একসময় নিজের কম্পিউটার মেরামত করার মতো টাকাও ছিল না অন্তরা মণ্ডলের। এখন তাঁর মাসিক আয় এক থেকে দেড় হাজার মার্কিন ডলার। টাকার অঙ্কে যা এক থেকে দেড় লাখের বেশি। দিনাজপুরে থাকেন। সাত ও এক বছর বয়সী দুই মেয়ে, পরিবার সামলিয়েও অন্তরা সফলতা পেয়েছেন ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিংয়ের কাজে।
অন্তরা দেখিয়ে যাচ্ছেন, প্রবল ইচ্ছা থাকলে মানুষ প্রতিকূলতা জয় করে এগিয়ে যেতে পারেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন মিরপুরের সরকারি বাঙলা কলেজ থেকে ২০১৪ হিসাববিজ্ঞানে স্নাতক হয়ে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন অন্তরা। ২০১১ সালে স্মিথ সরেনকে বিয়ে করেন। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর প্রথম মেয়ে আরিয়ানা সরেনের জন্মের পর চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোদস্তুর গৃহিণী বনে যান তিনি। তবে কিছু একটা করার আগ্রহ তাঁর সব সময়ই ছিল। বাইরে গিয়ে কাজ করবেন না—এমন ভাবনা থেকেই শুরু করেন ফ্রিল্যান্সিং। গতকাল বুধবার অন্তরা মণ্ডলের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হলে তাঁর গল্প শোনান।
বাড়িতে কম্পিউটার থাকার সুবাদে কম্পিউটারের সাধারণ কাজগুলো মোটামুটি জানতেন অন্তরা। কিন্তু ইন্টারনেটে কাজ করে স্বাবলম্বী হওয়ার ভাবনাটা আসে মায়ের কথায়। সমর্থন ও সক্রিয় সহযোগিতা করেন অন্তরার স্বামী স্মিথ সরেন। তিনি ২০১৭ সালের শুরুর দিকে ফেসবুকে খুঁজতে খুঁজতে নকরেক আইটি ইনস্টিটিউটের সন্ধান পান। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান সুবীর নকরেকের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে অন্তরাকে ভর্তি করে দেন নকরেক আইটির গ্রাফিক ডিজাইন কোর্সে। তখন গ্রাফিক ডিজাইন সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না অন্তরার। তখন অন্তরার মেয়েরে বয়স মাত্র চার মাস। চার মাস বয়সী মেয়েকে কোলে বসিয়েই কাজ শেখা শুরু করেন অন্তরা।
কাজ করতে গিয়ে অনেক প্রতিবন্ধকতা এসেছে। কিন্তু সেসব কিছুই থামাতে পারেনি অন্তরাকে। কখনো কখনো কাজ শিখতে গিয়ে সারা রাত কেটে যেত। ভোর হতো চোখের সামনে। শুরুর দিকে একবার কম্পিউটারের মাদারবোর্ড নষ্ট হয়ে যায়। সেটি সারানোর মতো টাকাও ছিল না তখন তাঁর। এখন অন্তরার এক ভাই রাশিয়ায় পড়ালেখা করেন, বোন স্নাতক (সম্মান) তৃতীয় বর্ষে পড়েন। সংসারে এসেছে সচ্ছলতা। অন্তরার এখন দুই মেয়ে। বড় আরিয়ানা সরেনের বয়স সাত বছর ও ছোট মেয়ে আরিয়া সরেনের বয়স মাত্র এক বছর।
চাঁদপুরের মেয়ে অন্তরার বিয়ে হয় দিনাজপুরে। এখন দিনাজপুরের লক্ষ্মীতলায় থাকেন, সেখানে বসেই করছেন ফ্রিল্যান্সিং। অন্তরার প্রথম কাজ ছিল ফাইভআর মার্কেটপ্লেসে (অনলাইনে ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিংয়ের কাজ দেওয়া–নেওয়ার বাজার) ফ্লায়ার ডিজাইন করার। পারিশ্রমিক ছিল মাত্র পাঁচ ডলার। সেই থেকে শুরু। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাঁকে। গ্রাফিক ডিজাইন দিয়ে শুরু করলেও বাজারে চাহিদা থাকায় ওয়েব ডিজাইন ও ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের কোর্স করেছেন। পৃথিবীর অনেক দেশে অন্তরার নির্দিষ্ট গ্রাহক রয়েছে। অন্তরা চান তাঁর মতো মেয়েরা স্বাবলম্বী হোক, অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হোক ঘরে বসেই। তিনি আরও কয়েকজন মেয়কে কাজ শিখেয়েছেন, যাঁরা নিজেরা এখন উপার্জন করতে শুরু করেছেন।
অন্তরা মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিয়ে হয়ে যাওয়া মানেই নারীর সব কিছু শেষ হয়ে যাওয়া না। চেষ্টা থাকলে অনেক কিছু করা সম্ভব। আমি আমার পরিবারকে বুঝিয়েছি এবং কাজ করার সুযোগটাও পেয়েছি। নিজের পরিবারকে বোঝাতে পেরেছি বলেই আজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ক্রেতাদেরও বোঝাতে পারছি।’
অন্তরা মনে করেন, ফ্রিল্যান্সিংয়ে ভালো করতে হলে কোনো বাধা এলে থেমে যাওয়া যাবে না। পরিশ্রম ও ধৈর্য নিয়ে কাজ শিখে দক্ষ হতে হবে। তাহলে কাজ খুঁজতে হবে না, কাজই আপনাকে খুঁজে নেবে।