ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই মুঠোফোন হাতে নেন তানভীর মাহমুদ। দীর্ঘদিনের অভ্যাস। আগে সকালে উঠেই ছাপা পত্রিকা পড়তেন, পরে মুঠোফোনে সংবাদ পড়াটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। এরপর কাজের ফাঁকে ফাঁকে চোখ বোলান ছাপা দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইনের খবরের সাইটগুলোয়। বছর পাঁচেক আগের কথা, সেদিনও ঘুম থেকে উঠেই মুঠোফোনটা চোখের সামনে নিলেন। একটি সংবাদ সামনে এল—‘ধানের দাম নেই, ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে কৃষকের আত্মহত্যা।’
ঘটনাটি দিনাজপুরের। ২০১৯ সালের। এই সংবাদ ধাক্কার মতো লাগে তানভীরের বুকে। যে কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মানুষের জন্য অন্নের সংস্থান করেন, তাঁরাই যদি সঠিক মূল্য না পেয়ে আত্মহত্যা করেন, সেটা কোনো অবস্থায় মেনে নেওয়া যায় না। সারা দিনই খবরটি নিয়ে তিনি ভাবতে থাকেন। ফেসবুকেও নানা আলোচনা হতে দেখেন। রাতে বাসায় ফিরে এই নিয়ে আরেকটু ঘাঁটাঘাঁটি করলেন তানভীর মাহমুদ। একই ধরনের আরও ঘটনা পাওয়া গেল। দেখলেন, খুব আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে কৃষকের আত্মহত্যা। একদিকে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ফসল উৎপাদন করছেন, অথচ কাঙ্ক্ষিত দাম পাচ্ছেন না। অন্যদিকে এনজিও বা মহাজনদের কাছ থেকে নেওয়া চড়া সুদের ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। সারাক্ষণ ঋণ পরিশোধের চাপ মাথায়। আবার কীটনাশক, সার ও বীজের দোকানের বাকি। পরিবারের ভরণপোষণও করতে পারছেন না ঠিকমতো। সব মিলিয়ে চরম হতাশা নিয়ে কৃষকেরা বেছে নিচ্ছেন আত্মহননের পথ।
তানভীর মাহমুদ ভাবলেন, এই যে কৃষকেরা এভাবে আত্মহত্যা করছেন, তাঁদের সন্তানেরা নতুন করে কৃষি পেশায় আসছেন না, দেশের কৃষি খাতের কী হবে তাহলে? অনবরত মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল এসব চিন্তা। তখন তিনি চিন্তা করলেন, নিজেদের স্বার্থেই তাঁদের জন্য কিছু একটা করতে হবে। দেশের কৃষিকে ধ্বংস হতে দেওয়া যাবে না এভাবে। সেই চিন্তা থেকেই নিজে এক উদ্যোগ নিলেন। চার বছর ধরে গবেষণা করে ২০২৩ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন অ্যাগ্রিকেয়ার গ্লোবাল নামের এক প্রতিষ্ঠান। শুরুতে তানভীরসহ যুক্ত হন ৭ জন উদ্যোক্তা। এখন ৪০ জনের বেশি কর্মী কাজ করছেন প্রতিষ্ঠানটিতে। ‘কৃষির যত্নে অ্যাগ্রিকেয়ার’ স্লোগান নিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। ৭ জন উদ্যোক্তা হলেন—এম এ আউয়াল, সুমন মজুমদার, ফিদা মাহমুদ, তানভীর মাহমুদ, প্রিন্স লুদ, কাউসার আলম ও এ এফ এম মোতাচ্ছেম। ২০ লাখ টাকার পুঁজি দিয়ে শুরু হওয়া এই উদ্যোগের বর্তমান মূলধন প্রায় ৫ কোটি টাকা।
অ্যাগ্রিকেয়ার গ্লোবাল লিমিটেড বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য কাজ করে। প্রথমে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করা হয়। তহবিল থেকে প্রাপ্ত অর্থ ক্ষুদ্র কৃষকদের দেওয়া হয়। কৃষকেরা এই অর্থ খেতখামারে বিনিয়োগ করেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রয়োজনীয় কৃষিবিদদের পরামর্শেরও ব্যবস্থা করে অ্যাগ্রিকেয়ার গ্লোবাল। সবশেষে উৎপাদিত পণ্য তারা নিজেরা বিক্রি করে। বিক্রীত পণ্যের লভ্যাংশ থেকে কৃষকের অংশ তাঁদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়। বাকি অর্থ বিনিয়োগকারীদের ফিরিয়ে দেয় অ্যাগ্রিকেয়ার।
এ ছাড়া অ্যাগ্রিকেয়ার গ্লোবালের নিজস্ব কিছু প্রকল্প রয়েছে, যেগুলো তারা সরাসরি পরিচালনা করে। যেমন নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ৩৩৬ বিঘা জমির ওপর একটি বড় প্রকল্প করার পরিকল্পনা রয়েছে। শিগগিরই সেখানে মুরগির খামার, ডেইরি ফার্ম, ফিশারিজ, ফিডমিল, অ্যাগ্রো, মিট প্রসেস ছাড়াও কিছু কিছু সবজি ও ফলের চাষ শুরু করবে।
অ্যাগ্রিকেয়ার গ্লোবালে সিরাজগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, টাঙ্গাইল, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও পাবনা জেলায় এখন তিন হাজারের বেশি কৃষক যুক্ত আছেন। প্রচলিত ফসলের বাইরে উচ্চমূল্যের ফসল উৎপাদনেরও ব্যবস্থা করে প্রতিষ্ঠানটি, যাতে কৃষক বেশি অর্থ আয় করতে পারেন।
অ্যাগ্রিকেয়ার গ্লোবালের সঙ্গে যুক্ত চুয়াডাঙ্গার দর্শনার চাষি মজনু মিয়া বেশ হাস্যোজ্জ্বলভাবে জানান, অ্যাগ্রিকেয়ার থেকে কৃষি পরামর্শ নিয়ে ফসলের উৎপাদন আগের তুলনায় বাড়াতে পেরেছি। এর ফলে বর্তমানে আগের তুলনায় পরিবার নিয়ে সচ্ছলভাবে চলা যাচ্ছে।
নিয়ত আলী নামের মানিকগঞ্জের কৌড়ীর এক কৃষক বলেন, ‘অ্যাগ্রিকেয়ারের কর্মীরা বিভিন্ন জমির মাটি বুঝে কোন সার কতটা দিতে হবে, তা আগেই জানিয়ে দেন। ফলে ফসল অনুযায়ী মাটিতে সঠিক মাত্রায় সার ব্যবহার করে বেশি ফসল তুলতে পারছি। এতে ফসল উৎপাদনের খরচ কমেছে, ফলে সন্তানের পড়াশোনার খরচ নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করতে হচ্ছে না।’
অ্যাগ্রিকেয়ার গ্লোবাল লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তানভীর মাহমুদ বলেন, ‘আমরা কিন্তু কৃষকদের ঋণ দিই না। আমরা মূলত কৃষি খাতে বিনিয়োগ করি। আমাদের টাকায় কৃষক সারের দোকানদারের প্রভাবমুক্ত হয়ে ভালো জাতের বীজ ও সার ন্যায্যমূল্যে কিনতে পারেন। সময়মতো সেচ দেওয়া বা খামারের পরিচর্যাও করতে পারেন। অনেক সময় আমরা নিজেরাই উন্নত জাতের বীজ সরবরাহ করে থাকি। এর ফলে কৃষকেরা ফসলের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি মাঠ থেকে ভালো দামে ফসল বিক্রি করতে পারছেন। অ্যাগ্রিকেয়ার গ্লোবালের মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ায় বিভিন্ন ব্যাংক,এনজিও বা মহাজনের ঋণের চক্র থেকেও বের হতে পেরেছেন কৃষকেরা।’