তমসা চাকমা। খাগড়াছড়ি জেলার তরুণ এই নারী পড়াশোনার পাশাপাশি এখন একজন উদ্যোক্তা। ত্বক পরিচর্যার আমদানি করা পণ্য (স্কিনকেয়ার প্রডাক্ট) বিকিকিনি করা হয় তাঁর উদ্যোগ থেকে। নিজের জমানো পাঁচ হাজার টাকা বিনিয়োগে শুরু হয়েছিল এই উদ্যোগ। এখন তিনি লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করছেন প্রতি মাসে। তমসার শুরুটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে, যা ‘এফ–কমার্স’ নামে পিরিচিত। তমসা চাকমা গত এপ্রিলে খাগড়াছড়িতে একটি দোকানও চালু করেছেন। ত্বক পরিচর্যার পণ্যের পাশাপাশি মেয়েদের পোশাকও বিক্রি করছেন সেখানে। সব মিলিয়ে মাসে বিক্রির পরিমাণ সাত থেকে আট লাখ টাকা। নিজের পরিবারের খরচও মেটাচ্ছেন তমসা চাকমা। ১ জুন রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে বসে নিজের এফ–কমার্স উদ্যোগের বিস্তারিত জানালেন তিনি।
তমসা চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৯ সালে ফেসবুকে বিভিন্ন পেজ দেখে মাথায় আসে নিজে কিছু একটা করার। তখন থেকে কীভাবে পণ্যের তথ্য পোস্ট করতে হবে, কীভাবে ছবি তুলতে হবে, তা নিয়ে ভাবতে থাকি। ইউটিউবে বিভিন্ন ভিডিও দেখে শিখতে লাগলাম। ফেসবুকে কীভাবে পণ্যের বিপণন করতে হবে, সেসবও দেখতে থাকি।’ একটা সময়ে ‘তমসা ক্লোজেট’ ফেসবুক পেজ খোলেন তমসা চাকমা। নিজেই পণ্যের ছবি তুলে পোস্ট করতেন এবং ছোট ছোট ভিডিও বানাতেন। এভাবেই শুরু তমসা ক্লোজেটের।
তমসা এখনো ছাত্রী। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইনোভেশন অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ বিভাগে স্নাতক তৃতীয় বর্ষে পড়েন তিনি। তমসা চাকমার বাবা মেঘবিন্দু চাকমা পানছড়ি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, মা কুন্তি চাকমা একজন গৃহিণী। তমসা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা সম্পন্ন করেছেন খাগড়াছড়ি ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে। বিজ্ঞান বিভাগের এই ছাত্রী কখনো ভাবেননি যে একদিন নিজে উদ্যোক্তা হতে পারবেন।
শুরুটা ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে। এক বছর পার হওয়ার আগেই ২০২০ সালে বাদ সাধে করোনা মহামারি। ব্যবসা থেমে গিয়েছিল অনেকটাই, তবু তমসা থামেননি। পূর্ণোদ্যমে চালিয়ে যান কাজকর্ম। সবচেয়ে বেশি সমর্থন পেয়েছিলেন পরিবারের কাছ থেকে। নিজেই জানালেন, তাঁর আজকের সফলতার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান তাঁর বাবার। ‘শুরুর দিন থেকে বাবা আমাকে সাহস দিয়ে গেছেন, এখনো দিচ্ছেন। কোভিডের সময় এমনও হয়েছে, আমি আর বাবা ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছে দিতাম।’
পরবর্তী সময়ে তমসা বেশি সমর্থন ও উৎসাহ পেয়েছেন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিভাগের অগ্রজ ও অনুজদের কাছ থেকে। এর বিপরীত চিত্রও কিন্তু তমসা দেখেছেন। বিশেষ করে ব্যবসার শুরুর দিকে আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীর অনেকে বলতেন, একজন মেয়ে হয়ে কেন তিনি ব্যবসা করবেন? যদি বাড়ি বাড়ি ঘুরে পণ্য সরবরাহই করতে হয়, তাহলে পড়াশোনা করে লাভটা কী হলো? ব্যবসাও হবে না, পড়াশোনাও শেষ!
এসব কথায় কোনো দিন কান দেননি তমসা চাকমা। এ ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা রেখেছেন তাঁর বাবা। বাবা মেঘবিন্দু চাকমা তাঁকে একটি কথাই শুধু বলেছিলেন, ‘ব্যবসা করছ, ভালো কথা। আমি তোমার সঙ্গে আছি। কিন্তু একটি শর্ত, পড়াশোনা অবশ্যই খুব ভালোভাবে চালিয়ে নিতে হবে।’
তমসা চাকমা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকে তাঁর ব্যবসা আরও গতি পেয়েছে। নিজের বিভাগের পরিবেশ ছিল দারুণ। এ সময় তমসা দেখেন যে তিনি একা নন, তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও অনেকে কোনো না কোনো ব্যবসায়িক উদ্যোগের সঙ্গে। প্রায় সবাই পড়াশোনার বাইরে কিছু না কিছু করছেন। এ সময় বিনিয়োগ, মেন্টরিং, ইন্ডাস্ট্রিতে যোগাযোগ, আইনি সহায়তাসহ নানা বিষয় শিখলেন নিজের বিভাগ থেকে। সাহস বেড়ে গেল আরও।
নিজের আগ্রহের কারণেই সৌন্দর্যচর্চার বিষয়ে খোঁজখবর রাখতেন। মোটামুটি ভালো একটি ধারণা হয়েছিল তাঁর। এসব কারণেই তিনি এ ব্যবসা বেছে নিয়েছেন। শুরু তো করেছিলেন মাত্র পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে। সেই চারাগাছ আজ ফলদ বৃক্ষে পরিণত হয়েছে। এফ–কমার্সে শুরু হওয়া উদ্যোগ থেকে এখন পণ্যের দোকানে পরিণত হয়েছে তমসা ক্লোজেট।
নিজের শুরুকে শিক্ষা ক্ষেত্র হিসেবেই দেখেন তমসা। তিনি পরিকল্পনা না করে হাঁটেননি এক পা–ও। ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির ইনোভেশন অ্যান্ড এন্টারপ্রেনিউরশিপ বিভাগে ভর্তির কারণও এটা। এই বিভাগে পড়াশোনা করে নিজেকে ঝালিয়ে নিয়েছেন ক্রমাগত। জানতে পেরেছেন উদ্যোক্তা হওয়ার ধাপগুলো। সেসব ধাপ অবলম্বন করে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেছেন।
তমসা চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি বান্দরবান—এই তিন জেলায় আমি আমার নিজের ব্র্যান্ডকে আগে দাঁড় করাব। কারণ, আমার ক্রেতাদের বেশির ভাগই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্য। আমি তাঁদের জন্যই এসব স্থানে কাজ করব। কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও জাপানের পণ্য আমদানীকারকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে আমি খুচরা পর্যায়ে বিক্রি করে থাকি।’
নিজের একটি বড় স্বপ্নের কথা জানালেন তমসা চাকমা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমার স্বপ্ন নিজেকে এমন একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়া, যেখান থেকে আমার মা–বাবাকে যেকোনো কিছু যেন দিতে পারি।’
তমসা ক্লোজেটের আরও শাখা চালু করতে চান তমসা চাকমা। সেই সঙ্গে তাঁর চাওয়া, বাংলাদেশের ঘরে ঘরে নারী উদ্যোক্তা তৈরি হোক। প্রত্যেকে নিজের জন্য, নিজের পরিবারের জন্য কিছু করুক। বাইরের কেউ যেন একবারের জন্যও তাঁদের বোঝা না ভাবতে পারেন।