মিতসুবিশির আউটল্যান্ডার স্পোর্ট ২০২৪
মিতসুবিশির আউটল্যান্ডার স্পোর্ট ২০২৪

চালাতে কেমন নতুন আসা আউটল্যান্ডার স্পোর্ট

রাজধানীর তেজগাঁও লিঙ্ক রোডে অবস্থিত মিতসুবিশি বাংলাদেশের প্রদর্শনী কেন্দ্রে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল সম্প্রতি দেশের বাজারে আসা এসইউভি ঘরানার নতুন প্রজন্মের গাড়ি ‘আউটল্যান্ডার স্পোর্ট ২০২৪’। গত বুধবার প্রদর্শনী কেন্দ্রে প্রবেশের পরপরই অন্যান্য মডেলের গাড়ির ভিড়ে সবার আগে নজর পড়ল ধূসর এবং হলুদ রঙের দুটি আউটল্যান্ডার স্পোর্ট গাড়ি। আকর্ষণীয় নকশার এই গাড়িতে ‘কিক সেন্সর’ রয়েছে, ফলে পেছনের বাম্পারে পা দিয়ে স্পর্শ করলেই ব্যাক ডালা খুলে যায়।

চালিয়ে দেখার জন্য আমরা আউটল্যান্ডার স্পোর্ট ২০২৪ মডেলের গাড়িটি নিয়ে রাস্তায় নামলাম। বিকেল হওয়ায় অফিস ফেরত গাড়ির বেশ চাপ ছিল রাস্তায়। আর তাই যানজট এড়িয়ে ফাঁকা রাস্তায় গাড়ির নৈপুণ্য পরীক্ষার জন্য আমরা চলে যাই হাতিরঝিলে। হাতিরঝিলে থাকা উৎসুক মানুষ বেশ আগ্রহ নিয়েই আউটল্যান্ডার স্পোর্টকে দেখছিলেন। কারণও রয়েছে, হলুদ রঙের গাড়ি হলেও এই রংটিকে সোনালি বললেও ভুল হবে না। গাড়ির সামনে রয়েছে নতুন নকশার টি-আকৃতির হেডলাইট। মিতসুবিশি নতুন এই নকশার নাম দিয়েছে এক্সএফসি কনসেপ্ট।

গাড়ির পেছনেও এলইডি লাইট রয়েছে। বড়সড় আয়তাকার গ্রিলের মাঝখানে রয়েছে মিতসুবিশির লোগো। নিচে রয়েছে নম্বর প্লেট এবং প্লেটের ঠিক নিচে দুই পাশে দুটি এলইডি ফগ লাইট গাড়িটির সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে। ২০২৩ এর আউটল্যান্ডার লম্বাটে হলেও এই গাড়ি কমপ্যাক্ট আকারে তৈরি। গাড়ির বাইরের নকশায় থাকা কালো রঙের সাইড ডোর গার্নিশটি আলাদা করে চোখে পড়ে। এই অংশের কারণে গাড়িটিকে দ্বৈত রঙেরও মনে হতে পারে। চাকায় দ্বৈত রঙের (ডুয়েল টোন) রিমে ব্যবহার করা হয়েছে ২২৫/৫০আর/১৮ ইঞ্চি টায়ার। ৪টি টায়ারের পাশাপাশি এই গাড়িতে একই আকারের অতিরিক্ত আরেকটি টায়ার রয়েছে, যা বিপদকালীন সময়ে ব্যবহার করা যাবে। গাড়ির পেছনে বাম পাশের কোনায় রয়েছে মিতসুবিশি স্পোর্টের ব্যাজ।

গাড়ি চালু করলেই আউটল্যান্ডার স্পোর্টের ছবি ডিসপ্লেতে ভেসে উঠে। ফলে ৮ ইঞ্চি পর্দাতেই গাড়ির সব তথ্য জানা যায়। গাড়িটির ব্রেকে পা রাখতেই কতটা চাপ ব্রেক লিভারের ওপর পড়ছে, তা জানা যায়। একইভাবে থ্রটলে পা রেখেও জানা যায় থ্রটলের ওপরে চাপের পরিমাণ। পাশাপাশি এই ডিসপ্লেতে গাড়িটির স্টিয়ারিংয়ের পজিশন কম্পাস, টায়ার প্রেশার মনিটরিং সিস্টেম (টিপিএমএস) থাকায় চার চাকায় হাওয়ার পরিমাণ, ভ্যাকুয়াম, কতটা টর্ক উৎপন্ন হচ্ছে তার পরিমাণ, কুল্যান্ট, ইনজেকশনসহ সব অংশের তথ্য দেখা যায়, যা চালকের জন্য বেশ উপকারী। পাশাপাশি তিনটা ক্যাটাগরিতে ভাগ করে ইনফোটেইনমেন্ট ডিসপ্লেকে ব্যবহার করা যায়। গাড়িটিতে অ্যাপল কার প্লে, অ্যান্ড্রয়েড অটো, এএম/এফএম এবং ইউএসবি পোর্ট রয়েছে। গান শোনার জন্য আউটল্যান্ডার স্পোর্টে রয়েছে মিতসুবিশির ছয়টি স্পিকার এবং দুটি টুইটার।

গাড়িটির ড্যাশবোর্ডের অর্ধেক অংশজুড়ে রয়েছে ১২ দশমিক ৩ ইঞ্চির স্পর্শনির্ভর এইচডি ইনফোটেইনমেন্ট এবং ৮ ইঞ্চির ডিজিটাল ইনস্ট্রুমেন্ট ক্লাস্টার। দুটি ডিসপ্লেই সংযুক্ত থাকায় পুরো ড্যাশবোর্ডটি খুবই আকর্ষণীয়। বাম হাতে রয়েছে গাড়ি চালু বা বন্ধ করার বাটন। বাটনটির নিচে ড্রাইভ মোড। গাড়িটিতে নরমাল, ওয়েট, গ্রাভেল এবং মাড চারটি ড্রাইভ মোড রয়েছে। এই মোডগুলো ব্যবহার করে ভেজা, নুরি পাথর অথবা কর্দমাক্ত রাস্তায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে গাড়িটিকে স্বাচ্ছন্দ্যে চালানো যাবে। গিয়ার স্টিকটি দেখতে সাধারণ হলেও এতে চারটি অপশন রয়েছে। গিয়ার স্টিকের পরেই পার্কিং বাটন এবং অটো হোল্ড অপশন রয়েছে। গিয়ার শিফটারের পেছনে রয়েছে দুটি কাপ হোল্ডার। হ্যান্ড রেস্টটা সুপরিসর হওয়ার কারণে চালক এবং প্রথম সারির যাত্রী আরাম করে হাত রাখতে পারেন। হ্যান্ড রেস্টের নিচে রয়েছে চিলার বক্স। এই বক্সে চারটি বোতলে পানিকে ঠান্ডা করে পান করা যাবে। কনস্যুল বক্সটিকে অনেকেই ফ্রিজারও বলে থাকেন। গিয়ার স্টিকের সামনে তারহীন স্মার্টফোন চার্জ দেওয়ার সুবিধা আছে। গাড়ি চালাতে চালাতে নিজের মোবাইলটি চার্জ দেওয়ার জন্য এটি বেশ কাজের জিনিস। তবে এতে ফাস্ট চার্জিং সুবিধা নেই।

স্পোর্টস ঘরানার গাড়িটির থ্রটলে পা দিতেই শূন্য থেকে ৭০ কিলোমিটার গতি তুলেছিল মাত্র ৬ সেকেন্ডে। গাড়ির গতি ২০ কিলোমিটার অতিক্রম করলেই সব কটি দরজা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। সামনের আসন থেকে গাড়ির বডি রোল অনুভূত হয় না। তবে পেছনের আসনে বডি রোল কিছুটা অনুভব করা যায়। কেবিনকে পুরোপুরি শব্দবিহীন বলা না হলেও বাইরের শব্দ অতটা শোনা যায়নি। গাড়ির এক্সেলটি আয়তনে বড় হওয়ার পাশাপাশি সামনে ম্যাকফারসন স্ট্রাট ও পেছনে টরসিওন বিম সাসপেনশন চলতি পথে স্বাচ্ছন্দ্য দিচ্ছিল। ১৪৯৯ সিসির ডিওএইচসি ১৬ ভাল্বের মাইভেক টেকনোলজির ইঞ্জিনের এই গাড়িটি জ্বালানি সাশ্রয়ীও বটে। সিভিটি ট্রান্সমিশনের গাড়িটিতে টার্বো ইঞ্জিন নেই এবং ড্রাইভিং মোডে স্পোর্টস অপশনটি পাওয়া যায়নি। গাড়ি ঘোরানোর ক্ষেত্রে খুব কম জায়গা দরকার হয়। গাড়িটির টার্নিং রেডিয়াস মাত্র ৫ দশমিক ২ মিটার। আউটল্যান্ডার স্পোর্টের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা যথাক্রমে ৪ হাজার ৩৯০, ১ হাজার ৮১০ এবং ১ হাজার ৬৩৫ মিলিমিটার। চাকার দৈর্ঘ্য ২৬৫০ মিলিমিটার। মাটি থেকে গাড়িটির উচ্চতা ( গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স) ২২২ মিলিমিটার। জ্বালানি ধারণক্ষমতা ৪২ লিটার।

মিতসুবিশির আউটল্যান্ডার স্পোর্ট ২০২৪

চামড়ায় মোড়ানো স্টিয়ারিং হুইলটিকে সামনে পেছনে এবং উঁচু নিচু করে চালকের সুবিধা অনুযায়ী সমন্বয় করা যায়। শুধু তাই নয়, স্টিয়ারিং হুইলেই রয়েছে ফোন রিসিভ করার সুবিধা, অডিও নিয়ন্ত্রণ, ক্রুজ কন্ট্রোল এবং নেভিগেশন। আসনগুলোও চামড়ায় মোড়ানো হওয়ার কারণে দূরের ভ্রমণেও অতিরিক্ত গরম মনে হবে না। অভ্যন্তরীণ নকশাটি এমনভাবে বানানো হয়েছে যে গাড়ির ভেতরে বসেও বাইরের পুরোপুরি ভিউ পাওয়া যায়। নিরাপত্তার জন্য গাড়িটিতে ছয়টি এয়ারব্যাগ রয়েছে। গাড়িটির ব্রেক রেসপন্সও দ্রুত ছিল। চার চাকাতেই ব্যবহার করা হয়েছে ডিস্ক ব্রেক। পাশে গাড়ি অতিক্রম করলে দুই পাশের রিয়ার ভিউ গ্লাসে রিয়ার ক্রস ট্রাফিক এলার্ট(আরসিটিএ) এবং কোনো গাড়ি দৃষ্টিসীমানা এড়িয়ে কাছাকাছি চলে আসলে ব্লাইন্ড স্পট ওয়ার্নিংটাও ঠিকঠাক কাজ করেছে। এন্টি লক ব্রেকিং সিস্টেম (এবিএস), ইবিডি, ট্রাকশন কন্ট্রোল, এএসসি, এওয়াইসি, হিলস্টার্ট এসিস্ট (এইচসিএ), ইমার্জেন্সি স্টপ সিগন্যাল সিস্টেম (ইএসএস) এবং এএসসি থাকার কারণে যেকোনো বন্ধুর পথ সহজেই পাড়ি দেওয়া যায়। শুধু তা–ই নয়, একটিভ ইয়ো কন্ট্রোল–সুবিধা থাকায় পিচ্ছিল রাস্তায়ও স্বচ্ছন্দে গাড়ি চালানোর সুযোগ মিলে থাকে।

গাড়িটির পেছনের আসনে বসে বেশ ভালো লাগল। কারণ, আসনটি সামান্য হেলানো ছিল এবং সামনে পা রাখার প্রশস্ত জায়গা রয়েছে। ফলে ছয় ফিট উচ্চতার মানুষেরও পেছনের আসনে স্বচ্ছন্দে পা রেখে বসতে পারবেন। পেছনের দুই আসনের মাঝখানে হ্যান্ডরেস্ট থাকায় দূরের যাত্রায় বেশ আরাম করে বসা যাবে এই গাড়িতে। পেছনের আসনের যাত্রীদের জন্য আলাদা এসি ভেন্টসহ স্মার্টফোন চার্জ করার জন্য ইউএসবি এবং টাইপ সি পোর্টও রয়েছে।

মালামাল বহনের জন্য গাড়িটিতে সুপরিসর বুট স্পেস আছে, যা দ্বিতীয় সারির আসন পরিবর্তন করে দ্বিগুণ করে ফেলা যায়। গাড়ির অভ্যন্তরে রয়েছে অটো ডিমিং রিয়ার ভিউ মিরর। এই প্রযুক্তির কারণে রাতের ভ্রমণে পেছনের গাড়ির হেডলাইটের তির্যক আলো গাড়ির চালকের দৃষ্টিতে প্রভাব ফেলবে না। রয়েছে পেছনের আসনের সিট বেল্ট ওয়ার্নিং। দ্বৈত জোনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রে ন্যানোএক্স প্রযুক্তি ব্যবহার করায় গাড়ির অভ্যন্তরে মিলবে বিশুদ্ধ শীতল হাওয়া।
গাড়িটিতে রিয়ার ভিউ ক্যামেরার সঙ্গে পার্কিং সেন্সর রয়েছে। ফেরার সময়ে আউটল্যান্ডার স্পোর্টকে গতিতে রেখে ভাঙা রাস্তার ওপর চালালেও গাড়ির চাকা সরে যায়নি। সন্ধ্যা নামার পর গাড়ির ভেতরের সামনের সারিতে ড্যাশবোর্ড এবং দুই দরজাতে নীল রঙের অ্যাম্বিয়েন্ট লাইটের আলো গাড়ির ভেতর বৈচিত্র্যময় করে তুলেছিল। সাদা, কালো, ধূসর, লাল, গ্রাফাইট গ্রে মেটালিক এবং হলুদ রঙে মিতসুবিশি আউটল্যান্ডার স্পোর্ট দেশের বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। গাড়িটির দাম ৪৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। পাঁচ বছরের বিক্রয়োত্তর সেবাসহ তিনটি বিনা মূল্যে সার্ভিস সুবিধাও পাওয়া যাবে।