গত দুই দশকে ইন্টারনেট মানুষের হাতের নাগালে চলে এসেছে। ডায়াল-আপ (ল্যান্ডফোনের সংযোগনির্ভর) থেকে তারহীন ওয়াই-ফাই, থ্রি-জি থেকে ফাইভ-জি নেটওয়ার্কে বিবর্তন—সবকিছুই ইন্টারনেট ব্যবহারকে সহজ করেছে। তবে সবচেয়ে বড় বিপ্লব সম্ভবত স্মার্টফোনের বিস্তার।
২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের ৬৮০ কোটি মানুষের একটি করে স্মার্টফোন আছে। বর্তমানে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা ৮০০ কোটির কিছু বেশি। তাই স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর মধ্যে একটা অংশ যে শিশু, তা খুব সহজে বলা যায়।
শিশুদের হাতে স্মার্টফোন দেওয়ার ভালো বা মন্দ প্রভাব নয়, সম্প্রতি বিশেষজ্ঞরা কথা বলেছেন কখন শিশুর হাতে স্মার্টফোন দেওয়া উচিত, তা নিয়ে। যুক্তরাজ্যের বিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা অফস্টেডের প্রধান পরিদর্শক আমান্ডা স্পিলম্যানের পরামর্শ, অল্প বয়সী বাচ্চাদের অবাধে ইন্টারনেট-সুবিধা ও স্মার্টফোন দেওয়া উচিত নয়।
চলতি সপ্তাহে বিবিসি রেডিও-৫ সরাসরি এক অনুষ্ঠানে আমান্ডা স্পিলম্যান বলেন, ‘আমি ছোট শিশুদের অবাধে ইন্টারনেট দেওয়ার বিরোধী। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের কাছে স্মার্টফোন দেখলে অবাক হই। এমনকি মাধ্যমিক শুরু করা শিশুদের কাছে দেখলেও। এটা মেনে নেওয়া যায় না। শিশুরা যাতে এসব অবাঞ্ছিত বিষয় এড়াতে পারে, সে জন্য বিদ্যালয় ও অভিভাবকদের ভূমিকা রাখতে বলেছেন তিনি।
পূর্বে চালানো বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়েছে, স্মার্টফোনের পর্দায় বেশি সময় কাটানোয় শিশুরা বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা—যেমন চোখ, মানসিক চাপ, নিদ্রাহীনতা ও মেধা বিকাশের সমস্যায় পড়ে। ফোন নিয়ে বসে থাকলে শারীরিক কার্যক্রম কমে যায়। এতে স্থূলতা, আত্মসম্মান বোধ কমে যাওয়া ও মানুষের সঙ্গে মিশতে অসুবিধা হয় শিশুদের। স্মার্টফোনে সময় কাটানোর ফলে বন্ধুত্ব বজায় রাখতে ও সামাজিক ভাব বিনিময়ে তারা সময় পায় না।
সান ডিয়েগো স্টেট ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা যায়, স্মার্টফোনে সময় কাটানো মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। শুধু তা-ই নয়, দিনে মাত্র এক ঘণ্টা পর্দায় কাটানোই দুই বছরের কম বয়সী শিশুকে উদ্বিগ্ন বা বিষণ্ন করে তোলায় যথেষ্ট হতে পারে।
গত বছর আরেক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০ বছর আগের তুলনায় এখনকার কিশোর-কিশোরীরা নিঃসঙ্গতায় বেশি ভোগে। কারণ, তারা স্মার্টফোনে মগ্ন থেকে বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারে না।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের অপর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, যেসব শিশু স্মার্টফোনে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করে, তাদের মস্তিষ্কের গঠনও আলাদা হয়।
গত নভেম্বরে যুক্তরাজ্যের শিশু অধিকার কমিশনের প্রধান ডেম রাচেল ডি সুজা বলেছেন, শিশুদের স্মার্টফোন কিনে দেওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করা উচিত। মা-বাবাকে সন্তানদের সামাজিক মাধ্যমে প্রবেশের বিষয়টি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত।
২০১৭ সালে মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠা বিল গেটস জানান, বয়স ১৪ বছর হওয়ার আগে তিনি সন্তানদের স্মার্টফোন দেননি। প্রযুক্তি বিপ্লবের অগ্রনায়ক হওয়া সত্ত্বেও তিনি এখনো মনে করেন, শিশুদের ক্ষেত্রে সীমারেখা প্রয়োজন। আর রয়্যাল কলেজ অব সাইকোলজিস্টের ভাইস চেয়ারম্যান জন গোল্ডিন মনে করেন, ১১ বছরে যখন শিশুরা মাধ্যমিকে ভর্তি হয়, তখন তাদের স্মার্টফোন দেওয়া উচিত।
অবশ্য উল্টো কথাও বলছেন কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ। স্মার্টফোন প্রকৃতই শিশুদের জন্য ক্ষতিকর বলে তারা মনে করেন না। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনার ডিউক ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা বলছেন, যেসব কিশোর-কিশোরীরা বাস্তবে মিশুক অনলাইনেও তারা সম্পর্কের উন্নয়ন করতে পারে।
গত বছর স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, যে বয়সে বাচ্চারা স্মার্টফোন পায়, তার সঙ্গে তাদের সুস্থতার কোনো সম্পর্ক নেই। ২০১৯ সালে ইউনিসেফের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, যেসব শিশু ইন্টারনেট ব্যবহার করে, তাদের ডিজিটাল দক্ষতা বেশি এবং অনলাইনে শিক্ষা গ্রহণে তারা এগিয়ে।
গবেষণাটির দলনেতা ড্যানিয়েল কার্ডেফেল্ট-উইন্থার বলেছেন, মা-বাবা যদি খুব কঠোর হন, তবে তা হয়তো তাঁদের সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য অপ্রস্তুত করে তুলতে পারে। আবার কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলছেন, বয়স নয়, পরিপক্বতা বিবেচনায় স্মার্টফোন দেওয়ার বিষয়টি আসবে। আর ব্যক্তিভেদে পরিপক্বতার বয়সও ভিন্ন হয়।
সূত্র: ডেইলি মেইল