২০১৬ মডেলের টয়োটা অ্যাক্সিও হাইব্রিড গাড়ি ব্যবহার করেন রাজশাহীর সিনথিয়া টেলিকমের ব্যবস্থাপক জিয়া উদ্দিন আহমেদ। ২০১৯ সাল থেকে তিনি গাড়িটি ব্যবহার করছেন। জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় গাড়ি চালানোর খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনি হিমশিম খাচ্ছিলেন। জ্বালানি খরচ কমিয়ে গাড়ি সচল রাখার জন্য তিনি বিকল্প পদ্ধতি খুঁজতে থাকেন। গত জানুয়ারিতে তিনি পেয়ে যান জ্বালানি সাশ্রয় করার উপায়। নিজের হাইব্রিড গাড়িটি তিনি এলপিজি (লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস) প্রক্রিয়ায় রূপান্তর করেন। মহাসড়কে চালিয়ে এলপিজি ব্যবহার করে তিনি প্রতি লিটার এলপিজি খরচ করে সর্বোচ্চ ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত পথ পাড়ি দিতে সক্ষম হন।
হাইব্রিড গাড়ি কি এলপিজিতে রূপান্তর করা যায় এমন প্রশ্নের জবাবে অ্যাপভিত্তিক অটোমোবাইল রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান যান্ত্রিকের প্রধান কৌশলগত কর্মকর্তা (সিএসও) আবুল হাসনাত বলেন, প্রথমে বুঝতে হবে, এলপিজি গাড়ির জ্বালানি খরচে কী ভূমিকা রাখছে? এলপিজিতে রূপান্তর মানে হাইব্রিড প্রযুক্তি কাজ করবে না—এটা ভুল ধারণা। হাইব্রিড গাড়ি চালু হওয়ার সময় বৈদ্যুতিক শক্তি ব্যবহার করে। ব্যাটারিতে যদি শক্তি সঞ্চিত না থাকে, সে ক্ষেত্রে তেলের সাহায্যে গাড়ি চলে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জ্বালানি ও বৈদ্যুতিক শক্তি একসঙ্গে ব্যবহৃত হয়। এলপিজিতে গাড়ির জ্বালানি বা ফুয়েল সিস্টেমকে পরিবর্তন করা হলে মাত্র পাঁচ সেকেন্ডের ব্যবধানে তেলের বিকল্প হিসেবে এলপিজি ইঞ্জিনে প্রবেশ করে। এলপিজি কিট বা রিডিউসারের কন্ট্রোলার এ কাজটি করে থাকে। তাই হাইব্রিড গাড়ির জন্য জ্বালানির রূপান্তরে কোনো সমস্যা নেই। তবে হাইব্রিড গাড়িকে সিএনজিতে রূপান্তর না করাই উত্তম।
মূলত পেট্রল ও অকটেন আলাদা কোনো জ্বালানি নয়। শুধু পরিশোধন প্রক্রিয়ার কারণে রন (রিসার্চ অকটেন নম্বর) রেটিংয়ে পার্থক্য হয়। পরিশোধিত তেলের রেটিং ৮৫ বা ৮৭ হলে, সেটাকে পেট্রল এবং ৮৯ থেকে ১০১ রেটিংয়ের জ্বালানিকে অকটেন বলা হয়। জাপানি গাড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বেশির ভাগ গাড়িতে অকটেন গ্রেড ৯২ ব্যবহার করার জন্য পরামর্শ দেয়। এর নিচে জ্বালানির রেটিং হলে গাড়িতে নকিং, স্টার্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়। এদিক থেকে এলপিজির রন গ্রেড ৯৪ থেকে ১১২ পর্যন্ত হয়ে থাকে। যে কারণে দেশে পেট্রল বা অকটেন ব্যবহার করার থেকে এলপিজি ব্যবহার করা উত্তম বলে উল্লেখ করেন আবুল হাসনাত।
গাড়িকে এলপিজিতে রূপান্তর করার ক্ষেত্রে ইঞ্জিনভেদে রিডিউসার বা এলপিজি কিট ভিন্ন হয়। আগে ডিরেক্ট ফুয়েল ইনজেকশন সিস্টেমের গাড়ির জন্য দেশের বাজারে কিট পাওয়া যেত না। তবে এখন টয়োটার বেশির ভাগ হাইব্রিড গাড়ি দেশেই এলপিজিতে রূপান্তর করা যাচ্ছে।
হাইব্রিড গাড়ি এলপিজিতে রূপান্তরে কোনো জটিলতা রয়েছে কি না? অ্যাকটিভ এলপিজি কনভার্সন ওয়ার্কশপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাকিব হোসেন এ ব্যাপারে বলেন, ‘২০১৮ থেকে আমরা হাইব্রিড গাড়ি এলপিজিতে রূপান্তর করা শুরু করি। এ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিকের বেশি হাইব্রিড গাড়ি এলপিজিতে রূপান্তর করা হয়েছে। সাধারণত দুভাবে গাড়িকে এলপিজিতে রূপান্তর করা যায়। ট্র্যাডিশনাল ও সিকুয়েন্সিয়াল পদ্ধতি। ট্র্যাডিশনাল প্রক্রিয়ায় গাড়িকে রূপান্তর করা হলে, তা পরবর্তী সময়ে জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। সে ক্ষেত্রে সিকুয়েন্সিয়াল প্রক্রিয়ায় হাইব্রিড গাড়ির তেমন কোনো সমস্যা দেখা যায় না।’
হাইব্রিড গাড়িতে গতি, জ্বালানির পরিমাণ, ইঞ্জিনসহ নানা বিষয়ের তথ্য দেখানোর ডিসপ্লে থাকে। যে কারণে এলপিজিতে রূপান্তর করার পর কোনো সমস্যা দেখা দিলে তা ডিসপ্লেতে দেখা যায়। এলপিজি সমন্বয় ঠিকমতো না হলে ‘বার্নিং সিস্টেম টু হাই/লো’ এমন তথ্য প্রদর্শন করবে। সে ক্ষেত্রে ওয়ার্কশপ থেকে কন্ট্রোলার সমন্বয় করিয়ে নিতে হবে বলে জানান রাকিব হোসেন।
টয়োটা অ্যাকুয়া, অ্যাক্সিও, নোয়াহ, ভক্সি, এসকোয়ার ও হোন্ডা গ্রেস হাইব্রিড গাড়িগুলোকে এলপিজিতে রূপান্তর করে গ্রাহকেরা ব্যবহার করছেন উল্লেখ করেন রাকিব। তিনি বলেন, এলপিজির প্রতি লিটারের দাম পড়ে ৫৭ টাকা ৫২ পয়সা, যেখানে ১ লিটার অকটেনের দাম ১৩০ টাকা। এলপিজিতে প্রতি লিটার জ্বালানিতে প্রায় ৭২ টাকা সাশ্রয় হয়। প্রতি লিটার জ্বালানি খরচে তেলের সঙ্গে এলপিজির ২ থেকে ৩ কিলোমিটার পর্যন্ত পার্থক্য হয়ে থাকে। এটা হয় মূলত ঘনত্বের কারণে। ১ হাজার মিলিলিটার পানিতে ১ লিটার পানি হলেও জ্বালানির ক্ষেত্রে পাওয়া যায় ৮২৫ মিলিলিটার। এলপিজির ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ৭২৫ মিলিলিটার। তারপরও এলপিজিতে ৪০ শতাংশ জ্বালানি সাশ্রয় হয় এবং ইঞ্জিনও ভালো থাকে।
হাইব্রিড গাড়ি এলপিজিতে রূপান্তর করা হলে গাড়ি চালানোর শেষে এবং শুরুতে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। গাড়ি চালানো শেষে এলপিজির সুইচ অফ করে রাখতে হবে। সকালে গাড়ি চালু করার দুই থেকে তিন বা ১ থেকে ২ কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার পর এলপিজি সিস্টেম চালু করতে হবে। এতে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হওয়ার মতো সমস্যা হবে না।
এলপিজি রূপান্তরের খরচ গাড়ির ইঞ্জিন ও সিলিন্ডার ভেদে ভিন্ন হয়। দুই ধরনের সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয়। একটি সাধারণ অন্যটি ট্রডিয়াল। ট্রডিয়াল সিলিন্ডার গাড়ির অতিরিক্ত চাকার স্থানে রাখা হয় বলে বুটে প্রভাব ফেলে না। হালনাগাদ মডেলের গাড়িগুলোয় চাকা সারানোর জন্য সিলেন্ট কিট ব্যবহার করা হয় বলে অতিরিক্ত চাকা রাখার প্রয়োজনীয়তা কমে আসে। এ ক্ষেত্রে ৪০ বা ৬০ লিটারের ট্যাংক ব্যবহার করা যায়। সাধারণ সিলিন্ডারের ক্ষেত্রে ৮০ লিটার পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়। গাড়ির মডেলভেদে সর্বোচ্চ ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হয় এলপিজি রূপান্তরে।