ফ্রিল্যান্সাররা বলছেন

এত ধীরগতির ইন্টারনেট দিয়ে আমরা কী করব

দেশে ১৮ জুলাই রাতে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের মুক্ত পেশাজীবী বা ফ্রিল্যান্সাররা। বন্ধ করার ছয় দিন পর পরীক্ষামূলকভাবে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু হলেও তা ফ্রিল্যান্সারদের তেমন কাজে আসছে না। ফাইল নামানো (ডাউনলোড), ফাইল আদান-প্রদান, গ্রাহক বা বায়ারদের সঙ্গে যোগাযোগ ও অনলাইন সভা করতে নানা সমস্যায় পড়েছেন তাঁরা। ১৮ জুলাই রাত থেকে এখনো মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রয়েছে।

বর্তমানে চালু হওয়া শুধু ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট নিয়ে একাধিক ফ্রিল্যান্সার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁদের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। অনেক ফ্রিল্যান্সারের গ্রাহক চলে গেছেন, তাতে অনেক ক্ষতির মুখে পড়েছেন ফ্রিল্যান্সাররা। কেননা, এ খাতের পুরোটা ইন্টারনেটনির্ভর।

দেশে এখন সাড়ে ৬ লাখ থেকে ১০ লাখ তরুণ ফ্রিল্যান্সার হিসেবে দেশে বসে মূলত বিদেশের গ্রাহকদের কাজ করেন। দেশে বসেই আয় করেন ডলার। অন্যদেরও সুযোগ করে দিচ্ছেন তাঁরা। এ কাজের জন্য লাগে নিজের দক্ষতা, বিদ্যুৎ আর গতিশীল ইন্টারনেট-সংযোগ। এর একটা না থাকলে ফ্রিল্যান্সিং করা অসম্ভব। বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে ১৫৩টি মার্কেটপ্লেসে (আউটসোর্সিংয়ের কাজ দেওয়া-নেওয়ার ওয়েবসাইট) কাজ করা হয়।

গত সপ্তাহে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকা ও বর্তমানে চালু থাকা ইন্টারনেটে কাজ করার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে প্রথম আলো কয়েকজন শীর্ষ ফ্রিল্যান্সারের সঙ্গে কথা বলেছে। ঢাকার ফিল্যান্সার এমরাজিনা ইসলাম আজ শনিবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে যে কাজ ৫ মিনিটে করে ফেলতাম, সেটা এখন দুই ঘণ্টায়ও হচ্ছে না। এককথায় আমরা বিপদে ও ভয়ে আছি। ছোট ছোট গ্রাহকেরা চলে গেছেন, আর পুরোনো বড় গ্রাহকদের দেশের বর্তমান ইন্টারনেট পরিস্থিত সম্পর্কে বোঝানো হয়েছে। কিন্তু কতক্ষণ তাঁরা শুনবেন আমাদের কথা। আজ ছয়-সাত দিন ধরে একই অবস্থা। যে কাজগুলোর ক্ষেত্রে বায়াররা আমাদের দেশের ফ্রিল্যান্সারদের ওপরই বেশি ভরসা করতেন, সেগুলো এখন ভারত, ফিলাপাইন ও পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে। বায়াররা তো বিকল্প ভাববেন। কারণ, যথাসময়ে তাঁদের দরকার কাজ। যেকোনো মূল্যে তাঁরা যেকোনো দেশ থেকে করিয়ে নেবেন। আমাদের জন্য বসে থাকবেন না।’

ফ্রিল্যান্সাররা তাঁদের বর্তমান ইন্টারনেট নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিচ্ছেন

ঢাকার আরেক ফ্রিল্যান্সর শুভ সরকার বলেন, ‘আমি যেহেতু স্পেশাল ইফেক্ট, ত্রিমাত্রিক গ্রাফিকস নিয়ে কাজ করি, তাই পাঁচ দিনে চার লাখ টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। কারণ, কাজ নিয়ে নিদিষ্ট সময়ে তা গ্রাহকদের কাছে সরবরাহ করতে পারিনি। এখন যে ইন্টারনেট, সেটা জোড়াতালি দিয়ে চালানো। ফলে কাজ করতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। পারিশ্রমিক বা আয়ের থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রেপুটেশন, যা তিন-চার বছর ধরে অর্জন করেছি, সেটা পুরোই শেষ। এমন গ্রাহক আছেন, যাঁদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকাও নিয়েছি। কিন্তু তাঁদের একটা বার্তারও উত্তর দিতে পারিনি। এখন ইন্টারনেটের যে গতি রয়েছে, তা দিয়ে কাজ করা অসম্ভব।’

টাঙ্গাইলের মধুপুরভিত্তিক নকরেক আইটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুবীর নকরেক বলেন, ‘নামে ব্রডব্যান্ড হলেও এখন যে ইন্টারনেট আমরা পাচ্ছি, সেটির গতি মাত্র ২০ কেবিপিএস। স্বাভাবিক সময় গতি পাওয়া যেত ৫০ থেকে ৭০ এমবিপিএস (১ এমবিপিএস = ১০২৪ কেবিপিএস)। আমরা কোনো কূলকিনারাই পাচ্ছি না, শান্তি পাচ্ছি না অফিস খুলেও। ইন্টারনেটের গতি না থাকলে ফ্রিল্যান্সারদের জীবনজীবিকা হুমকির মুখে পড়বে।’

সিলেটের ফ্রিল্যান্সার রাজু আহমেদ বলেন, ‘এত স্লো (ধীরগতির) ইন্টারনেট নিয়ে কাজ করা সম্ভব নয়। আমি একটি দল গঠন করে কাজ করি। তাঁদের বেতন ও অন্যান্য খরচ রয়েছে। কিন্তু এখন তো আয় একদমই কমে গেছে। অনেক গ্রাহক চলে গেছেন। যাঁরা অগ্রিম টাকা দিয়েছিলেন, তাঁরা বিশ্বাস হারাচ্ছেন। সব মিলিয়ে ছয় বছর ধরে যা অর্জন করেছিলাম, তা চোখের সামনে শেষ হয়ে যাচ্ছে।’

শেরপুর থেকে কাজ করেন ফ্রিল্যান্সার মিনাজ উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘এমন অবস্থা যে ১০ জন গ্রাহক চলে গেছেন, যাঁরা আমাকে ছাড়া কাজ করাতেন না। মোবাইল ইন্টারনেট নেই যে সব সময় সক্রিয় থাকব। ইন্টারনেট যা এখন চালু করা আছে, সেটা দিয়ে বড় ফাইল পাঠাতে পারছি না। একটা মেইল করতেই অনেক সময় লাগছে। মোটকথা, এই ইন্টারনেট আমাদের কাজে আসছে না।’

ইন্টারনেট এমন ধীরগতির যে মার্কেটপ্লেসেই ঢুকতে পারছি না বলে জানান শেরপুরের ফ্রিল্যান্সার মিনাজ উদ্দিন। তিনি বলেন, গত সাত দিনে ৩২টি কাজের অর্ডার বাতিল হয়েছে। এমন ইন্টারনেট থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো।

ইন্টারনেট সংযোগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সভাপতি মো. ইমদাদুল হক মুঠোফোনে বলেন, ‘ইন্টারনেট ধীরগতির হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। মোবাইল অপারেটরদের মোবাইল ইন্টারনেট চালু হলে আইএসপিনির্ভর ইন্টারনেট সংযোগে ব্যান্ডউইডথের ওপর চাপ কমবে। অনেকে মোবাইলে ১০০-২০০ টাকার প্যাকেজ কিনে নেট চালিয়ে থাকেন। এখন আমাদের যে ব্যান্ডউইডথ, সেটা দিয়েও মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন বেশির ভাগ গ্রাহক। সাবমেরিন কেব্‌ল ও আইটিসি (ইন্টারন্যাশনাল টেরেস্ট্রিয়াল কেব্‌ল) থেকে দেশে সাড়ে ৬ হাজার জিবিপিএস (১০২৪ এমবিপিএস = ১ জিবিপিএস) ব্যান্ডউইডথ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৩ হাজার ৫০০ আইএসপিগুলো ব্যবহার করে। বাকি তিন হাজার মোবাইল অপারেটরের জন্য। এখন ব্যবহারকারী অনেক বেড়ে গেছে। এ কারণ ইন্টারনেটের গতি ধীর।’

বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান তানজিবা রহমান বলেন, ‘ইন্টারনেট ধীরগতির হওয়ায় অনেক ক্ষতি হচ্ছে ফ্রিল্যান্সারদের। আমি নিজে অ্যামাজনে কাজ করি। ওখানে বেশি রেজল্যুশনের ছবি দিতে হয়। কিন্তু ভালো ছবি পাঠানো যাচ্ছে না বা ডাউনলোড হচ্ছে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লাগছে। অনেক ফ্রিল্যান্সার বলছেন, এভাবে কাজ করা যায় না, আমাদের এখন বিকল্প ভাবতে হবে। দেশের বাইরে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় দেখছি না। এভাবেই মেধাবীরা বাইরে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করলে আমরা বিপদে পড়ে যাব।’