আবদুস সালাম (ছদ্মনাম) অফিসের কাজে ব্যস্ত। হঠাৎ তাঁর ফোন বেজে উঠল, ‘হ্যালো, কে বলছেন?’ ওপাশ থেকে কোনো উত্তর নেই। কয়েক সেকেন্ড পর ফোন কেটে গেল। আবদুস সালাম বিষয়টি গুরুত্ব দিলেন না। কিছুক্ষণ পর আবারও একই নম্বর থেকে ফোন আসতে শুরু করল, পাঁচটি মিসড কল। সালাম ফোন (কল ব্যাক) করলেন। ওপাশ থেকে অপরিচিত গলা, ‘এটা কি নাইম স্যারের নম্বর?’
‘না। রং নাম্বার’, সালাম বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে দিলেন। এরপর দিনের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নম্বর থেকে ফোন আসতে শুরু করল তাঁর ফোনে। প্রতিবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। সালাম সাহেব বুঝতে পারলেন তিনি প্রতারণামূলক বা স্ক্যাম কলের ফাঁদে পড়েছেন।
সাধারণত স্ক্যাম কল বলতে বোঝায় ফোনকলের মাধ্যমে প্রতারণা করা। যাঁরা এই কাজের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের বলা হয় স্ক্যামার। স্ক্যামার হতে পারেন এক বা একাধিক ব্যক্তি, কিছু ক্ষেত্রে বড় কোনো প্রতিষ্ঠানও জড়িত থাকতে পারে।
এই প্রতারক বা স্ক্যামারদের উদ্দেশ্য আলাদা। কিছু ক্ষেত্রে তাঁদের উদ্দেশ্য থাকে বড় অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করা। সম্প্রতি আমাদের দেশের অনেকেই স্ক্যামের শিকার হয়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা হারিয়েছেন। কিছু স্ক্যাম কলের উদ্দেশ্য থাকে মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলা, যেটা হয়েছে আবদুস সালামের সঙ্গে। দক্ষ স্ক্যামাররা হ্যাকিং করে ফোন বা কম্পিউটারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ক্ষতিসাধন করতে পারে। এতে ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের ঝুঁকি থাকে।
নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে এমনই এক প্রতিষ্ঠানের খোঁজ মেলে। প্রতিষ্ঠানটি ফোন করে একজন বৃদ্ধ নারীর কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে তাঁর ব্যাংক হিসাব (অ্যাকাউন্ট) হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এফবিআইয়ের ইন্টারনেট ক্রাইম কমপ্লেন সেন্টারের গবেষণা অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বিভিন্ন স্ক্যাম কলের মাধ্যমে ৩০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন স্ক্যামাররা।
বর্তমান সময়ে আলোচিত একটি বিশেষ ধরনের প্রতারণা হলো ‘ওয়ান রিং স্ক্যাম’। ফোনে অচেনা নম্বর থেকে কিছুক্ষণ পর পর মিসড কল এই প্রতারণার লক্ষণ। প্রতিবার আলাদা নম্বর থেকে কল দেওয়া হয়, ফলে নম্বর ব্লক করেও এই স্ক্যাম থেকে রেহাই পাওয়া যায় না। এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্ক্যামাররা বেশ কিছু নম্বর সংগ্রহ করে স্ক্যাম কল দিতে থাকেন। বিদেশের নম্বর থেকেও কল আসতে পারে। মিসড কল দেখে আবার কল করলে সেই কলের টাকা চলে যায় স্ক্যামারদের অ্যাকাউন্টে। এভাবে একাধিক ব্যক্তির কল থেকে বড় অঙ্কের টাকা পেয়ে যান স্ক্যামাররা।
অপরিচিত কারও নম্বরে ফিরতি কল না করাই হতে পারে এ ধরনের প্রতারণা মোকাবিলার উপায়। কিছু ফোনে অপরিচিত কল আসা বন্ধ করার ব্যবস্থা রয়েছে। কিছু স্ক্যাম কল সফটওয়্যারের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। প্রতারকদের বেশকিছু কল না ধরা হলে সফটওয়্যার মনে করে, নম্বরটি আর সক্রিয় নেই, সে ক্ষেত্রে স্ক্যাম কল আসা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
প্রতারণামূলক ফোনকলের মাধ্যমে তাঁরাই ক্ষতিগ্রস্ত হন বেশি, যাঁদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান কম। বিশেষ করে যাঁরা এ বিষয়ে অবগত নন, তাঁরাই এর বেশি শিকার। বিবিসির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মানুষ যে ব্যাপারে কম জ্ঞান রাখেন, সে ব্যাপারে প্রতারণা তৈরি হতে দেখা যায়। বয়স্কদের অনেকেরই আধুনিক প্রযুক্তি যেমন স্মার্টফোন ও কম্পিউটারের বিষয়ে জ্ঞান কম। তাঁরাই স্ক্যামারদের মূল শিকার।
২০১৭ সালে ইক্রাইমের এক গবেষণা অনুযায়ী, যাঁরা বৈশ্বিক ও প্রযুক্তিগত বিষয় সম্পর্কে অবগত থাকেন, তাঁরা প্রতারিত কম হন। পাশাপাশি কোনো কোনো অঞ্চলে স্ক্যাম প্রতিরোধে আইনি সহায়তা পাওয়া সহজ হলে সেখানে স্ক্যাম কমে যায়।
তেজগাঁও থানার পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) নিজাম উদ্দিন আহাম্মেদ বলেন, কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে নিশ্চিত হলে তাঁর উচিত কাছাকাছি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে রাখা। প্রয়োজনে তাঁর বিষয়টি অনুসন্ধানের জন্য সাইবার ক্রাইম দপ্তরে পাঠানো হতে পারে। তাঁরা দ্রুত বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখবেন।
তবে প্রতারণা বা স্ক্যাম প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ব্যক্তিগত সচেতনতা। যথার্থ প্রযুক্তিগত জ্ঞান থাকাই হতে পারে স্ক্যাম কল প্রতিরোধের প্রথম ধাপ।