অনেক কষ্টের পর ফ্রিল্যান্সিংয়ে সফল মেয়েটি

তানজিম রহমান
তানজিম রহমান

অভাবের সংসারে চার সন্তানের পড়াশোনার খরচ জোগানো কষ্টকর ছিল বাবার জন্য। তাই বাবা তাঁর মেয়ে তানজিম রহমানকে পরামর্শ দেন উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞানের বদলে মানবিক বিভাগে ভর্তি হতে। কিন্তু তানজিমের ইচ্ছা বিজ্ঞানে পড়ার। তিনি ঠিক করেন পড়াশোনার খরচ নিজেই জোগাড় করবেন। তখন থেকেই উপার্জন করার কথা ভাবছেন তানজিম। 

তানজিম রহমান মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার গড়পাড়া ইউনিয়নের চানদুইর গ্রামে থাকেন। এখন তিনি মানিকগঞ্জের সরকারি দেবেন্দ্র কলেজে উদ্ভিদবিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক (সম্মান) তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। একই সঙ্গে মুক্ত পেশাজীবী বা ফ্রিল্যান্সার হিসেবে নিয়মিত কাজ করছেন তিনি। মানিকগঞ্জে বসেই তাঁর আয় প্রতি মাসে গড়ে দুই লাখ টাকা।

কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় চার–পাঁচজন ছাত্র পড়িয়ে পড়াশোনার খরচ জোগাড় করেছেন তানজিম। চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা সময় চলে যেত পড়াতে। মাসে আয় করতেন পাঁচ হাজার টাকার মতো। উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর চাকরির চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু পাননি। স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে পরিবারে আর্থিক সহায়তা করার কথা ভাবেন তিনি। কিন্তু কীভাবে? তানজিম রহমান বলেন, ‘সেই সময়টা আমি ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। ফেসবুক ও ইউটিউবে অনেক খোঁজাখুঁজির পর জানতে পারি, যা এখন আমার জীবন বদলে দিয়েছে।’

২০২০ সালে ফ্রিল্যান্সিংয়ের বিষয়ে দক্ষ হতে কিছু প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নেন তানজিম। কিন্তু কোর্স ফি ছিল তাঁর সামর্থ্যের বাইরে। তখন তাঁর শিক্ষক মোহাম্মদ রমজান আলী লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পে (এলইডিপি) ভর্তি হতে বলেন। দক্ষ ফ্রিল্যান্সার গড়ে তুলতে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ তখন এই প্রকল্প চালাত। 

তানজিম এলইডিপির একটা কোর্সে ভর্তি হন। ভর্তি হয়েও অবশ্য কোর্স সম্পন্ন করতে পারেননি। কেননা, তাঁর নিজের কম্পিউটার ছিল না। বাবারও সামর্থ্য ছিল না কম্পিউটার কিনে দেওয়ার। তানজিম বলেন, ‘আমি বাবাকে অনেকবার বলি। কিন্তু মুদিদোকান চালিয়ে সংসার ও সবার পড়াশোনার খরচ দিয়ে কম্পিউটার কেনার সামর্থ্য তাঁর ছিল না। আমার বাবা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হওয়ায় শুধু দোকানটাই কোনোরকমে চালাতে পারেন।’

তানজিম আবার টিউশনি শুরু করেন। লক্ষ্য নিজের জন্য কম্পিউটার কেনা। ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে মাসে ৯ হাজার টাকা আয় করতেন। এক বছর পর ২০২১ সালে ৪২ হাজার টাকা দিয়ে একটা কম্পিউটার কেনেন। কেনার পর নতুন সমস্যায় পড়েন। তানজিম বলেন, ‘আমার পরিবারের কেউ তথ্যপ্রযুক্তি, ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে কিছুই বুঝতেন না। সবাই আমাকে বলতেন, কম্পিউটার কিনে আমি ভুল করছি। কিন্তু এমন অসহযোগিতা আমাকে থামাতে পারেনি।’

কম্পিউটার কেনার পর তানজিম আবার চেষ্টা করেন এলইডিপির প্রশিক্ষণ নিতে। কিন্তু তত দিনে সেই প্রকল্প শেষ হয়ে গেছে। এরপর ১২ হাজার ৭০০ টাকা ফি দিয়ে একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কোর্স করেন। তবে সেটিতে উল্লেখ করার মতো কিছু শিখতে পারেননি। একটা সংস্থা থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নেন তানজিম। সেই টাকায় আবার বেসরকারি আরেকটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন। শিখতে থাকলেন তথ্যপ্রযুক্তির কিছু কাজ। কিন্তু সমস্যা পিছু ছাড়ে না। গ্রামে তারহীন ওয়াই–ফাই সংযোগের ইন্টারনেট ধীরগতির। সেটা দিয়ে শুধু ফেসবুক আর ইউটিউব চালানো যায়। অনলাইনে ক্লাস করার সময় ঘণ্টায় অন্তত দশবার সংযোগ কেটে যেত। তারপরও কোর্স সম্পন্ন করেন তিনি।

এদিকে করোনাকালের পর তানজিমের টিউশনি চলে যায়। তখন সিদ্ধান্ত নেন সার্বক্ষণিক ফ্রিল্যান্সিং করবেন। প্রথম কাজেই আয় করেন ১০ ডলার, সঙ্গে ৫ ডলার বকশিশ পান। বিদেশের এই গ্রাহক খুশি হয়ে তাঁকে পাঁচ তারকা ‘ফিডব্যাক’ দেন। আত্মবিশ্বাস পান তানজিম। প্রথম দিকে প্রাথমিক কাজগুলো করে মাসে ১৫০ থেকে ২০০ মার্কিন ডলার আয় করতেন তানজিম। এই কাজ করতে করতে তিনি সিদ্ধান্ত নেন আরেকটু উচ্চ স্তরের কাজ করবেন। সেই লক্ষ্য সামনে রেখে একটি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের অনলাইন কোর্সে ভর্তি হন তিনি। তানজিম বলেন, ‘সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত কোর্স করা, ভিডিও দেখা ও চর্চার পেছনে সময় দিতাম। রাতের ঘুম ভুলেই গিয়েছিলাম। নিজের দক্ষতা বাড়াতাম শুধু।’

তানজিম রহমান সাত বছরের পরিচিত দেওয়ান সালাউদ্দীনকে বিয়ে করেন ২০২২ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সালাউদ্দীন বাংলাদেশ পুলিশের একজন কনস্টেবল। তানজিম বলেন, ‘সালাউদ্দীন আমাকে প্রথম থেকেই সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। সেই সাত বছর আগে থেকেই। তিনি আমাকে বলেছেন কষ্ট হলেও ফ্রিল্যান্সিং করো। ভালো কিছু করতে পারবে।’ সেই চেষ্টাতেই পড়াশোনার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং সফলভাবে করে যাচ্ছেন তানজিম রহমান।

মানিকগঞ্জে বাবার সঙ্গে তানজিম রহমান

বর্তমানে ইন্টারনেটে ফ্রিল্যান্সার কাজ দেওয়া–নেওয়ার ওয়েবসাইট ফাইভআরে কাজ করছেন তানজিম। তাঁর কাজের ক্ষেত্র ডিজিটাল বিপণন। আরও নির্দিষ্ট করে বললে ফেসবুক ও গুগলের বিজ্ঞাপন নিয়ে তিনি কাজ করেন। প্রতি মাসে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ডলার আয় করেন। এর বাইরে মানিকগঞ্জে বসে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার দুটো কোম্পানির জন্যও কাজ করেন তিনি। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তানজিম বলেন, ‘একটা দল গঠন করতে চাই। সেই দল থেকে অন্তত দশজন যেন আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে পারে এবং পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারে।’

পিতা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সাহিনুর রহমান ও মা গৃহিণী শিল্পী বেগমের চার ছেলেমেয়ের মধ্যে তানজিম রহমান দ্বিতীয়। তানজিমের বড় বোন ফাতেমা রহমান সরকারি দেবেন্দ্র কলেজে মাস্টার্স স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পড়ছেন। ছোট বোন শাকিলা রহমান মানিকগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে এবং ছোট ভাই তৈয়বুর রহমান ২০২৪ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী।

সংসারে মেয়ে তানজিমের সহায়তায় বেশ খুশি বাবা সাহিনুর রহমান। প্রথম আলোকে মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘আসলে আমি তো আমার মেয়েকে একটু সাপোর্ট দিয়েছি, বাকিটা সে কষ্ট করে করেছে। অনেক কষ্ট করেছে মেয়েটা আমার। আমি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষ, মুদিদোকান চালিয়ে যতটুকু পেরেছি চার ছেলেমেয়েকে মানুষ করার চেষ্টা করেছি। এখন আমি আনন্দিত, বলতে পারি সুখে আছি, ভালো আছি।’

কাজের জন্য তানজিম থাকেন মানিকগঞ্জেই। তবে স্বামীর বর্তমান কর্মস্থল টাঙ্গাইলেও যাওয়া–আসা করেন।