ইউসুফ আহমেদ
ইউসুফ আহমেদ

তীব্র হতাশা কাটিয়ে নরসিংদীর ইউসুফ এখন সফল ফ্রিল্যান্সার

‘মনে মনে পরিকল্পনা করেই ফেলেছিলাম আত্মহত্যা করব। একটি পথই তখন আমার সামনে খোলা। একের পর এক ঘটনা এমন হতাশায় ঠেলে দিয়েছিল, আমার বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাই মরে গিয়েছিল।’ কয়েক বছর আগে নিজেকে ধ্বংস করার এমন ভয়ংকর ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছিল ইউসুফ আহমেদের মাথায়। সেই ইউসুফই এখন সফল একজন মানুষ। ফ্রিল্যান্সিং তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছে জীবনের গতি।

ইউসুফ থাকেন নরসিংদীর মাধবদীতে, পড়াশোনা করেছেন নরসিংদী সরকারি কলেজে। এইচএসসি পরীক্ষার আগে তাঁর জীবনে ঝড় নেমে আসে। ইউসুফের বাবা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাবাকে নিয়ে ব্যস্ত, তাই পড়াশোনায় ঠিকমতো মনোযোগ দিতে পারেননি ইউসুফ। ২০১৬ সালে এইচএসসি পরীক্ষার কিছুদিন আগে ইউসুফের বাবা মারা যান।

সে বছর পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন ইউসুফ। ভেঙে যায় মনোবল, তবু সাহস জুগিয়ে পরীক্ষা দেন ২০১৭ সালে। উত্তীর্ণ হলেও ফলাফল ভালো হয়নি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষাও দিতে পারেননি। এদিকে তিন ভাই, এক বোনের মধ্যে সবার বড় ইউসুফ। মাসহ পরিবারের পাঁচজন তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।

যেখানে ইউসুফ নিজের খরচ চালাতেই হিমশিম খাচ্ছেন, সেখানে পুরো পরিবারের দায়িত্ব কীভাবে নেবেন? এই চিন্তা তাঁকে ঠেলে দেয় হতাশার দিকে। একসময় মনে হয় কোনো কিছু তাঁকে দিয়ে হচ্ছে না, আর হবেও না। পরিবার থেকে তেমন চাপ না দেওয়া হলেও পরিস্থিতি তাঁকে চাকরির ভাবনা থেকে মুক্ত হতে দেয়নি।

বিনা মূল্যে ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন ইউসুফ আহমেদ

এইচএসসির সনদ দিয়ে কোনো ভালো কাজ পাচ্ছিলেন না ইউসুফ আহমেদ। চাকরির জন্য অনেক ছোটাছুটি করেছেন, অনেকের দ্বারস্তও হয়েছেন। আশ্বাস পেলেও কোনো চাকরি পাননি ইউসুফ। পরে একটি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। পাশাপাশি গৃহশিক্ষকতাও (টিউশনি) করতে থাকেন।

এ সময় সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন দেখেন। নিজেই প্রস্তুতি নিতে থাকেন। কেটে যায় বেশ কটি বছর। ২০২০ সালে আবারও জীবন থমকে যায়। একটা সড়ক দুর্ঘটনায় বাঁ হাত ভেঙে যায় ইউসুফের। টাকার অভাবে চিকিৎসাও ঠিকমতো করাতে পারেননি। সাত মাস পুরো বিশ্রামে থাকতে হয়। সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায় এই দুর্ঘটনার পর।

নানা রকম হতাশা ভর করে ইউসুফের ওপর। আত্মহননের সিদ্ধান্ত নেন। হতাশা, বিষণ্নতা যখন তীব্র—হঠাৎ করেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইউসুফের চোখে পড়ে বন্ধু সোহাগ মিয়ার সাফল্যের গল্প, মোশন গ্রাফিকসে দক্ষ সোহাগ ফ্রিল্যান্সিং করেন। তখনই ইউসুফ জানতে পারলেন ফ্রিল্যান্সিং করে উপার্জন করা যায়।

সোহাগের গল্প জেনে ইউসুফের মাথায় ঢুকে যায় ঘরে বসে টাকা আয়ের বিষয়টি। আরও ভালো করে জানার জন্য ইউসুফ ক্রিয়েটিভ আইটি নামের একটি ফেসবুক পেজে ঢুঁ মারেন। বিস্তারিত জানার পরেই অনুপ্রাণিত হন। হতাশা ঝেড়ে ফেলে স্থির করে ফেলেন তাঁর লক্ষ্য। ফ্রিল্যান্সিং করার মতো বিষয় শিখবেন। তখনো তাঁর ডান হাত সারেনি। ইউসুফ বলেন, ‘বাঁ হাতে আর কিছু করতে না পারলেও মাউস তো চালাতে পারব।’

এই ভাবনা থেকেই ২০২০ সালে নতুনভাবে ইউসুফের পথচলা শুরু। ঢাকায় থাকাখাওয়া আর প্রশিক্ষণ নেওয়ার খরচ চালানো বেশ কঠিন। এক বন্ধুর কাছ থেকে ২০০ টাকা নিয়ে ঢাকায় আসেন ইউসুফ। শেখার ব্যাপারে খোঁজখবর নেন। কিন্তু কোর্স ফি দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। এত টাকা কীভাবে দেবেন ইউসুফ। চেষ্টা করে ফিয়ের টাকা ব্যবস্থা করলেন। ভর্তি হলেন ক্রিয়েটিভ আইটি ইনস্টিটিউটে। ছয় মাসের গ্রাফিক ডিজাইন কোর্স শুরু করলেন। নরসিংদী থেকে যাতায়াতে দিনের প্রায় অর্ধেকটা সময় চলে যেত। দিনের পর দিন দুপুরে না খেয়েই কাটাতেন। ইউসুফ বলেন, ‘একটু কষ্ট হতো, তবু ক্লাস ও ক্লাস প্রজেক্ট করতাম নিয়মিত। রাতের পর রাত কাজ করে যেতাম। মাথায় শুধু ঘুরত আমাকে কিছু করতে হবে।’ গ্রাফিক ডিজাইনে কোর্সের পর শিখলেন মোশন গ্রাফিকস। এরপর একটা সময় পরিচিতদের মাধ্যমে কাজ পেতে থাকেন। তিনটি বিজনেস কার্ড ডিজাইন করে ইউসুফ প্রথম ১৭ ডলার আয় করেন। এরপর আর তাঁকে পেছনে তাকাতে হয়নি।

ইউসুফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসলে আত্মহত্যা কখনো কোনো সমাধান হতে পারে না। যদি আমরা নিজেদের দক্ষতা বাড়াতে পারি, তবে কাজের অভাব হবে না। কাজ জানলে কাজ পাওয়া কঠিন নয়। আমি একসময় আট হাজার টাকার চাকরির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি, ছটফট করছি, কিন্তু সেই পরে ৩০ হাজার টাকার চাকরিও ফিরিয়ে দিয়েছি। দক্ষতার কারণেই এখন আমাকে অনেকে ডেকে চাকরি দিতে চান।’

ইউসুফ তাঁর পরিবার নিয়ে এখন ভালো আছেন। বাইরের একটি প্রতিষ্ঠানের কাজ করছেন। অনলাইন মার্কেটপ্লেসের কাজ তো আছেই। গ্রাফিক ডিজাইন, মোশন গ্রাফিকস, অ্যানিমেশন, ওয়েব ব্যানার ইত্যাদির কাজই করেন বেশি। ইউসুফ বলেন, ‘মাসে এখন গড়ে ৪০ হাজার টাকা আয় হয়। আমি এতেই খুশি। নরসিংদীতে তরুণদের শেখানোর উদ্যোগ নিয়েছি।’

নরসিংদীর মাধবদীতে নিজের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করেছেন ইউসুফ। নাম ফ্রিল্যান্সার আইটি ইনস্টিটিউট। সেখানে ইউসুফ ৩০ জন ছাত্রী, ১৫ জন হাফেজ এবং ৫ জন সাধারণ শিক্ষার্থীকে ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন বিনা মূল্যে। ইউসুফের স্বপ্ন, নিজের উন্নয়নের পাশাপাশি বেকার ছেলেমেয়েদের দক্ষ করে তোলা।