প্রযুক্তি বিশ্বের সেরা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের সেরা উদ্ভাবনের সম্ভার নিয়ে হাজির হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাসে চলা বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রযুক্তিপণ্যের মেলা কনজ্যুমার ইলেকট্রনিক শোতে (সিইএস)। ২০ লাখ বর্গফুটের লাস ভেগাস কনভেনশন সেন্টারে (এলভিসিসি) চলা এ মেলায় তিন হাজারের বেশি স্টল রয়েছে। ফলে সব কটি স্টল ঘুরে দেখার জন্য চার দিন একেবারেই কম সময়। মূল ভেন্যু লাস ভেগাস কনভেনশন সেন্টার (এলভিসিসি) হলেও সেন্ট্রাল হল, সাউথ হল, নর্থ হল, ওয়েস্ট হল, সেন্ট্রাল প্লাজা, আউটডোর প্লাজাসহ আশপাশের আরও অনেক মিলনায়তনে হচ্ছে এ মেলা। ফলে এক দিনে একটা জোন ঘুরে দেখলেও যেন মেলার কিছুই দেখা হবে না। আর তাই দর্শনার্থীরা ছুটছেন নিজেদের পছন্দের প্রযুক্তি যে কেন্দ্রে প্রদর্শন করা হচ্ছে, সেখানে।
মেলায় প্রথম দিন উবারের চালক আমাকে এলভিসিসির ওয়েস্ট হলে নামিয়ে দিলেন। শুরু করতে চাইলাম বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন দিয়ে। কারণ, এবারই প্রথম সিইএস মেলায় বাংলাদেশি কোনো প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করেছে। অ্যাপে দেখা গেল, ওয়ালটনের স্টল নম্বর ১৭৯২৮, সেন্ট্রাল হলে। ভাবলাম, এ আর এমনকি, হেঁটেই চলে যাই এ হল থেকে। মেলার এ প্রান্ত থেকে নির্দেশনা দেখে সেন্ট্রাল হলে পৌঁছাতে সময় লাগল ৪৩ মিনিট! এত বড় প্রাঙ্গণ! আসলেই এলাহি ব্যাপার।
সেন্ট্রাল হলেই দর্শনার্থীদের ভিড় বেশি। কারণ, এখানেই স্যামসাং, সনি, এলজি, টিসিএল, নাইকন, এসকে, হাইসেন্স, প্যানাসনিকের প্যাভিলিয়ন ও স্টল রয়েছে। শুরুতেই চোখ ধাঁধিয়ে দিল এলজির প্যাভিলিয়ন। দিগন্তজোড়া এলইডি (লাইট এমিটিং ডায়োড) দিয়ে প্যাভিলিয়নের চারপাশ সাজিয়েছে তারা। গ্রাফিকের খেলাটাও এখানে বাড়াবাড়ি রকমের সুন্দর। এলজি এবার শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্রকে দেয়ালে ছবির মতো ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছে। কারণ, প্রতিষ্ঠানটির আর্ট কুল এসি দেয়ালে শোভা পাবে ছবির মতো। তবে দর্শনার্থীদের ভিড় সবচেয়ে বেশি স্যামসাংয়ের প্যাভিলিয়নে। টেকসই প্রযুক্তি, গৃহস্থালির নিরাপত্তা, পরিবারের যত্ন, স্বাস্থ্য ও বিনোদন বিভাগে ভাগ করা হয়েছে প্যাভিলিয়নটি। ফলে দর্শকেরা সহজেই নিজেদের পছন্দের পণ্য দেখার সুযোগ পাচ্ছেন। বেশির ভাগ দর্শকেরই আগ্রহ পরিবেশবান্ধব ও স্মার্ট বাড়ির প্রযুক্তিতে। স্যামসাংয়ের সব যন্ত্রেই বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।মাইক্রোপ্লাস্টিক নির্গমন কমানোর নতুন প্রযুক্তির পাশাপাশি টেলিভিশনের পর্দাযুক্ত রেফ্রিজারেটর এবং এআই ওভেন প্রদর্শন করছে স্যামসাং। স্বয়ংক্রিয়ভাবে রান্না করতে সক্ষম ওভেনটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ক্যামেরার মাধ্যমে খাবার রান্নার পরামর্শও দিতে পারে। পাতলা পর্দার টেলিভিশনটিতে রয়েছে স্বয়ংক্রিয় ক্যাপশন প্রযুক্তি। ফলে পর্দায় থাকা ছবি না ঢেকেই ক্যাপশন দেখাতে পারে টেলিভিশনটি।
স্যামসাংয়ের পাশেই রয়েছে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ওয়ালটনের প্যাভিলিয়ন। প্রতিষ্ঠানটির তৈরি টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর আর আইওটিনির্ভর স্মার্ট গৃহস্থালি পণ্যে নানান দেশের দর্শনার্থীদের বেশ আগ্রহ দেখা গেল। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী স্মার্ট শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের পাশাপাশি স্মার্ট রেফ্রিজারেটরও প্রদর্শন করছে প্রতিষ্ঠানটি। থ্রিডি এমএসও ইনভার্টার প্রযুক্তির স্মার্ট রেফ্রিজারেটরটিতে ক্লাউড কানেকটিভিটি, স্মার্ট অ্যালার্ট সিস্টেম, সুপার ফ্রিজিং প্রযুক্তি, ইউনিফরম কুলিং ফ্লো এবং আলট্রা লো নয়েজ সুবিধা রয়েছে। ওয়ালটনের প্যাভিলিয়নে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির অধিগ্রহণ করা ইউরোপিয়ান ব্র্যান্ড এসিসির তৈরি রেফ্রিজারেটরও রয়েছে। প্যাভিলিয়ন ঘুরে দেখা গেল, বিভিন্ন দেশের সম্ভাব্য ক্রেতা ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন ওয়ালটনের কর্মীরা। মেলায় নিজেদের স্টলে দিনভর উপস্থিত ছিলেন ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা গোলাম মুর্শেদ। মেলার প্রথম দিনেই বাংলাদেশি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে দর্শনার্থীদের আগ্রহ দেখে ওয়ালটনকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে আরও আশাবাদী হচ্ছেন বলে জানান তিনি। গোলাম মুর্শেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণে এবার উত্তর আমেরিকায় কার্যক্রম শুরু করেছে ওয়ালটন। সিইএসে আমরা আমেরিকা ও কানাডাভিত্তিক গৃহস্থালি পণ্যের জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান ড্যানবি অ্যালায়েন্সের সঙ্গে ব্যবসায়িক চুক্তি করেছি। এই চুক্তির ফলে আমেরিকা ও কানাডাতে এখন থেকে ওয়ালটন পণ্য পাওয়া যাবে। সিইএসে চলাকালে এমন আরও কিছু ব্যবসায়িক চুক্তি হবে বলে আশা করছি আমরা। সব মিলিয়ে সিইএসের মতো আয়োজন ওয়ালটনকে বিশ্ববাজারে তুলে ধরতে সাহায্য করবে।’
সেন্ট্রাল হলেই সনির প্যাভিলিয়নে ভিড় ‘আফিলা’ ঘিরে। গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হোন্ডার সঙ্গে যৌথভাবে তৈরি নতুন এই বিদ্যুৎ-চালিত গাড়ির একটি নমুনা প্রদর্শন করছে সনি। গাড়ির একেবারে সামনে থাকা লম্বা এলইডি পর্দা গাড়ির চেহারাই বদলে দিয়েছে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে গাড়ি চালানোর সুযোগ দিতে গাড়িতে যুক্ত করা হয়েছে ‘ককপিট এক্সপেরিয়েন্স’। আর তাই আফিলার ককপিটে বসে ছবি তোলার দীর্ঘ সারি সনির প্যাভিলিয়নে।
চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান টিসিএল গুরুত্ব দিচ্ছে টেলিভিশনে। মিনি কিউএলইডির বেশ কিছু আকর্ষণীয় টেলিভিশন নিয়ে এসেছে তারা। সেই সঙ্গে সাশ্রয়ী স্মার্ট ফোন ও স্মার্ট হোমের বিভিন্ন প্রযুক্তি ও পণ্য রয়েছে টিসিএলে। তবে সবচেয়ে বেশি ভিড় রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির গেমিং জোনে। সেখানে টিসিএলের বাঁকানো পর্দার গেমিং মনিটরে বিভিন্ন গেমের প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছেন গেমাররা। সিইএসে নিজেদের আগমনী বার্তা বড় করে তুলে ধরছে কোরীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এসকে। স্মার্টহোম ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের প্রযুক্তি আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করছে তারা। এসকের স্টলে পণ্য প্রদর্শনীর এক নতুন অভিজ্ঞতা দেখা গেল। পুরোনো সভ্যতার বিবর্তন থেকে ভবিষ্যতের উড়ন্ত গাড়িকে তারা খুবই আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরেছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের খেলায় অংশ নিয়ে পুরস্কার জেতার সুযোগও করে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। মেলার এই জোনেই রয়েছে প্যানাসনিক, হাইসেন্স, নাইকন, ক্যানন, অ্যালটেক ল্যাংসিংয়ের প্যাভিলিয়ন। নাইকনের প্যাভিলিয়নে এমআরএমসি প্রযুক্তিতে হাই স্পিড গাড়ি চালানোর ভিডিও তৈরির মজার অভিজ্ঞতা নিতে দর্শনার্থীদের সারি ছিল সবচেয়ে লম্বা। নাইকন তাদের জেড নাইন মডেলের সর্বাধুনিক ক্যামেরা প্রদর্শন করছে। এই ক্যামেরা ছবি তোলার পাশাপাশি চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রভাব বিস্তার করবে বলে মনে করছে তারা। প্রযুক্তিপণ্য প্রদর্শনের পাশাপাশি সিইএসজুড়ে আরও রয়েছে বিনোদন ও খেলায় অংশ নেওয়ার বিভিন্ন আয়োজন।
লাসভেগাস শহর এখন সিইএসের শহর। সব কটি বড় হোটেলেই সিইএস ঘিরে কিছু না কিছু হচ্ছে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো মেলা প্রাঙ্গণের বাইরে নিজেদের মতো মিটিংয়ের স্থান হিসেবে বিভিন্ন হোটেল আলাদা জায়গা ভাড়া করেছেন। মেলায় পরিচয় হওয়ার পর ব্যবসায়িক বিভিন্ন আলোচনা হচ্ছে এসব স্থানে। শহরজুড়ে দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে বিনা মূল্যে শাটল বাস। এত কিছুর পরও সিইএসে আসা দর্শনার্থীদের সংখ্যা এতটাই বেশি যে উবার আর লিফটের ভাড়া বেড়ে গেছে পাঁচ থেকে ছয় গুণ। মেলা এত বিশাল, এত বড় এবং বৈচিত্র্যময় হতে পারে সিইএসে না এলে হয়তো বিশ্বাসই করা যেত না। চার দিনের মেলা শেষ হবে ৮ জানুয়ারি।