স্ত্রীর সঙ্গে এস এম কামাল
স্ত্রীর সঙ্গে এস এম কামাল

দেশের আইসিটি খাতের মহানায়ক ছিলেন এস এম কামাল

বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি ও বেসিসের সাবেক সভাপতি এস এম কামাল ৭৮ বছর বয়সে ১৮ ডিসেম্বর মারা যান। দেশের তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসা খাত গড়ে তোলায় তাঁর ব্যাপক অবদান ছিল। এস এম কামালকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন তাঁর অনুজপ্রতিম বন্ধু ও বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সাবেক সভাপতি আবদুল্লাহ এইচ কাফি।

১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) শিল্পের দুঃখের দিন। বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো আইসিটি ব্যবসা খাতের সংগঠন বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির (বিসিএস) প্রতিষ্ঠাতাকালীন সভাপতি এস এম কামাল এই দিন আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।

আমি দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে দেশের আইসিটি শিল্পের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশের আইসিটি ব্যবসা খাতের ভিত্তি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে হাতে গোনা যে কয়জন মানুষ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, এস এম কামাল তাঁদের অন্যতম। তিনি আমাদের এই শিল্প খাতের মহানায়ক। এই শিল্পে যে দুজন মানুষের কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি এবং যে দুজন মানুষকে আমি দারুণভাবে সম্মান করতাম, তাঁদের একজন ছিলেন এস এম কামাল। তাঁর মৃত্যুতে আমি দারুণভাবে মর্মাহত। তাঁর মৃত্যুতে শুধু আইসিটি শিল্প খাত নয়, বাংলাদেশও একজন কৃতী সন্তানকে হারাল।

এস এম কামাল নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (আইবিএ) প্রথম ব্যাচে শীর্ষস্থান অর্জন করা ছাত্র। তাঁর শিক্ষাজীবন বড় বৈচিত্র্যময়। নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করে ভর্তি হয়েছিলেন প্রকৌশল বিষয়ে। দেড় বছরের মতো পড়েছিলেন। একদিন ক্রিকেট খেলতে গিয়ে একটা দুর্ঘটনার পর কামালের মা ভয় পেয়ে ছেলেকে প্রকৌশল পড়া থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। আর আসতে দেননি। পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

পরে তো জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) বিকমে ভর্তি হন। পরীক্ষার মাত্র এক-দু মাস আগে বই কিনে পড়াশোনা শুরু করেন। ওই এক-দু মাসের প্রস্তুতিতেই পরীক্ষায় পাস করেন। এরপর ঘটনাক্রমে আইবিএতে ভর্তি। সেখানেও প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষায় প্রতিটি বিষয়ে প্রায় ১০০ নম্বরই পেয়েছিলেন। ৪০০-এর মধ্যে তাঁর মোট নম্বর ছিল ৩৯৮.৫। নিজেই অবাক হয়েছিলেন নম্বর দেখে। একবার তো একটি পরীক্ষায় ৯১ পেলে পুরো ক্লাস তাঁকে সমবেদনা জানাতে চলে এসেছিল। বলেছিল, ‘তোমার তো ৯১ পাওয়ার কথা নয়, ১০০ পাওয়ার কথা।’

১৯৬৭ সাল থেকে এস এম কামাল তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কাজ করছেন। তিনি আইবিএমে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন এবং একপর্যায়ে বাংলাদেশে আইবিএমের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০–এর দশকে বাংলাদেশের আইসিটি শিল্প ছিল একেবারে ক্ষুদ্র আকারের। কম্পিউটার সম্পর্কে তখন সাধারণ মানুষ সেভাবে জানত না। আর সরকারি মহলে কম্পিউটার প্রযুক্তি নিয়ে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত ছিল। তারা মনে করতেন যে কম্পিউটারের মাধ্যমে দেশের তথ্য বিদেশে পাচার হয়ে যায়। ঠিক এ রকম একটা পরিবেশে ১৯৮৭ সালে এস এম কামালের নেতৃত্বে কয়েকজন মানুষ (যাঁদের মধ্যে আমিও ছিলাম) বাংলাদেশের কম্পিউটার শিল্প গড়ে তোলার দুঃসাহসিক কাজটি শুরু করেন।

তখন ছিল এরশাদ সরকারের শাসনামল। এস এম কামালের নেতৃত্বে কম্পিউটার ব্যবসায়ীরা সরকারের বিভিন্ন মহলের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করছিলেন। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছিল না। নানা মহল থেকে অনেক চাপ আসছিল, তবু এই মানুষেরা থেমে থাকেননি এবং এর মূলে ছিল এস এম কামালের শক্তিশালী নেতৃত্ব। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এস এম কামাল খুবই শক্ত হাতে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির নেতৃত্ব দেন। ১৯৯২ সালে বিসিএস নিবন্ধন লাভ করে।

এস এম কামালের (ডানে) সঙ্গে আবদুল্লাহ এইচ কাফি ও বেসিসের সাবেক সভাপতি এ তৌহিদ

নিবন্ধিত হওয়ার পর বিসিএসের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এস এম কামাল চাইলে বিসিএসের প্রেসিডেন্ট হিসেবে থেকে যেতে পারতেন এবং তাঁর ওপরে তখন কথা বলার কেউ ছিলেন না। কিন্তু সেসব কিছুই না করে তিনি প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে দাঁড়ান এবং নতুন নেতৃত্বের পথ সুগম করে দেন। শুধু বিসিএস নয়, ১৯৯৭ সালে যখন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) প্রতিষ্ঠিত হয়, এস এম কামাল তখন বেসিসের নির্বাহী কমিটির একজন সদস্য ছিলেন।

এস এম কামাল যেখানে হাত দিয়েছেন, সোনা ফলিয়েছেন। কাজী ফার্মসের একটি গল্প বলি। একরকম বাধ্য হয়ে কাজী ফার্মসের দায়িত্ব তাঁর হাতে সঁপেছিলেন মালিক কাজী জাহেদুল হাসান। এস এম কামাল সময়ের আগেই সব গুছিয়ে আনলেন। সব জঞ্জাল পরিষ্কার করলেন। তারপর কাজী সাহেবকে বললেন, তাঁর নিজের দায়িত্ব শেষ। এখন যেন কাজী সাহেব সব বুঝে নেন।

কাজী জাহেদুল হাসান তাঁকে বাসায় ডাকলেন। একসঙ্গে খেতে বসলেন। তখন কাজী সাহেবের স্ত্রী কামালকে বললেন, ‘কামাল, তোমাকে তো আমার খেতে দেওয়া উচিত না।’

কামাল অবাক হলে তিনি আবার বললেন, ‘তোমার ভাই আমাকে বিয়ের পর শুধু ফাঁকি দিয়েছে। কোথাও বেড়াতে নিয়ে যায়নি। এত দিনে রাজি করিয়েছি যে এক মাসের জন্য আমাকে নিয়ে ইউরোপে যাবে। এখন আবার বলছে যে নিয়ে যেতে পারবে না। তুমি নাকি তোমার কাজ শেষ করে ফেলেছ! তাকে আবার অফিস দেখতে হবে। আমাকে তুমি বলো, এখন ছেড়ে দেবে কেন?’

সব শুনে কামাল বলেছিলেন, তিনি তিন মাসের চুক্তিতে কাজী ফার্মসে যোগ দিয়েছিলেন। সব তো গুছিয়ে দিয়েছেন। কাজী সাহেবের স্ত্রী তাঁকে বলেছিলেন, ওসব চুক্তিটুক্তি তিনি বোঝেন না। কামালকেই থাকতে হবে। তাহলেই কাজী সাহেবকে নিয়ে তিনি ইউরোপে যেতে পারবেন। এরপর কামাল না করতে পারেননি। ওই যে থাকলেন, একনাগাড়ে আট বছর ছিলেন কাজী ফার্মসে। এভাবেই এস এম কামাল অনেক কিছু ছাড়তে চেয়েছেন। কিন্তু অন্যরা তাঁকে ছাড়তে রাজি ছিলেন না কখনো। এটা কামালের যোগ্যতা।

ব্যক্তি হিসেবে এস এম কামাল খুবই সৎ ও বিনয়ী একজন মানুষ ছিলেন। দেশের আইসিটি শিল্পে তাঁর বিশাল অবদান থাকলেও সেসব কথা তিনি কখনো প্রচার করেননি। খুবই প্রচারবিমুখ একজন মানুষ ছিলেন।

আমি ক্ষোভ ও দুঃখের সঙ্গে বলতে চাই, আইসিটি শিল্প গড়ে তোলার পেছনে তাঁর বিশাল অবদান থাকলেও এই খাত কখনোই তাঁকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দেয়নি। আজকের তরুণ প্রজন্ম এই মানুষদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারত। কিন্তু তাঁদের কাহিনি আমরা কখনো তরুণদের বলিনি, এমনকি তাঁদের সম্মানও দিইনি। যে দেশ তার নিজের কৃতী সন্তানদের সম্মান দিতে পারে না, সে দেশ কখনো উন্নতি করতে পারে না।

আবদুল্লাহ এইচ কাফি: বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সাবেক সভাপতি ও প্রয়াত এস এম কামালের বন্ধু