কম্পিউটার গ্রাফিকসের কাজ করেন ফ্রিল্যান্সার সমুয়েল বৈরাগী
কম্পিউটার গ্রাফিকসের কাজ করেন ফ্রিল্যান্সার সমুয়েল বৈরাগী

ছিলেন রাজমিস্ত্রির সহযোগী, ফ্রিল্যান্সিং করে কোটালীপাড়ার সমুয়েল গড়েছেন দোতলা বাড়ি

দারিদ্র্যের সঙ্গেই বেড়ে উঠেছেন সমুয়েল বৈরাগী। টিকে থাকতে রাজমিস্ত্রির সহযোগী, কখনোবা পণ্য সরবরাহকারীর কাজও করেছেন। কিন্তু কম্পিউটার নিয়ে ছিল আগ্রহ। নিজের চেষ্টায় কম্পিউটারের বিভিন্ন বিষয় শিখে নেন ধীরে ধীরে। একসময় শুরু করেন ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিংয়ের কাজ। সমুয়েল আজ একজন সফল মুক্ত পেশাজীবী বা ফ্রিল্যান্সার। একসময় যিনি ছিলেন রাজমিস্ত্রির সহযোগী, আজ তিনি ফ্রিল্যান্সিং করে নিজ বাড়িতে গড়ে তুলেছেন দোতলা দালান।

উত্তম বৈরাগী ও কলমী বৈরাগীর দুই ছেলে, এক মেয়ের মধ্য সবার বড় সমুয়েল বৈরাগী। ছোটবেলা থেকেই কম্পিউটার নিয়ে অনেক আগ্রহ গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া থানার ধারাবাশাইল গ্রামের এই ছেলেটির। দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম চলছিল, তবে পড়াশোনা ছাড়েননি কখনো। স্থানীয় স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। এরপর চলে আসেন ঢাকায়।

২০০৭ সাল। ঢাকায় এসেছেন সবে। নিজের একটা কম্পিউটার হবে, নানা কাজ করবেন—এমন ইচ্ছা সমুয়েলের। ঢাকায় আসার কিছুদিনের মধ্যে একটা সমবায় সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে কম্পিউটার কিনে ফেলেন। একদিকে চলছে পড়াশোনা, অন্যদিক কম্পিউটারে কাজ শেখার চেষ্টা।

বিশেষ কোনো প্রশিক্ষণ কোর্স করার মতো টাকা সমুয়েলের ছিল না সে সময়। মা–বাবা খুব সামান্য বেতনে বাবুর্চির কাজ করছেন গোপালগঞ্জেই। ফলে ঢাকায় নিজের খরচ চালানোই অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। তাই পড়াশোনার পাশাপাশি উপার্জন করা যায়, এমন একটি কাজ খুঁজতে থাকেন সমুয়েল। রাজমিস্ত্রির সহযোগী, রাতে পোস্টার লাগানোসহ ছোট অনেক কাজ করতে থাকেন। এসব করতে করতেই খুঁজতে থাকেন কম্পিউটার–সংশ্লিস্ট কাজ। বাসায় বসে বসে এমএস ওয়ার্ড ও এক্সেলের মতো সফটওয়্যারের কাজ শিখে ফেলেন নিজের কম্পিউটারে। এমন সময় এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে একটি স্থায়ী চাকরির প্রস্তাব পান সমুয়েল। পণ্য সরবরাহকারী বা ডেলিভারিম্যানের চাকরি। কোনো চিন্তা না করে যোগ দেন সেটিতে। এটাই তাঁর জীবনের প্রথম বাকবদল।

ওই প্রতিষ্ঠান মূলত স্মারক, ম্যাগাজিন ইত্যাদির গ্রাফিক ডিজাইনের কাজ করত। সমুয়েল ওই সব স্মারক, ম্যাগাজিন পৌঁছে দিতে গ্রাহকের কাছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি অফিসের গ্রাফিক ডিজাইনারদের পাশে বসে তাঁদের হাত ও কিবোর্ডের দিকে লক্ষ্য রাখতেন। দেখতেন, কীভাবে কাজ করেন তাঁরা। রাতে বাসায় ফিরে সেগুলো চর্চা করতেন।

এভাবেই ধীরে ধীরে কম্পিউটার গ্রাফিকসের কিছু প্রাথমিক কাজ শিখে ফেলেন সমুয়েল। আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে নিতে একটা কোর্সও করেন ওই প্রতিষ্ঠানে। ফটোশপ ও ইলাস্ট্রেটর সফটওয়্যার শিখে সেখানেই গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে যোগ দেন।

সমুয়েলের কাজ ছিল ম্যাগাজিন ডিজাইন করা। ডিজাইনার হিসেবে তিন বছর কাজ করেছেন তিনি। এর মধ্যে অনলাইনে কাজ শেখার আগ্রহ বাড়তে থাকে তাঁর। চেষ্টা করেন অনলাইনে কাজ পাওয়ার। কিন্তু কিছুতে কিছু হচ্ছিল না। একপর্যায়ে সফল ফ্রিল্যান্সার সুবীর নকরেকের কথা জানতে পারেন সমুয়েল। যোগাযোগ করেন সুবীরের সঙ্গে। সুবীর তখন অনলাইনে কাজ করছেন; কিন্তু প্রশিক্ষণ দেন না। সমুয়েল তাঁকে বলে রাখেন, প্রশিক্ষণ দিলে যেন অবশ্যই সমুয়েলকে জানান তিনি।

বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি সমুয়েলকে। কিছুদিনের মধ্যেই সুবীর নকরেক যোগাযোগ করেন তাঁর সঙ্গে। জানান যে তিনি প্রশিক্ষণ দেবেন, সমুয়েল চাইলে ভর্তি হতে পারেন। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান সমুয়েল। সুবীরের প্রতিষ্ঠান নকরেক আইটিতে কোর্স শুরু করেন। গ্রাফিকসের খুঁটিনাটি কাজ শিখে ফেলেন সমুয়েল। এরপর তাঁর প্রশিক্ষণ শুরু হয় কাঙ্ক্ষিত অনলাইন মার্কেটপ্লেসে (আউটসোর্সিংয়ের কাজ দেওয়া–নেওয়ার ওয়েবসাইট)। কোর্স শেষ করে ফ্রিল্যান্সার ডটকম মার্কেটপ্লেসে বিভিন্ন কাজের জন্য প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে থাকেন। প্রতিদিন প্রতিযোগিতার জন্য ডিজাইন করতেন। ডিজাইন গৃহীত হতো না, তবু হাল ছাড়েননি সমুয়েল। প্রবল আগ্রহ নিয়ে কাজ করে যান। আর এখান থেকে আরেক দফা বদলে যেতে থাকে তাঁর জীবন।

ফ্রিল্যান্সার ডটকমে সমুয়েলের প্রথম জয় আসে ফুটবল বিশ্বকাপের একটি স্পন্সর লোগোর নকশায়। কাজটি করে তিনি ২৫০ ডলার আয় করেন। অনলাইনে এটিই ছিল তাঁর প্রথম উপার্জন। অনলাইন থেকে প্রথম উপার্জনের পর সমুয়েলের উদ্যম আরও বেড়ে যায়। ফ্রিল্যান্সার ডটকমের পাশাপাশি ফাইভআর ডট কম মার্কেটপ্লেসে কাজ শুরু করেন তিনি। ২০১৭ সালে, প্রায় এক বছর পরে এখানে ৫ ডলারের একটি কাজ পান। মজার ব্যাপার হলো, তাঁকে যিনি ডিজাইনের কাজটি দিয়েছিলেন, তিনিও ছিলেন নতুন।

সমুয়েল বৈরাগী

ফাইভআরের সেই প্রথম গ্রাহকের সঙ্গে এখনো কাজ করে যাচ্ছেন সমুয়েল। এখন পর্যন্ত ১১ হাজার ডলারের বেশি আয় করেছেন তিনি ফাইভআর থেকে। কাজ করছেন আপওয়ার্কেও। এ ছাড়া সরাসরি যুক্তরাজ্যের একটি প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিকভাবে যুক্ত আছেন। পাশাপাশি লোকাল মার্কেটে দ্য ডিজাইন হাউস নামের একটি প্রতিষ্ঠানও গড়েছেন সমুয়েল। সব ধরনের গ্রাফিকসের কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি। বছরে ৮-১০টি মুদ্রিত ম্যাগাজিনের কাজ থাকে। অন্যান্য কাজ মিলিয়ে যা আয় হয়, তা দিয়ে পরিবার নিয়ে খুব ভালোভাবে চলে যায়। কোটালীপাড়ায় নিজের জন্য দোতলা একটি বাড়িও নির্মাণ করেছেন সমুয়েল বৈরাগী।

সমুয়েল এখন একজন পূর্ণকালীন ফ্রিল্যান্সার! নিজেকে এগিয়ে রাখতে ডিজিটাল বিপণনসহ নতুন সব কোর্স করছেন তিনি। এখন তাঁর এই অঙ্গন জয় করার পালা।