২৮ ডিসেম্বর রাজধানীর উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত দেশের প্রথম মেট্রোরেল চালু হচ্ছে। এর মাধ্যমে ঢাকাবাসী অনেক ‘প্রথম’-এর দেখা পাবে। এই মেট্রোরেল হচ্ছে দেশের প্রথম সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ-চালিত ট্রেন। এই ট্রেনের চলাচল হবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। মেট্রোরেলের টিকিট পুরোপুরিই কম্পিউটারাইজড।
ব্যাপারটা এমন, উত্তরার দিয়াবাড়িতে ডিপোয় একটি অপারেশন কন্ট্রোল সেন্টার (ওসিসি) স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে ট্রেন কোথায় কোথায় থামবে, কত সময় থামবে, কত গতিতে চলবে—এর সবই আগে থেকে নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। এর বাইরে রেললাইনের প্রতি ২০০ থেকে ৩০০ মিটার পরপর রেডিও অ্যানটেনা স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি ট্রেনে আছে চারটি করে অ্যানটেনা। প্রতিটি অ্যানটেনা ট্রেন ও কন্ট্রোল সেন্টারের (নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র) সঙ্গে যোগাযোগ করবে। স্টেশনে এসে ট্রেন যেখানে থামার কথা, এর চেয়ে ছয় ইঞ্চিও এদিক-ওদিক হতে পারবে না। তাহলে ট্রেনের দরজা ও প্ল্যাটফর্মের দরজা বরাবর হবে না।
ট্রেন পরিচালনার জন্য একজন চালক (অপারেটর) এবং স্টেশনে একজন নিয়ন্ত্রক (কন্ট্রোলার) থাকবেন। পাশাপাশি ওসিসিতে থাকবেন কর্মকর্তারা। সবার কাজ মূলত পর্যবেক্ষণ করা, নির্দেশনা ঠিকমতো কাজ করছে কি না, তা দেখা।
মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত পথটি লাইন-৬ নামে পরিচিত। এ পথের দৈর্ঘ্য ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১৬টি স্টেশন থাকছে। লাইন-৬-এর দুটি ভাগ: উত্তরা থেকে আগারগাঁও এবং আগারগাঁও থেকে মতিঝিল। এর মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চালু হবে ২৮ ডিসেম্বর। এ পথে স্টেশন আছে ৯টি।
প্রায় ৩৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে সরকার মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকা।
মেট্রোরেল চালাতে ১৭ থেকে ১৮টি ব্যবস্থা সমন্বিতভাবে কাজ করবে। এর মধ্যে মোটাদাগে যেগুলো লাগে, সেগুলো হচ্ছে ডিপোর অবকাঠামো, বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা ও যন্ত্রপাতি। এর বাইরে প্রতিটি স্টেশনে আছে লিফট, চলন্ত সিঁড়ি, স্বয়ংক্রিয় ভাড়া আদায় ব্যবস্থাপনা ও টেলিযোগাযোগ–ব্যবস্থা। বিদ্যুৎ-চালিত এ ট্রেনের জন্য লাইনের দুই পাশে খুঁটি বসানো ও ওপরে তার টানা হয়েছে।
ট্রেনে ওঠার একমাত্র পথ স্টেশন ভবন। স্টেশনগুলো তিনতলা। সড়ক থেকে লিফট, এস্কেলেটর ও সিঁড়ি দিয়ে যাত্রীরা দ্বিতীয় তলার কনকোর্স হলে উঠবেন। এই তলায় টিকিট কাটার ব্যবস্থা, অফিস ও নানা যন্ত্রপাতি আছে। তৃতীয় তলায় রেললাইন ও প্ল্যাটফর্ম। একমাত্র টিকিটধারী ব্যক্তিরাই ওই তলায় যেতে পারবেন। দুর্ঘটনা এড়াতে ট্রেনলাইনের পাশে বেড়া থাকবে। স্টেশনে ট্রেন থামার পর বেড়া ও ট্রেনের দরজা একসঙ্গে খুলে যাবে। আবার নির্দিষ্ট সময় পর তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হবে।
মেট্রোরেলের ট্রেন প্রতিটি স্টেশন থেকে পাঁচ মিনিট পরপর ছাড়বে। এক ট্রেনের সঙ্গে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখার কাজটি কেন্দ্রীয়ভাবে সফটওয়্যারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে বা লাইনে কোনো বাধা থাকলে ট্রেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে থেমে যাবে।
মেট্রোরেল উত্তরা থেকে আগারগাঁও যাতায়াতে ১৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ লাগবে বলে হিসাব করেছে কর্তৃপক্ষ। এই ট্রেন চলাচলের জন্য নিজস্ব বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এর জন্য উত্তরার ডিপোয় সাবস্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। মতিঝিলে আরেকটি স্থাপনের কাজ চলছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিটি সাবস্টেশনে দুটি ট্রান্সফরমার থাকবে। একটি বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে এবং অন্যটি জরুরি প্রয়োজনে চালু হবে। অর্থাৎ কোথাও বিদ্যুৎ–বিভ্রাট হলেও ট্রেন চলাচল বন্ধ হবে না। জাতীয় গ্রিড বিপর্যয় হলেও ব্যাটারির মাধ্যমে চলমান ট্রেনগুলো নিকটবর্তী স্টেশনে পৌঁছাতে পারবে।
মেট্রোরেলের প্রতি ট্রেনে ছয়টি কোচ বা বগি থাকছে। দুই প্রান্তের দুটি কোচকে বলা হচ্ছে ট্রেইলর কার। এতে চালক থাকবেন। এসব কোচে ৪৮ জন করে যাত্রীও বসতে পারবেন। মাঝখানের চারটি কোচ হচ্ছে মোটরকার। এর প্রতিটিতে বসার ব্যবস্থা আছে ৫৪ জনের। সব মিলিয়ে একটি ট্রেনে বসে যেতে পারবেন ৩০৬ জন। প্রতিটি কোচ সাড়ে নয় ফুট চওড়া। মাঝখানের প্রশস্ত জায়গায় যাত্রীরা দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করবেন। দাঁড়ানো যাত্রীদের ধরার জন্য ওপরে হাতল এবং স্থানে স্থানে খুঁটি আছে। সব মিলিয়ে একটি ট্রেনে বসে ও দাঁড়িয়ে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৩০৮ যাত্রী ভ্রমণ করতে পারবেন। সম্পূর্ণ শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (এসি) এই ট্রেনের দুই পাশে সবুজ রঙের দুই সারি লম্বা আসন পাতা হয়েছে।
প্রতিটি কোচের দুই পাশে চারটি করে আটটি দরজা আছে। অর্থাৎ ট্রেন স্টেশনে থামলে চারটি দরজা একসঙ্গে খুলে যাবে। বাকি চারটি বন্ধ থাকবে। পরবর্তী গন্তব্য সম্পর্কে থাকবে অডিও-ভিজ্যুয়াল ঘোষণা। দুই প্রান্তের দুটি কোচে দুটি করে চারটি হুইলচেয়ার বসানোর ব্যবস্থা আছে।
প্রতিটি ট্রেনের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার। তবে ট্রেন কোন স্থানে কত গতিতে চলবে, সেটা ঠিক করবে কর্তৃপক্ষ। ট্রেনের নকশা প্রণয়ন ও তৈরির কাজ করছে জাপানের কাওয়াসাকি-মিতসুবিশি কনসোর্টিয়াম।
মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনা করছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। কোম্পানি সূত্র জানিয়েছে, সাপ্তাহিক, মাসিক বা পারিবারিক কার্ড আগে থেকে কিনতে হবে। মেট্রোরেলের প্রতিটি স্টেশনে থাকা যন্ত্রে কার্ডে টাকা ভরা (রিচার্জ) যাবে। পরবর্তী সময়ে মুঠোফোনে রিচার্জের মতো করে যেকোনো জায়গা থেকে কার্ড রিচার্জের ব্যবস্থা চালু করা হবে।
প্ল্যাটফর্মে ঢোকার সময় যাত্রীদের কার্ড পাঞ্চ করতে হবে, তা না হলে দরজা খুলবে না। এরপর নেমে যাওয়ার সময় আবার কার্ড পাঞ্চ করতে হবে, তা না হলে যাত্রী বের হতে পারবেন না।
আরেকটি কার্ড সাময়িক, যা প্রতি যাত্রায় দেওয়া হবে। এটাকে সিঙ্গেল জার্নি টিকিটও বলা হয়। স্টেশন থেকে নির্দিষ্ট গন্তব্যের ভাড়া দিয়ে এ কার্ড সংগ্রহ করতে হবে। এটিও স্মার্ট কার্ডের মতো। ভাড়ার অতিরিক্ত যাতায়াত করলে ওই কার্ড দিয়ে দরজা খুলতে পারবেন না। সে ক্ষেত্রে দায়িত্বে থাকা কর্মীদের কাছে বাড়তি ভাড়া পরিশোধ করেই বের হতে হবে।
মেট্রোরেল দেশে আসার পর উত্তরায় ডিপোতে প্রতিটির ১৯ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়। এরপর হয়েছে আরেক ধাপের পরীক্ষামূলক চলাচল (ট্রায়াল রান)। প্রথমে উত্তরা থেকে পল্লবী, পরে আগারগাঁও পর্যন্ত তা চলাচল করে। যাত্রীসহ বাণিজ্যিকভাবে চলাচলের সময় যে গতিতে এবং যেসব নিয়ম মেনে চলাচল করার কথা, ঠিক সেভাবে ট্রায়াল রান করা হয়।