ও ষোড়শ শতকের শুরুর দিকে ইতালীয় মুদ্রণে রোমান টাইপ চালু হয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে রোমান শব্দটি ব্যবহার করা হয়। টাইমস নিউ রোমানের নকশার সঙ্গে রোম বা রোমানদের কোনো সংযোগ নেই। টাইমস পত্রিকা ৪০ বছর ধরে টাইমস নিউ রোমানে প্রকাশিত হয়। ১৯৭২ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে পত্রিকাটি পাঁচবার টাইপফেস রূপ পরিবর্তন করে।

উইন্ডোজে বহুল ব্যবহৃত এরিয়েল

আরেকটি জনপ্রিয় ফন্ট হচ্ছে এরিয়েল। এরিয়েল স্যান-সেরিফ টাইপফেস ও নিও-গ্রোটেস্ক শৈলী। প্রধানত কম্পিউটারে ফন্টের সেট হিসেবে জনপ্রিয় এরিয়েল। উইন্ডোজ ৩.১ সংস্করণের পরে সব মাইক্রোসফট উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমের সব সংস্করণে দেখা যায়। অ্যাপলের ম্যাকওএসেও এই ফন্ট দেখা যায়। এই টাইপফেস ১৯৮২ সালে রবিন নিকোলাস ও প্যাট্রিসিয়া সন্ডার্স মনোটাইপ টাইপোগ্রাফির জন্য ডিজাইন করেন। এরিয়েলকে বাদ দিয়ে মাইক্রোসফট অফিস ২০০৭ পাওয়ারপয়েন্ট, এক্সেল ও আউটলুকে ক্যালিব্রি যোগ করে দেয়।

স্পেনের গৌরব নিয়ে হেলভেটিকা

আরেকটি জনপ্রিয় ফন্ট হেলভেটিকা। যার আসল নাম নিউয়ে হ্যাস গ্রোটেস্ক। হেলভেটিকা আরেকটি বহুল ব্যবহৃত সান-সেরিফ টাইপফেস। ১৯৫৭ সালে সুইস টাইপফেস ডিজাইনার ম্যাক্স মিডিঞ্জার ও এডুয়ার্ড হফম্যান এই ফন্ট তৈরি করেন। এই ফন্টের নকশা করা হয় উনিশ শতকের প্রচলিত টাইপফেস আকজিডেঞ্জ-গ্রোটেস্ক ও বেশ কিছু জার্মান ও সুইস ডিজাইনের সংমিশ্রণে। ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ দশকে এই ফন্ট সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পায়। বছরের পর বছর ধরে বর্ণের প্রস্থ ও আকারের বিস্তৃতির জন্য এই ফন্ট জনপ্রিয়তা পায়।

স্পেনের ফন্ট হেলভেটিকা

লাতিন শব্দ হেলভেটিয়া অর্থ সুইস, যা সুইজারল্যান্ডকে প্রকাশ করে। ১৯৭০ ও ১৯৮০ দশকের শেষের দিকে হেলভেটিকা ব্যবহারের অনুমতি পায় জেরক্স, অ্যাডোব ও অ্যাপল। ১৯৮৫ সালে এরিয়েল ও হেলভেটিকার অনুরূপ মাইক্রোসফট স্যানস সেরিফ নামের একটি ফন্ট চালু করে।

কন্যার নামে ফন্ট

ভারদানা আরকেটি জনপ্রিয় স্যান-সেরিফ টাইপফেস। ফন্ট ডিজাইনার ম্যাথিউ কার্টার মাইক্রোসফট করপোরেশনের জন্য এই ফন্ট ডিজাইন করেন। থমাস রিকনার এই ডিজাইন নির্মাণে যুক্ত ছিলেন। মাইক্রোসফটের স্টিভ বলমার এই ফন্ট ব্যবহার শুরু করেন। ভারদানা নামটির ভার্দান্ট বা সবুজ রংকে প্রকাশ করে। আর আনা তখনকার মাইক্রোসফটের ডিজাইনার ভার্জিনিয়া হাউলেটের বড় মেয়ের আনাকে প্রকাশ করে। হাউলেটের চাহিদার কারণেই এই ফন্ট তৈরি করা হয়। ভার্দানাকে সেই সময়ের কম-রেজল্যুশনের মনিটরে ছোট আকারের পাঠযোগ্য লেখার জন্য নকশা করা হয়। ২০০৬ সালে বিবিসি ও ডিজাইন মিউজিয়াম আয়োজিত গ্রেট ব্রিটিশ ডিজাইন কোয়েস্টে তালিকাভুক্ত করা হয় ভার্দানা টাইপফেসটি। সেরা ডিজাইনের সেই তালিকা কনকর্ড বিমান, মিনি গাড়ি, জাগুয়ার ই-টাইপ, অ্যাস্টন মার্টিন ডিবি ৫, সুপারমেরিন স্পিটফায়ার, ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব, লন্ডন টিউব ম্যাপ, এইসি রুটমাস্টার বাস এবং কে ২ টেলিফোন বক্সের নাম দেখা যায়।

আগ্নেয়গিরির নামে ফন্ট

তাহোমা আরেকটি স্যান-সেরিফ টাইপফেস ফন্ট। ম্যাথিউ কার্টার মাইক্রোসফট করপোরেশনের জন্য এর নকশা করেন। মাইক্রোসফট এ ফন্টকে অফিস ৯৭-এ যুক্ত করে। পূর্ণ ইউনিকোড অক্ষর সেট হিসেবে এই ফন্টের জনপ্রিয়তা অনেক। তাহোমার নামকরণ করা হয় আগ্নেয়গিরি মাউন্ট রেইনিয়ারের ডাকনাম মাউন্ট তাহোমার নামে। মাইক্রোসফটের সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল থেকে ৬২ মাইল দূরে এই আগ্নেয়গিরির অবস্থান। তাহোমা অফিস ৯৭, অফিস ২০০০ ও অফিস এক্সপিতে যুক্ত করা হয় অফিসিয়াল ফন্ট হিসেবে। তাহোমা উইন্ডোজ ২০০০, এক্সপি ও সার্ভার ২০০৩ অপারেটিং সিস্টেমে ব্যবহৃত হয়েছে স্ক্রিন ফন্ট হিসেবে। অনলাইনে কথা বলার সফটওয়্যার স্কাইপ ও ভিডিও গেম নির্মাতা সেগার ড্রিমকাস্টে এই ফন্ট ব্যবহার করা হয়। ২০০৭ সালে, অ্যাপল তাহোমাকে ম্যাকওসে যুক্ত করার কথা জানায়। তাহোমা বিভিন্ন সফটওয়্যার ও প্রোগ্রামিংয়ে ব্যবহার করা হয়।

ক্যালিব্রি আরেকটি আধুনিক শৈলীর ডিজিটাল সান-সেরিফ টাইপফেস পরিবারের ফন্ট হিসেবে জনপ্রিয়। ফন্টটি ২০০২-০৪ সালে ডাচ ডিজাইনার লুকাস দ্য গ্রুট ডিজাইন করে। ২০০৭ সালে মাইক্রোসফট অফিস ২০০৭ ও উইন্ডোজ ভিসতায় এই ফন্ট ব্যবহার করা হয়। ডিফল্ট ফন্ট টাইমস নিউ রোমানকে প্রতিস্থাপন করে এই ফন্ট ব্যবহার শুরু হয়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রায় ১৭ বছর পর মাইক্রোসফট নতুন বেসপোক ফন্ট অ্যাপটোস নতুন ডিফল্ট অফিস ফন্ট হিসেবে চালু করে।

টাইপরাইটের জন্য বিশেষ ফন্ট

ক্যুরিয়ার আরেকটি সেরিফ টাইপফেস ফন্ট। ১৯৫০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে আইবিএম এটি তৈরি করে। হাওয়ার্ড বাড এই ফন্ট ডিজাইন করেন। প্রাথমিকভাবে এই ফন্টের নাম মেসেঞ্জার হিসেবে ভাবা হয়েছিল। কুরিয়ার নাম ও টাইপফেস এখন কপিরাইটমুক্ত। প্রথমে আইবিএম সেলেক্ট্রিক টাইপরাইটারের জন্য এই ফন্ট তৈরি করে বলে জানা যায়। নতুন ফন্টের নকশা ১৯৫৫-৫৬ সালে উন্মুক্ত হয়। ১৯৯০ দশকে জনপ্রিয় হয় এই ফন্ট। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট এই ফন্ট ব্যবহার করা শুরু করে।

নিষিদ্ধও হয়েছিল কমিক স্যানস ফন্টটি

যে ফন্টের জন্য আন্দোলন হয়েছিল

আরেকটি জনপ্রিয় ফন্ট কমিক স্যানস এমএস যা কমিক স্যানস নামেও পরিচিত। এই ফন্ট ভিনসেন্ট কোনার নকশা করেন। মাইক্রোসফট করপোরেশন ১৯৯৪ সালে এটি প্রকাশ করে। কমিক বইয়ের অক্ষরের অনুপ্রেরণায় এই ফন্ট তৈরি করা হয়। প্রধানত শিশুতোষ লেখায় এই ফন্ট ব্যবহার করা হয়। ১৯৯৯ সালে এই ফন্ট ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ডিজাইনাররা সোচ্চার হন। পরবর্তী সময়ে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সেই আন্দোলন চলেছিল। নেদারল্যান্ডসের রেডিও ডিজে কোয়েন ও স্যান্ডার এই ফন্টের সম্মানে জুলাই মাসের প্রথম শুক্রবারকে উৎসর্গ করে কমিক স্যানস ডে পালন করছে ২০০৯ সাল থেকে। ২০২০ সালে টুইটারের (এখন এক্স) এক জরিপে জানা যায় ৪৪ শতাংশ শিক্ষক এই ফন্টের মাধ্যমে তাদের লেখা শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরেন।

ফরাসি মুদ্রণশিল্পে আলোচিত যে ফন্ট

গ্যারামন্ড হল সেরিফ টাইপফেস ফন্টের একটি গ্রুপ। এই ফন্টের নাম দেওয়া হয় ষোড়শ শতাব্দীর প্যারিসিয়ান খোদাইকারী ক্লদ গ্যারামন্ডের নামে। গ্যারামন্ড ধরনের টাইপফেস জনপ্রিয়। বিভিন্ন বই মুদ্রণে এই ফন্ট বেশ ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন গ্যারামন্ড ফন্ট অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে জনপ্রিয়তা পায়। গ্যারামন্ড নিজে ষোড়শ শতাব্দীর ফরাসি মুদ্রণে প্রভাবশালী ব্যক্তিত ছিলেন। গ্যারামন্ড ফন্ট একাডেমিক লেখায় বেশি ব্যবহৃত হয়।

সূত্র: উইকিপিডিয়া