নিকোটিনের সঙ্গে বিভিন্ন ফলের গন্ধ বা ফ্লেভার মিশিয়ে তৈরি করা হয় ই-সিগারেটের উপাদান পানীয় তামাক (ভেপ)। এই নানা স্বাদের পানীয় তামাকের কারণে অনেকে সহজেই আকৃষ্ট হচ্ছেন ক্ষতিকর ই-সিগারেটে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ই-সিগারেট গ্রহণের হার বাড়ছে। ফলে হৃদরোগসহ বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন তাঁরা। রিচার্জ করা যায় এমন ব্যাটারিচালিত এসব যন্ত্র সিগারেটের মূল উপাদান নিকোটিন সেবনের জন্য ব্যবহৃত হয় বলে এগুলোকে সাধারণভাবে ইলেকট্রনিক সিগারেট বা ই-সিগারেট বলা হয়।
রাজধানীর অভিজাত এলাকার বিভিন্ন দোকানের পাশাপাশি বর্তমানে অনলাইনে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজে দেদার বিক্রি হচ্ছে ক্ষতিকর ই-সিগারেট। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বর্তমানে তরুণ-তরুণীরা ধূমপান শুরুই করছেন ই-সিগারেট দিয়ে। শখ করে ই-সিগারেট নিতে গিয়ে পরে পুরোদস্তুর ধূমপায়ী হয়ে উঠছেন। কারণ, সাধারণ সিগারেটের বিকল্প হিসেবে ই-সিগারেট বাজারজাত করা হলেও এটি আসলে একটি নেশা সৃষ্টিকারী পণ্য।
বিভিন্ন গবেষণার তথ্য এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ই-সিগারেট বা ভেপে নিকোটিনের পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ থাকায় এই পণ্য সাধারণ সিগারেটের চেয়ে বেশি ভয়ংকর প্রমাণিত হয়েছে। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ বিভাগের গবেষণার তথ্য হলো, এরই মধ্যে এ দ্রব্যের ক্ষতিকর দিক বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বের ১০৯টি দেশ ই-সিগারেট নিষিদ্ধ এবং নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এসব রাষ্ট্রের মধ্যে আমাদের প্রতিবেশী ভারত ও নেপালও রয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি ই-সিগারেটের ক্ষতি বিবেচনায় নিয়ে অস্ট্রেলিয়া সরকার ভেপিং বা ই-সিগারেট আমদানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে।
শুধু ই-সিগারেট বিক্রির জন্যই অনেকে ওয়েবসাইট খুলেছেন। অনলাইনে বিভিন্ন সুবিধায় দোকানের চেয়ে কম দামে বিক্রি এবং বাসায় পৌঁছে দেওয়ার সুবিধাও দেন তাঁরা। যেহেতু তরুণেরাই অনলাইন বাজারের প্রধান ক্রেতা, ফলে দেশের যেকোনো জায়গায় বসে তাঁরা কিনতে পারেন, যা মূলত ই-সিগারেটকে সহজলভ্য করে তুলছে।
দ্য ভেপক্যাফে ডটকম ও ভেপারওয়ার্ল্ডবিডি ডটকমে শুধু ই-সিগারেট বিক্রি করা হয়। সেখানে একেকটি ই-সিগারেটের দাম তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা লেখা রয়েছে। ফেসবুকে পেজ খুলেও বিক্রি হচ্ছে ই-সিগারেট। ফেসবুকের পেজগুলোর মধ্যে রয়েছে অনলাইন ভেপ শপ বিডি, ভেপ বিডি, ই-ক্লাউড ভেপ শপ বিডি ইত্যাদি।
দ্য ভেপক্যাফে ডটকমের ওয়েবসাইটে দেওয়া মুঠোফোন নম্বরে ফোন করা হলে এক প্রতিনিধি বলেন, ক্রেতা ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে তাঁরা কথা বলবেন না। ই-সিগারেটের মতো ক্ষতিকর পণ্য বিক্রির অনুমোদন তাঁদের আছে কি না, এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কারও নাম বা ফোন নম্বর দিতে অপারগতা প্রকাশ করে ই-মেইল করতে বলেন। এরপর প্রতিষ্ঠানটির ই-মেইলে মেইল পাঠানো হলে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির সভাপতি ও ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘কম ক্ষতিকর’ উপমা ব্যবহার করে তামাক কোম্পানিগুলো তরুণ-তরুণী এবং ধূমপায়ী ব্যক্তিদের ই-সিগারেটের প্রতি আকৃষ্ট করছে। ই-সিগারেট কম ক্ষতিকর নয়, বরং খুবই ক্ষতিকর একটি পণ্য। ই-সিগারেটের ব্যবহার ও বাজারজাতকরণের জন্য কোম্পানিগুলো ভেপিং উৎসবের আয়োজন করছে, যা যুব সমাজকে নতুনভাবে অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। একই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী ই-সিগারেটের পক্ষে বিভিন্ন মিথ্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিচালিত জরিপের তথ্যের বরাত দিয়ে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট জানায়, ই-সিগারেটের ব্যবহার কিশোর-তরুণদের ধূমপানের প্রবণতা দুই থেকে ছয় গুণ বাড়িয়ে দেয়। অধিকাংশ ই-সিগারেট ব্যবহারকারী একই সঙ্গে ধূমপানও করে থাকেন। এই দ্বিমুখী ব্যবহার ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনে। শুধু ধূমপায়ীদের তুলনায় এমন দ্বৈত ব্যবহারকারীদের হৃদ্রোগের ঝুঁকি ৫০০ শতাংশ বেশি।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সোহেল রেজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ই-সিগারেটে নিকোটিনের সঙ্গে প্রোপেলিন গ্লাইসল, গ্লিসারিনসহ বিভিন্ন রকম গন্ধ বা ফ্লেভার ব্যবহার করা হয়। নিকোটিনের কারণে আসক্তি হয়। যেহেতু ই-সিগারেটেও নিকোটিন ব্যবহার করা হয়, তাই এটিও আসক্তি বাড়ায়। তরুণ-তরুণীরা ই-সিগারেট গ্রহণ করায় এখন কম বয়সে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। কেউ যদি সিগারেট ছাড়তে চান, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে ধূমপান ছাড়ার বিষয়ে বিনা মূল্যে কাউন্সেলিং ও চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। এখান থেকেও বিনা মূল্যে পরামর্শ নিতে পারেন।
আমেরিকান স্ট্রোক অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, ই-সিগারেটে সুগন্ধ যুক্তকারী উপাদান ব্যবহারের কারণে শ্বাসতন্ত্র, যকৃত ও কিডনির দীর্ঘমেয়াদি রোগের ঝুঁকি বাড়ে। ই-সিগারেটে কণ্ঠনালির ঝুঁকি বাড়ে ৫৯ শতাংশ। এ ছাড়া ই-সিগারেটের নিকোটিন গর্ভজাত শিশুর মেধা বিকাশ ও গর্ভবতী মায়েদের জন্যও বিপজ্জনক।
তামাক নিয়ন্ত্রণে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডসের 'ইলেকট্রনিক সিগারেট অ্যান্ড হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টস' শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ই-সিগারেট ব্যবহারে স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ বিশ্বের ২৩টি দেশে ই-সিগারেটের বিক্রি নিষিদ্ধ ও ৪৯টি দেশে কঠোর নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ-সংক্রান্ত কোনো আইন নেই। অনলাইনে ই-সিগারেট বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় এটির ভয়াবহতা বিবেচনা করে গত ১৯ জুলাই ভারত সরকার ই-সিগারেট বিক্রেতা ১৫টি ওয়েবসাইটকে নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশেও অনলাইন বাজারগুলোয় ই-সিগারেট বিপণন ও বিজ্ঞাপন প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞার দাবি জানিয়েছে ধূমপান রোধে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলো।
ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস বাংলাদেশের অ্যাডভোকেসি ম্যানেজার মো. আতাউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যমান ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য (ব্যবহার) নিয়ন্ত্রণ আইনে ২০০৫ (সংশোধিত ২০১৩) ই-সিগারেট নিয়ে কিছু বলা হয়নি। কারণ, এই ক্ষতিকর পণ্য আইন করার পর মিথ্যা তথ্য দিয়ে বাজারে আনা হয়েছে। ফলে এ–সম্পর্কিত কোনো বিষয় আইনে উল্লেখিত নেই। আর এরই সুযোগ নিচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো। তাই বিদ্যমান আইনটি হালনাগাদ করে বৈশ্বিক মানদণ্ডে উন্নীত করার লক্ষ্যে এখনই সংশোধন করা এবং ই-সিগারেট উৎপাদন, আমদানি ও রপ্তানি বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। নইলে অনলাইনে ই-সিগারেট বিক্রি আরও বাড়বে এবং তরুণ-তরুণীরা বেশি আসক্ত হয়ে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বেন।