রেমিটেন্স
রেমিটেন্স

রেমিটেন্স আনা ফ্রিল্যান্সাররা কেন অসহায় বোধ করছেন

সম্প্রতি এক সপ্তাহেরও বেশি ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকায় বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের মুক্ত পেশাজীবী বা ফ্রিল্যান্সাররা। কেননা এ খাতের পুরো কাজ ইন্টারনেটনির্ভর। কয়েক দিন ইন্টারনেট না থাকায় সারাদেশের ফ্রিল্যান্সাররা বিদেশ থেকে গ্রাহক বা বায়ারের পাঠানো বার্তার উত্তর দিতে পারেননি। আবার কারো কারো কাজ জমা দেওয়ার সময় পেরিয়ে হয়ে গেছে।

গত শুক্রবার সারা দেশের প্রায় ৫০ জন ফ্রিল্যান্সারের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁদের প্রায় সবারই কথা এরকম, আমাদের কথা কাকে বলবো, কে শুনবে? আমাদের ক্ষতিটা আমরা বোঝাতে পারছি না। আমরা হারিয়ে যাচ্ছি, আমাদের কাজগুলো অন্য দেশে চলে যাচ্ছে। যে কাজগুলো করে আমরা দেশে বৈদেশিক মুদ্রা (রেমিটেন্স) আনতাম। ইন্টারনেট বন্ধ করে রাখা বা গতি কমিয়ে দেওয়া কোনো সমাধান হতে পারে না। এতে আমরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।

ঢাকার ফ্রিল্যান্সার তৌহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আর একবার ইন্টারনেট ব্ল্যাক আউট হলে ফ্রিল্যান্সাররা পথে বসে যাবে। প্রথমবারেই অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে আমাদের। বুঝিয়ে বলেছি, কিছু বায়ার শুনেছেন কিন্তু অন্যরা চলে গেছেন। আবার যদি ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয় বা গতি কমিয়ে দেওয়া হয়, তবে বাংলাদেশের নাম শুনলেই বায়ররা জানাবে যে তাঁরা আগ্রহী নন। আমরা কাজ পাবো না। একটা বিপদের মধ্যে আছি আমরা।’

দিনাজপুরের ফ্রিল্যান্সার মাহমুদুল হাসান জানালেন এখনও (গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত) কাজ করতে পারছেন না।   তিনি বলেন, ‘কাজ করতে পারছি না, ফলে খারাপ ফিডব্যাক আসছে। আপওয়ার্ক মার্কেটপ্লেসের (অনলাইনে আউটসোর্সিংয়ের কাজ দেয়া–নেয়ার ওয়েবসাইট) প্রোফাইলে নেতিবাচক (নেগেটিভ) রিভিউ আসছে। একটা নেগেটিভ রিভিউ থাকলে পরবর্তীতে কাজ পাওয়া মুশকিল হয়ে যায়। যে প্রকল্পগুলো ছিলো সেগুলো আর পাচ্ছি না। গ্রাহক সেগুলো ভারত, পাকিস্তান ফিলিপাইনের মত দেশ থেকে করিয়ে নেবেন। আমরা অসহায় বোদ করছি।’

ভোলার ফ্রিল্যান্সার মিজানুর রহমান বলেন, ‘একজন বায়ার আমাকে বার্তা দিচ্ছেন, কবে শেষ হবে তোমাদের এই যুদ্ধ? তোমাদের খবর আমি জানি। টেক কেয়ার। এই গ্রাহকের কাছে আমার প্রায় পাচ হাজার ডলারের কাজ ছিলো। এখন আর তিনি কোনো যোগাযোগ করছেন না। তিনি অন্য কোথাও কাজটা দিয়ে দিয়েছেন। এখন গ্রাহকেরা ভয় পাচ্ছেন আমাদের কাজ দিতে। পাঁচজন গ্রহাক হাতছাড়া হয়ে গেছে। ইন্টারনেট আবার চালু হওয়ার পর দেখছি, বাংলাদেশ থেকে বায়াররা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। ভয়েও আছি, কখন আবার নেট বন্ধ হয়ে যায়। তাহলে তো সব শেষ। শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়ে চাষাবাদ করতে হবে।  

মানিকগঞ্জের ফ্রিল্যান্সার তানজিম রহমান বলেন, ‘কাকে কী বলবো? চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে আমাদের সমস্যার কথাগুলো। তিনটা কাজ সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সরবরাহ করার সময় ইন্টারনেট ছিল না। ফাইভআরে সতর্কতা নোটিশ দিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে সব অর্জন হারিয়ে ফেলব।

ফ্রিল্যান্সিংয়ের নানা বিষয়ের প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান স্কিলআপারের প্রতিষ্ঠাতা শামীম হুসাইন প্রথম আলোকে বলেন, আমার পাঁচ হাজারের বেশি প্রশিক্ষনার্থী মার্কেটপ্লেসে কাজ করছেন। তাঁদের অনেকের সঙ্গে সাথে কথা বলে ও ফেসবুক গ্রুপের পোস্ট থেকে জানতে পেরেছি তাঁদের প্রায় এক লাখ মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্ডার বাতিল হয়েছে। কারও কারও স্থায়ী গ্রাহক চলে গেছেন অন্যত্র। এভাবে চলতে থাকলে ফ্রিল্যান্সারা আর দাঁড়াতে পারবেন না। এর স্থায়ী সমাধান দরকার।’

ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে যশোরের পপি রানী সিনহার চারজন স্থায়ী বায়ার এরই মধ্যে চলে গেছেন।

তিনি বলেন, এর ফলে ১ হাজার ৩৮০ ডলারের অর্ডার বাতিল হয়েছে। এমন হলে যে স্বপ্ন নিয়ে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেছিলাম, সেই স্বপ্ন ভেঙে যাবে ।

নেত্রকোনার আইরিন আক্তার বলেন, ‘দেশের এই অবস্থায় নিজের কথা ভাবা ঠিক হয়তো নয়। আমাদের ফ্রিল্যান্সিং  ক্যারিয়ার এখন হুমকির মুখে। গ্রাহকেরা আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। গত কয়েকদিনে কয়েক হাজার ডলারের অর্ডার বাতিল হয়েছে। অনেক গ্রাহক যোগাযোগ করেছেন, কিন্তু নেট না থাকায় আমরা সাড়া দিতে পারিনি। তারা অন্যদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিয়েছেন।’ বাগেরহাটের মংলা থেকে একইরকম অভিজ্ঞতার কথা শোনান ফ্রিল্যান্সার শিল্পী সেন।

ফাইভআর টপ রেটেড (মোবাইল অ্যাপ ডেভেলপার) ফ্রিল্যান্সার চট্টগ্রামের জেবাউল নকিব বলেন, কয়েকটি এজেন্সির সঙ্গে প্রকল্পভিত্তিক কাজ করি। সঙ্গে একটা রিমোট কাজও রয়েছে। ফাইভারে আমার প্রোফাইল ‘টপ রেটেড’। মোবাইল অ্যাপ তৈরি করায় আমার একেকটি অর্ডারের পারিশ্রমিক হয় এক থেকে দেড় হাজার ডলার।  ইন্টারনেট না থাকায় গ্রাহক আমাকে কোথাও না পেয়ে অন্য দেশে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্রিল্যান্সারকে কাজগুলো দিয়ে দেন। সরাসরি না বললেও বুঝতে পারি গ্রাহকেরা আমাকে কাজ দিয়ে ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। সময় তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

জেবাইল নকিব আরও বলেন, এখন ইন্টারনেট চালু থাকলেও ধীরগতির জন্য কাজ করতে কষ্ট হচ্ছে। সব মিলিয়ে গ্রাহকের আস্থার জায়গাটি হারিয়েছি। যা আমরা ৯-১০ বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিলে তিলে গড়ে তুলেছি। আবার যদি ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয় তবে নেপাল চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সারদের সবচেয়ে বড় ফেসবুক গ্রুপ ফ্রিল্যান্সারস অফ বাংলাদেশের (এফওবি) প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডমিন ফয়সাল মোস্তফা বলেন, ‘ছয় দিন ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের ফলে ফ্রিল্যান্সাররা তাদের চলমান অর্ডারগুলো একদিকে যেমন সময়মত সরবরাহ করতে পারেননি, অন্যদিকে নতুন গ্রাহকদের পাঠানো বার্তার উত্তর সময়মতো দিতে পারেন নি। ফলে অর্ডার বাতিলের হার বেড়ে গেছে, সঙ্গে কমেছে রেসপন্স রেট। পরবর্তীতে ইন্টারনেট এলেও গতি এতই কম যে, যে ১ ঘন্টার কাজ করতে ৩/৪ ঘন্টা লেগে যাচ্ছে। বড় কথা হলো গত কয়েকদিনের ঘটনায় আন্তর্জাতিক আউটসোর্সিং বাজারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি (কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং) যেভাবে নষ্ট হয়েছে, তা ফিরে পেতে আমাদের অনেক কষ্ট করতে হবে।’

টপ রেটেড ফ্রিল্যান্সার ও আপওয়ার্ক বাংলাদেশ গ্রুপের অ্যাডমিন কাজী মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, ইন্টারনেট। ইন্টারনেটও মৌলিক চাহিদার অন্তর্ভুক্ত। এই আধুনিক প্রযুক্তির যুগে ইন্টারনেট ছাড়া কোনো কিছুই সম্ভব না। গত কয়েদিনের ব্লাকআউটে দেশের ফ্রিল্যান্সাররা চরমভাবে ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন, আমাদের জানামতে হাজার হাজার ফ্রিল্যান্সার তাদের গ্রাহক হারিয়েছে। সময়মত কাজ জমা না দিতে পারায় মার্কেটপ্লেসে তাদের রেটিং নেমে গেছে। এটা ফিরিয়ে আনা অনেকের ক্ষেত্রে অসম্ভব বা খুবই কষ্টসাধ্য। অন্যদিকে বিদেশিরাও বাংলাদেশী ফ্রিল্যান্সারদের কাজ দিতে ভরসা পাচ্ছেনা। অনেক ফ্রিল্যান্স এজেন্সির সঙ্গে বায়াররা চুক্তি বাতিল করে দিচ্ছে। বছরের পর বছর কাজ করে দেশের লাখ লাখ ফ্রিল্যান্সার একটি টেকসই বাজার তৈরি করেছিলেন, বেকারত্ব ঘুচিয়েছিলে—সেটি এক পলকেই নিঃশেষ করে দিয়েছে ইন্টারনেট ব্লকআউট।’