নীল (সার্ফ ব্লু) রঙের নতুন আট্টো–থ্রি এসইউভিটি (স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকেল) গাড়িটি রাজধানীর তেজগাঁওয়ে অবস্থিত চীনা গাড়ি নির্মাতা বিওয়াইডির প্রদর্শনী কেন্দ্রে প্রস্তুত ছিল। এই আট্টো–থ্রি একটি বৈদ্যুতিক গাড়ি (ইভি)। নীলের পাশাপাশি কালো, ধূসর এবং সাদা রঙে এই গাড়ি বাংলাদেশের বাজারে পাওয়া যাবে। ছোটবেলার রূপকথায় পড়া ড্রাগনের কথা মনে আছে? গাড়ির সামনের নকশা ‘ড্রাগন ফেস ডিজাইন উইথ উইং ফেদার’ ধারণায় তৈরি। সঙ্গে আছে ‘কম্বিনেশন এলইডি হেডলাইট’।
গত রোববার মেঘাচ্ছন্ন বিকেলে বিওয়াইডি আট্টো-থ্রির সঙ্গে শুরু হলো আমাদের চলা। যানজট এড়িয়ে ফাঁকা রাস্তায় গাড়ির নৈপুণ্য পরীক্ষার জন্য বেছে নেই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে পূর্বাচল ‘৩০০ ফিট’ মহাসড়ক। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে গতিসীমা নির্ধারিত থাকায় ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার বেগে ক্র্যুজ কন্ট্রোল করে আমরা গাড়ি নিয়ে এগোতে থাকলাম। যেতে যেতে মনে হলো গাড়িটির সঙ্গে কথা বলি। এই গাড়িতে কণ্ঠ নির্দেশনা বা ভয়েস কন্ট্রোল অ্যাসিস্ট্যান্ট রয়েছে। ‘হাই বিওয়াইডি, ওপেন দ্য সানরুফ’ বলার সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেলো গাড়ি ছাদের একাংশ। এভাবে কথা বলে গাড়ির অনেক সুবিধা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। প্যানারমিক সানরুফটি বন্ধ করে আমরা শুধু গাড়ির ওপরের কাচটি উন্মুক্ত রেখে দিনের আলোতে গাড়ির সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম।
গাড়ি চালানোর বেলায় এই এসইউভিতে তিনটি ধরন বা মোড রয়েছে—ইকো, নরমাল ও স্পোর্টস। গতিসীমা ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার অতিক্রম করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গাড়িটি ইকো থেকে নরমাল মোডে পরিবর্তিত হয়। ৩০০ ফিট সড়কে প্রবেশের পর গাড়িটির গতি পরীক্ষা করতে ইকো মোড থেকে স্পোর্টস মোডে গেলাম। দুর্দান্ত গতি। মাত্র ১০ সেকেন্ডে গাড়িটি শূন্য থেকে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার গতি তুলেছে। গাড়িটির ‘মাল্টিফাংশন’ স্টিয়ারিং হুইলটি চালানোর সময় একটু শক্ত মনে হয়েছিল। চালকসহ ৫ যাত্রী নিয়ে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৩৫ কিলোমিটার গতিতে গাড়িটি চালিয়েছি। বিওয়াইডির দাবি গাড়িটি সর্বোচ্চ ১৬০ কিমি গতিবেগে ছুটে চলতে পারে। অতিরিক্ত গতিতে গাড়িটিতে অল্প বডি রোল বা ঝাঁকুনি অনুভব হয়েছে। গাড়িটির ব্রেক প্রশংসার দাবিদার। আট্টো-থ্রিতে সামনের চাকায় ভেন্টিলেটেড ডিস্ক এবং পেছনের চাকায় শুধু ডিস্ক ব্রেক ব্যবহার করা হয়েছে।
১ হাজার ৭৫০ কেজি ওজনের আট্টো-থ্রির দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা যথাক্রমে ৪ হাজার ৪৫৫, ১ হাজার ৮৭৫ এবং ১ হাজার ৬১৫ মিলিমিটার। দুই চাকার দূরত্ব (হুইলবেজ) ২ হাজার ৭২০ মিলিমিটার। সাড়ে ৫ মিটার জায়গায় গাড়িটি ঘোরানো যায় (টার্নিং রেডিয়াস)। মাটি থেকে গাড়িটির উচ্চতা ১৭৫ মিলিমিটার।
মহাসড়ক ছেড়ে আমরা কাঞ্চন ব্রিজের নিচ দিয়ে উঁচু–নিচু এবং ভাঙা রাস্তায় যাই। রোববার সকালে বৃষ্টি হওয়ায় অনেক স্থানে পানি জমে ছিল। এ জন্য বেশ বড় একটি গর্ত চোখে পড়েনি। এই গর্তের ওপর দিয়ে গাড়ি চললেও গাড়ির কাঠামোতে কোনো আঘাত লাগেনি। সাসপেনশনের নৈপুণ্য বলার মতো হলেও চেসিসকে অতটা আঁটসাঁট মনে হয়নি। আলট্রা লো উইন্ড রেজিস্ট্যান্স অপশন থাকার কারণে বাতাসের বিরুদ্ধে গাড়ির গতি দেখার মতো। বিওয়াইডি ই-প্ল্যাটফর্ম ৩.০ প্রযুক্তিতে তৈরি গাড়িটিতে প্রতি ঘণ্টায় ৬৩.৮ কিলোওয়াট ক্ষমতার ব্লেড ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়েছে, যা ১০০ কিলোওয়াট পর্যন্ত শক্তি উৎপাদন করতে পারে। ২০১ অশ্বশক্তির (বিএইচপি) আট্টো–থ্রির সর্বোচ্চ টর্ক ৩১০ নিউটন মিটার (এনএম)। ম্যাগনেটিক সিংক্রোনাস মোটরে ফ্রন্ট হুইল ড্রাইভে স্বয়ংক্রিয় একটি গিয়ারে গাড়িটি পরিচালিত হয়। চলাচলে স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য রয়েছে অ্যালয় হুইলসমৃদ্ধ ২৩৫/৫০ আর১৮ ইঞ্চি টায়ার।
গাড়ির অভ্যন্তরে গিয়ার নবটি দেখে বিমানের থ্রটলের (গতি নিয়ন্ত্রক) কথা মনে হবে। গিয়ারের চারপাশে সুইচের ছড়াছড়ি। চালকের আসনে বসে গিয়ার নবে হাত রেখে মনে হবে এখনি উড়াল দিই। সামনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের খোপগুলো (এসি ভেন্ট) অনেকটা ডাম্বেলের মতো দেখতে। দরজার প্যাডগুলোকেও মানুষের পেশি আকৃতির করে বানানো হয়েছে। আট্টো-থ্রির অভ্যন্তরীণ সজ্জা দেখে ‘স্বাস্থ্য সচেতন’ মন্তব্য করলেও যেন ভুল হবে না। গাড়ির দরজা খোলার নবগুলোয় নতুনত্ব আনা হয়েছে। প্রথম দেখাতে কীভাবে দরজা খুলে গাড়ি থেকে বের হবেন, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হতে পারে। নবগুলোর নিচে রয়েছে আলোসহ স্পিকার। এই অংশটি বিমানের প্রপেলারের মতো। ১৫ দশমিক ৬ ইঞ্চির একটি মাল্টিমিডিয়া পর্দা, যা সোজাসুজি এবং আড়াআড়ি দুইভাবেই ব্যবহার করা যায়।
আট্টো-থ্রি গাড়িতে ৩৬০ ডিগ্রি ক্যামেরা রয়েছে। পাশের কোনো গাড়ি যদি কাছাকাছি চলে আসে, তবে ক্যামেরাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে যায়, পর্দায় দেখা যায়। এ ছাড়া ডানে বা বাঁয়ে সড়কের সংকেত বাতি জ্বাললেও ক্যামেরায় গাড়ির চাকার অবস্থা এবং আশপাশের দৃশ্য ধরা পড়ে। পর্দায় তা দেখা যায়।
গাড়ি ডানে–বাঁয়ে অথবা সামনে–পেছনে চালানোর সময় বিশাল ডিসপ্লেতে গাড়ির চাকার সীমা দেখার সুবিধা রয়েছে। স্বয়ংক্রিয় সুইচের মাধ্যমে চালক এবং বাম পাশের যাত্রীর আসনগুলোকে ৬ ও ৪ ধাপে সামনে পেছনে নেওয়া যায় বা উঁচু নিচু করা যায়। আসনগুলোয় কৃত্রিম চামড়া ব্যবহার করা হয়েছে। ইন্টিগ্রেটেড স্পোর্টস ধারণায় তৈরি বলে আসনগুলো বেশ আরামদায়ক। সুইচের মাধ্যমেও সানরুফ খোলা বা বন্ধ করা যায়। ড্যাশবোর্ডে গাড়ির ইনফোটেইনমেন্ট ডিসপ্লেটিকে আকারে ছোট এবং তথ্যবহুল করে বানানো হয়েছে। চালানোর সময় সময়, তাপমাত্রা, গাড়ির গতি, কতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করা যাবে, কত শতাংশ চার্জ রয়েছে, গাড়ির গিয়ার এবং মোড দেখা যায় পরিষ্কারভাবে। গাড়ির দরজার পকেট হোল্ডারে যে দড়ি ব্যবহার করা হয়েছে, তা দেখতে অনেকটা গিটারের তারের মতো। শুধু দেখতেই নয়, তারগুলোকে স্পর্শ করলে তা সুর সৃষ্টি করে। রয়েছে আটটি স্পিকার এবং বিশুদ্ধ বাতাসের জন্য সিএন ৯৫ এয়ার ফিল্টার। তারহীন চার্জের জন্য গাড়িটির সেন্টার কনসোলের সামনে ওয়্যারলেস চার্জার রয়েছে, যা দিয়ে সহজেই স্মার্টফোন চার্জ দেওয়া যাবে। এ ছাড়া ইউএসবি–সি পোর্ট দুটি এবং ইউএসবি–এ পোর্ট দুটি রয়েছে।
নিরাপত্তার জন্য গাড়িটিতে সাতটি এয়ারব্যাগ রয়েছে। এ ছাড়া ব্লাইন্ড স্পট ডিটেকশন, লেইন ডিপারচার প্রিভেনশন, রিয়ার ক্রস ট্রাফিক অ্যাসিস্ট, সিটবেল্ট ওয়ার্নিং, এন্টি লক ব্রেকিং সিস্টেম (এবিএস), ইলেকট্রনিক ব্রেক-ফোর্স ডিস্ট্রিবিউশন, ব্রেক অ্যাসিস্ট, ইএসপি, হিল হোল্ড ও ট্র্যাকশন কন্ট্রোল, স্পিড সেন্সিং ডোর লক, ইলেকট্রনিক পার্কিং ব্রেক উইথ অটো হোল্ড এবং পার্কিং সেন্সর রয়েছে। ঠান্ডায় উষ্ণতার জন্য গাড়িটিতে রয়েছে হিট পাম্প।
গাড়ির সামনের আসনের পাশাপাশি পেছনের আসনও বেশ প্রশস্ত। তিনজন একসঙ্গে বসলেও চাপাচাপি হয় না তেমন একটা। অন্ধকারে গাড়ির ভেতরে ‘অ্যাম্বিয়েন্ট’ আলো চোখে প্রশান্তি দেয়। এ ছাড়া স্পর্শের মাধ্যমে গাড়ির ভেতরের আলো জ্বালানো বা নিভানো যায়। ব্যাকলিট থাকার কারণে সহজেই সুইচগুলো চোখে পড়ে। একক জোনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রে পেছনের আসনের যাত্রীদের জন্যও রয়েছে এসি ভেন্ট। গাড়িটির বুট স্পেস (পেছনে মালামাল বহনের জায়গা) ৪৪০ লিটার। দ্বিতীয় সারির আসন উল্টিয়ে এই জায়গা ১৩৪০ লিটার পর্যন্ত বাড়ানো যায়।
এবার ফেরার পালা। যানজটের মধ্যেও ২৪ ডিগ্রি তাপমাত্রায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রটি বেশ আরাম দিচ্ছিল। অটো হোল্ড থাকায় ব্রেক থেকে পা উঠিয়েও সামনের গাড়িকে অনুসরণ করে সহজে চালানো গেছে। চালক এবং সামনের যাত্রী এবং পেছনের যাত্রীদের জন্যও রয়েছে হাতল (হ্যান্ডরেস্ট)। যে গাড়িটি আমরা চালিয়েছি, সেই গাড়িটির পেছনে বড় করে ‘বিল্ড ইওর ড্রিম’ লেখা থাকলেও ২০২৪ মডেলে সংক্ষেপে বিওয়াইডি লেখা থাকবে। আট্টো-থ্রিতে এসি এবং ডিসি দুই ধরনের চার্জ দেওয়া যাবে। বাসায় ব্যবহৃত চার্জার দিয়ে গাড়িটি পূর্ণ চার্জ করতে ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা সময় লাগবে। এসি চার্জারে (ফাস্ট চার্জার) মাত্র ৩০ মিনিটে ৩০ থেকে ৮০ শতাংশ চার্জ করা যাবে।
বাংলাদেশে বিওয়াইডির বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান সিজি-রানার বাংলাদেশ আট্টো-থ্রির ব্যাটারিতে ৮ বছর বা ১ লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত (যেটি আগে আসে) এবং মোটরের ক্ষেত্রে ১ লাখ ৫০ হাজার ও পুরো গাড়ির ক্ষেত্রে ৬ বছর বা ১ লাখ ৫০ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত বিক্রয়োত্তর সেবা দেবে।
আগামী সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে আট্টো-থ্রি গাড়ি বিক্রির জন্য বাজারে ছাড়া হতে পারে। এক্সটেন্ডেড সংস্করণের আট্টো-থ্রির দাম ৫৫ লাখ ৯০ হাজার এবং স্ট্যান্ডার্ড সংস্করণে ৪৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা হতে পারে। সিজি-রানার বাংলাদেশের তথ্যমতে বিওয়াইডি সিজি-রানার বাংলাদেশ ২০২৪ গাড়ি চালাতে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হবে মাত্র আড়াই টাকা।