সম্প্রতি রাজধানীতে কয়েকটি গাড়িতে আগুন লাগার খবর পাওয়া গেছে। চলন্ত অবস্থায় এই গাড়িগুলোতে হঠাৎ করে আগুন ধরে যায়। গাড়িতে আগুন লাগা চালক, যাত্রী, গাড়ির মালিক সবার জন্যই ভয়ংকর। এমন দুর্ঘটনা প্রাণঘাতীও হয়ে উঠতে পারে। হঠাৎ আগুন দেখে যে কেউ শঙ্কিত হতে পারেন। এতে দুর্ঘটনার মাত্রা আরও বেড়ে যায়। কী কী কারণে গাড়িতে আগুন লাগতে পারে এবং কীভাবে আগুন লাগা থেকে গাড়িকে রক্ষা করা যায়, তা নিয়ে এই প্রতিবেদন।
একটি গাড়িতে প্রচুর পরিমাণ বৈদ্যুতিক তার ব্যবহার করা হয়। গাড়ির সিস্টেম ও সেন্সর পরিচালনার জন্য এই তারগুলো বিদ্যুৎ পরিবাহী হিসেবে কাজ করে। গাড়ির চালিকা শক্তি জ্বালানি থেকে সংগৃহীত হলেও বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশগুলো ব্যাটারি থেকে শক্তি নিয়ে থাকে। একটি ব্যাটারির ধনাত্মক (পজিটিভ) ও ঋণাত্মক (নেগেটিভ) দুটি টার্মিনাল থাকে। নেগেটিভ টার্মিনাল গাড়ির কাঠামো বা শরীরের সঙ্গে যুক্ত করে গ্রাউন্ড বা আর্থিং করা হয়। কোনো কারণে যদি ব্যাটারির পজিটিভ টার্মিনাল গাড়ির কাঠামোর সঙ্গে লেগে যায়, তবে বৈদ্যুতিক গোলযোগ বা শর্টসার্কিটের আশঙ্কা দেখা দেয়। এই শর্টসার্কিটের কারণে গাড়িতে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয়। এ থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটতে পারে। এ ছাড়া গাড়ির দরজার বৈদ্যুতিক নিয়ন্ত্রকগুলোতেও পজিটিভ এবং নেগেটিভ প্রান্ত থাকে। অদক্ষ টেকনিশিয়ান যদি এই বৈদ্যুতিক তারগুলো নিয়ে কাজ করেন এবং কাজ শেষে যদি ঠিকঠাক সংযোগ না দেন, তাতেও বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে আগুন লাগতে পারে গাড়িতে।
প্রতিটি গাড়িতে কোন আকার–আকৃতির ব্যাটারি ব্যবহার করতে হবে, সেই নির্দেশনা দেওয়া থাকে। ব্যাটারি রাখার জন্য যে জায়গা থাকে, সেখানে ব্যাটারি সঠিকভাবে বসে যায়। অনেকেই গাড়ির বৈদ্যুতিক শক্তি বাড়াতে উচ্চ ক্ষমতার বড় আকারের ব্যাটারি ব্যবহার করেন। এতে পজিটিভ টার্মিনাল যদি কোনো কারণে গাড়ির বনেটের (গাড়ির সামনের অংশে ইঞ্জিনের ঢাকনা) সঙ্গে লেগে যায়, সে ক্ষেত্রে ব্যাটারিতে আগুন ধরে যেতে পারে।
অনেকক্ষণ ধরে টানা গাড়ি চালানো হলে অথবা অতিরিক্ত গতি তুলতে থ্রটল বা অ্যাকসিলারেটরে বেশি চাপ প্রয়োগ করা হলে ইঞ্জিন মাত্রাতিরিক্ত গরম (ওভারহিট) হয়। গাড়ি যদি ঠিকমতো তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, সে ক্ষেত্রেও গাড়িতে আগুন লাগার আশঙ্কা ব্যাপক। অতিরিক্ত গরম, নিম্ন তাপমাত্রায় শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের ব্যবহার অথবা গাড়ির চার্জিং প্যানেলগুলোতে নির্গত ভোল্টেজেরে চেয়ে বেশি বৈদ্যুতিক শক্তি ব্যবহার করা হলেও ইঞ্জিন ওভারহিট হতে পারে। অতিরিক্ত গরমের কারণে সরাসরি ইঞ্জিনে আগুন লেগে যাবে, ব্যাপারটা এমন নয়। তবে ইঞ্জিন ওভারহিট হলে ইঞ্জিন অয়েল, ট্রান্সমিশন ফ্লুইড লিক করে ইঞ্জিনের আশপাশে থাকা কোনো প্লাস্টিকের সংস্পর্শে এলে আগুন ধরার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া ইঞ্জিনের ‘হেড গ্যাসকেট’ ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ ওভারহিটের কারণে নষ্ট হতে পারে।
উজ্জ্বল আলোর জন্য গাড়িতে এলইডি বাল্বের ব্যবহার বেড়েছে। অনেক গাড়িতে উচ্চ লুমেন্সের হাইল্যাম্প ব্যবহার করা হয়। বেশির ভাগ গাড়িতে সর্বোচ্চ ৬০ ওয়াট পর্যন্ত হেডলাইট ব্যবহারের নির্দেশনা থাকে। অতিরিক্ত উজ্জ্বল আলোর জন্য এই নির্দেশনা না মেনে ১০০ থেকে ২০০ ওয়াটের হেডলাইটও গাড়িতে ব্যবহার করতে দেখা যায়। হেডলাইটগুলোকে শীতল রাখার জন্য কুলিং সিস্টেম থাকে। নিম্নমানের বাতিতে কুলিং সিস্টেম না থাকায় এগুলো জ্বালানো হলে এর প্রভাব ফিউজ বক্সে গিয়ে পড়ে। ফিউজ বক্সের ক্ষমতার চেয়ে বেশি ভোল্টেজ নির্গত হলে এখানেও আগুন লাগার আশঙ্কা রয়েছে। এমনটা হলে হয়তো অনেকে মনে করতে পারেন, রাতে হেডলাইট জ্বালালে সমস্যা দেখা দেবে কিন্তু দিনে তো নিরাপদ। রাতে হেডলাইট থেকে অতিরিক্ত তাপ উৎপন্ন হয়ে যদি দিন পর্যন্ত এর প্রভাব থেকে যায়, সে ক্ষেত্রে দিনেও হেডলাইট থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে।
ইঞ্জিনকে ঠান্ডা রাখার জন্য গাড়ির রেডিয়েটরে কুলিং ফ্যান ব্যবহৃত হয়। রাস্তায় ধুলাবালুর সংস্পর্শে সেই ফ্যানে ধুলার আস্তর পড়ে যায়। ধুলাবালুর কারণে ফ্যান যদি ঠিকমতো কাজ না করে, তাহলেও ইঞ্জিন অতিরিক্ত গরম হতে পারে। এই ফ্যান নষ্ট হলে বাজার থেকে সস্তা নিম্নমানের কুলিং ফ্যান গাড়িতে ব্যবহার করা হলেও বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ব্যক্তিগত গাড়ি থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক গাড়িগুলোতেও জ্বালানি হিসেবে সিএনজি বা এলপিজি ব্যবহৃত হয়। শুধু তেলে চলা গাড়িগুলোতে দুর্ঘটনা ছাড়া জ্বালানি থেকে আগুন ধরার আশঙ্কা নেই বললেই চলে। তবে বিকল্প জ্বালানিতে গাড়ি রূপান্তর করা হলে পেছনের বুট স্পেসে (ডিকি) সিএনজি বা এলপিজির সিলিন্ডার থাকে। সিলিন্ডার থেকে গাড়ির তলা দিয়ে পাইপের মাধ্যমে সিএনজি/এলপিজি ইঞ্জিনে প্রবেশ করে। কোনো কারণে এই লাইনে লিকেজ বা ফুটো হলে রাস্তায় চলাচলের সময় কোনো পাথরের টুকরা বা ঘর্ষণে সক্ষম এমন কোনো বস্তুর সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটলে আগুনের সূত্রপাত ঘটতে পারে। এ ছাড়া সিলিন্ডারে লিকেজ থাকলেও আগুন লাগার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
মূল্যবান গাড়ি আগুনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য গাড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের উল্লিখিত নিয়ম পরিপূর্ণভাবে মেনে চলার চেষ্টা করতে হবে। আসল যন্ত্রাংশ, ইঞ্জিন অয়েল, ইঞ্জিন ও এসি ফিল্টার ব্যবহারের পাশাপাশি হেডলাইট পরিবর্তনেও নির্দিষ্ট ওয়াটের বেশি ক্ষমতার বাতি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ইঞ্জিন ওভারহিট হলে গাড়ির ড্যাশবোর্ডে সংকেত দেখায়। তাই এমন সংকেত চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গাড়িকে নিরাপদ স্থানে রেখে শীতল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
গাড়িতে ক্যামেরা, মিডিয়া প্লেয়ার থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক যন্ত্র যুক্ত করার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ানের শরণাপন্ন হতে হবে। কাজ শেষে বৈদ্যুতিক তারগুলো ঠিকমতো যুক্ত করা হয়েছে কি না, তা–ও জেনে নেওয়া উচিত। সাধারণ পানির বদলে ইঞ্জিনকে শীতল রাখার জন্য গাড়ির প্রস্তুতকারক নির্দেশিত ‘কুলেন্ট’ ব্যবহার করলে গাড়ির ওভারহিট সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে। গাড়িতে সিএনজি অথবা এলপিজির গন্ধ পাওয়া গেলে দ্রুত সার্ভিস সেন্টারে যোগাযোগ করা উচিত। এ ছাড়া নির্দিষ্ট সময় পরপর সিএনজির সিলিন্ডার এবং পুরো সিস্টেম পুনর্নিরীক্ষণ করাতে হবে।
সর্বোপরি নিরাপত্তার স্বার্থে গাড়িতে অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র বা ফায়ার এক্সটিংগুইশার রাখা যেতে পারে। এতে হঠাৎ আগুন লাগার মতো সমস্যা হলে তৎক্ষণাৎ নেভানোর প্রচেষ্টা সহজ হবে।