একাকী নিঃসঙ্গ নাবিক রবিনসন ক্রুসোর নাম অনেকেই জানি। আগের সময়ে রবিনসন ক্রুসো বা অন্য নাবিকেরা দূরদ্বীপে আটকা পড়লে কী করতেন বলুন তো? অনেক নাবিকই বোতলে বার্তা লিখে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিতেন। সেই বার্তাসহ বোতল কয়েক দিন কিংবা কয়েক বছর পর হয়তো কোনো প্রাপকের সামনে ভেসে উঠত। নাবিকের সেই ভাসিয়ে দেওয়া বার্তা থেকে হালহকিকত জানার সুযোগ মিলত।
আধুনিক সময়ে অনেকবারই পৃথিবীর নানা রকম তথ্য খেয়াযানে করে মহাশূন্যে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে, যেন কখনো দূর মহাকাশের অধিবাসীরা সেই বার্তার খোঁজ পায়। সেই ধারাবাহিকতায় একদল সংগ্রাহক চাঁদের বুকে মানুষের গল্প ও কর্ম পাঠানোর কাজ শুরু করেছেন। বিশ্বের ৩০ হাজার শিল্পীর সৃজনশীল কর্ম চাঁদে পাঠানোর ভিন্ন রকমের এই কর্মসূচির নাম লুনার কোডেক্স। ১৫৭ দেশের শিল্পীদের নানা ছবি, চিত্রকর্ম, বই, সাময়িকী থেকে শুরু করে পডকাস্ট, সিনেমা আর গান পাঠানো হচ্ছে চাঁদে।
কানাডার পদার্থবিদ স্যামুয়েল পেরাল্টা এই কর্মসূচির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ন্যানোফিচ প্রযুক্তির মেমোরি কার্ডে এসব তথ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ন্যানোফিচ অ্যানালগ প্রযুক্তি, যেখানে তথ্যাদি লেজার রশ্মির মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হয়। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার মধ্যেও ভালো থাকে এই ন্যানোফিচ।
এবার যেসব সৃজনশীল কাজ পাঠানো হচ্ছে, তার মধ্যে একজন বাংলাদেশি শিল্পীর কাজও রয়েছে। লুনার কোডেক্সের ওয়েবসাইটে দেখা যায় ‘ম্যাটারনাল ইনস্টিংক্ট’ নামের একটি ছবি পাঠানো হচ্ছে চাঁদে। কানাডাপ্রবাসী বাংলাদেশি শিল্পী সালবী সুমাইয়া এই শিল্পকর্ম এঁকেছেন। সমসাময়িক নানা বিষয় থেকে শুরু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন নিয়ে ছবি আঁকেন তিনি। শুধু তাঁর শিল্পকর্মই নয়, সালবী সুমাইয়ার শিল্পকর্ম নিয়ে একটি ভিডিও চিত্রও যাচ্ছে চাঁদে। লুনার কোডেক্সের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, ‘মেরাকি স্টুডিও’ (২০২২) নামের একটি ভিডিও পাঠানো হচ্ছে চাঁদে। এটি সালবী সুমাইয়ার শিল্পকর্ম নিয়ে নির্মিত।
স্যামুয়েল পেরাল্টের ভাষ্যে, ‘পৃথিবীর বাইরের এই সংরক্ষণাগারের মাধ্যমে ভবিষ্যতের মানুষের কাছে সৃজনশীল কাজগুলোকে পৌঁছানোর কাজ করছি আমরা। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন জানে শতযুদ্ধ, মহামারি ও আর্থিক সংকটের ভিড়েও আমরা সৃজনশীল সুন্দর কাজ থামিয়ে রাখিনি। চারটি স্পেস ক্যাপসুলে আলাদা আলাদা করে পাঠানোর জন্য সংগ্রহ করা হয় বিভিন্ন নিদর্শন। প্রথম সংকলনের নাম দেওয়া হয় ওরিয়ন, যা এরই মধ্যে গত বছর চাঁদে পাঠানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা—নাসার “আর্টেমিস ১” অভিযানে এটি যুক্ত করা হয়েছিল।’
পরের সংগ্রহের নাম রাখা হয়েছে নোভা। যা আগামী অক্টোবর-নভেম্বরে স্পেসএক্স ফ্যালকন–৯ রকেটে সিএলপিএস-২ মিশন ল্যান্ডারে করে পাঠানো হবে। চাঁদের দক্ষিণ মেরুর মালাপার্টে ক্র্যাটারে পাঠানো হবে নোভা। এ বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর সময়ের অ্যাস্ট্রোবটিক পেরেগ্রিন ল্যান্ডারের সাহায্যে তৃতীয় সংগ্রহ পাঠানো হবে। সর্বশেষ পোলারিস সংগ্রহ ২০২৪ সালের নভেম্বরে পাঠানো হবে। নাসার ভাইপার রোভারে চড়ে পোলারিস যাবে চাঁদের দক্ষিণ মেরুর নোবেল ক্র্যাটারে।
চাঁদে কিন্তু এবারই প্রথম কোনো কিছু পাঠানো হচ্ছে না। ১৯৬৯ সালে অ্যাপোলো–১২ চন্দ্র অভিযানে সিরামিক বস্তু চাঁদে রেখে আসা হয়। সেই সিরামিক খণ্ডে অ্যান্ডি ওয়ারহল, রবার্ট রশেনবার্গ, ফরেস্ট মেয়ার্স ও জন চেম্বারলিনের আঁকা ছবি ছিল। অ্যাপোলো ১৫ অভিযানে ৯ সেন্টিমিটার উঁচু অ্যালুমিনিয়াম স্থাপত্য চাঁদের বুকে নিয়ে যাওয়া হয়। লুনার কোডেক্সে নানা বস্তুর তথ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে। কবিতা, গল্প থেকে শুরু করে নানা ছবির তথ্য যুক্ত করা হচ্ছে। অ্যাপোলো–১১ অভিযানে নভোযাত্রীরা সিলিকন ডিস্কে বিশ্বনেতাদের বক্তব্য নিয়ে যান চাঁদে।
যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইয়ান ক্রফোর্ড জানান, মহাবিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে এই কর্মসূচি আসলে বিশাল। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ক্রিস লিনটটের ভাষায়, ‘মহাবিশ্বের অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তিক সত্তার সন্ধানে আমাদের খোঁজ চলছে। আমাদের সৃজনকর্ম নিয়ে ভিনগ্রহের বাসিন্দাদের ভাবনা কেমন হবে?’
স্যামুয়েল পেরাল্ট বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা ভবিষ্যতের অভিযাত্রীরা এই টাইম ক্যাপসুল থেকে বর্তমান পৃথিবীর বিশালতা সম্পর্কে ধারণা পাবেন। শত যুদ্ধ, মহামারি, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো নানা বিষয়ের মধ্যেও মানবসভ্যতা স্বপ্ন দেখে, শিল্পকর্ম তৈরির কাজ করে।’
লুনার কোডেক্সের সংবাদে বাংলাদেশি চিত্রশিল্পীর নাম দেখে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সালবী সুমাইয়ার সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হয়। আজ দুপুরে সালবী সুমাইয়া প্রথম আলোকে জানান, লুনার কোডেক্স প্রোগ্রাম একটি অসাধারণ ও দূরদর্শী উদ্যোগ, যার লক্ষ্য চাঁদে সমসাময়িক শিল্প ও সংস্কৃতির একটি বৈচিত্র্যময় সংগ্রহ পাঠানো। একজন শিল্পী হিসেবে আমি এই মর্যাদাপূর্ণ কর্মসূচিতে শুধু একটি নয়, দুটি বিভাগের জন্য নির্বাচিত হয়ে সম্মানিত বোধ করছি। আমি আশা করি, আমার কাজ চাঁদে বাংলাদেশের শৈল্পিক চেতনার প্রতিনিধিত্ব করবে।
সালবী সুমাইয়া তাঁর লিখিত বার্তায় আরও উল্লেখ করেন, ‘এটি শুধু আমার চারুকলা দক্ষতা দেখানোর বিষয় নয়, আজকের বিশ্বের মুখোমুখি হওয়া গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোকে তুলে ধরারও সুযোগ। সবচেয়ে বড় কথা হলো আমাদের কাজগুলো অনন্তকালের জন্য চাঁদে সংরিক্ষত থাকবে। একটি শৈল্পিক উত্তরাধিকার রেখে যাবে, যা সময় ও স্থান অতিক্রম করে।’
সালবী সুমাইয়ার ‘ম্যাটারনাল ইনস্টিংক্ট’ চিত্রকর্মটি তেলরঙে আঁকা। ছবিটির ডিজিটাল সংস্করণ যাচ্ছে চাঁদে। ৩৬ x ৩৬ ইঞ্চি আকারের এই চিত্রকর্মে মাতৃত্বের অবয়ব তুলে ধরেছেন শিল্পী। সালবী সুমাইয়া এরই মধ্যে বাংলাদেশ, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, পোল্যান্ড, জাপানসহ বিভিন্ন দেশে চিত্রকর্ম প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান