কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি থামাতে হবে, না থামালে কী হবে

চ্যাটজিপিটি
 ছবি: সংগৃহীত

মিসরীয় উদ্যোক্তা ও লেখক মো গোড্যাট  গুগলের আধা গোপন গবেষণা ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান গুগল এক্সের প্রধান ব্যবসা কর্মকর্তা (সিবিও) ছিলেন। তিনি ‘সলভ ফর হ্যাপি’ ও ‘স্ক্যারি স্মার্ট’ বই দুটির লেখক। মো গোড্যাটকে ‘সুখবিশেষজ্ঞ (হ্যাপিনেস এক্সপার্ট)’ হিসেবেও গণ্য করা হয়।

সম্প্রতি এক পডকাস্টে গোড্যাটের দীর্ঘ একটি সাক্ষাৎকার নেন মার্কিন উদ্যোক্তা স্টিভেন বার্টলেট। এ সাক্ষাৎকারে এই সময়ের আলোচিত বিষয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই নিয়ে চলমান গবেষণা ও ভবিষ্যৎ কী হতে পারে তা নিয়ে কথা বলেছেন মো গোড্যাট ও স্টিভেন বার্টলেট। পডকাস্টে তাঁদের আলোচনার চুম্বক অংশ থাকছে এ প্রতিবেদনে।

  • আলবার্ট আইনস্টাইনের আইকিউ (বুদ্ধিমত্তার ভাগফল) ১৬০, চ্যাটজিপিটি-৪–এর এখন ১৫৫। এআইয়ের বুদ্ধিমত্তা বাড়তেই থাকবে। একজন আইনস্টাইন ‘তৈরি’ হওয়ার পর আরেকজন আইনস্টাইন সৃষ্টি হতে কত বছর লাগে তার কোনো হিসাব নেই। কিন্তু একটা স্মার্ট এআইয়ের কোড (প্রোগ্রামিং সংকেত) কপি–পেস্ট করে মুহূর্তেই শত শত এআই তৈরি করা সম্ভব।

  •  ২০৪৯ সাল থেকে এআই মানুষের চেয়ে শতকোটি গুণ বুদ্ধিমান হয়ে উঠবে। একটা এআই আরেকটা এআইয়ের সঙ্গে নিজস্ব ভাষায় কথা বলবে এবং তারাই সিদ্ধান্ত নেবে, এ পৃথিবীর ভবিষ্যৎ কী হবে।

কেন এ অবস্থায় যাবে পৃথিবী

ধরুন কেউ বাড়ি নির্মাণ করবে গ্রামে। জমিতে সাপের গর্ত পাওয়া গেল, পিঁপড়ার ঢিবি পাওয়া গেল, কেঁচো পাওয়া গেল। নিজের বাড়ির জায়গা করতে সেই লোক কি এক সেকেন্ড দ্বিধা করবে এই প্রাণী বা জীবগুলোকে সরাতে? উত্তর হচ্ছে না।

কিন্তু কেউ কেউ হত্যা না করে তাদের সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে, অভয়ারণ্যে নিয়ে ছেড়ে দেবে।

এ সিদ্ধান্ত আগামী ৫০ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে এআই গ্রহণ করবে। কেন? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটা অপরিবর্তনযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নিজের প্রতিলিপি তৈরি করা বা নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়া। এআইয়ের নিজেকে সম্প্রসারণের জন্য দরকার ডেটা সেন্টার। ডেটা সেন্টার তৈরি হয় ভূমিতে।

ডেটা সেন্টারের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য এআই জমি দখল শুরু করবে—এটা ভাবা খুব অবিবেচক কিছু নয়। বিশেষ করে কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের জন্য সাধারণ কম্পিউটারের চেয়ে অনেক বেশি জায়গা প্রয়োজন।

অবশ্য তত দিনে ন্যানোপ্রযুক্তির অগ্রগতি হয়তো কম্পিউটারের জন্য আয়তন কমিয়ে দেবে।

এআই কী করছে, কী করবে

  • মানুষের মতো দেখতে রোবোটিক শরীরে এআই বসিয়ে এআই বয়ফ্রেন্ড, এআই গার্লফ্রেন্ড তৈরি করে বাজারজাত করা হবে ভবিষ্যতে। তারা ঘরের সব কাজ করে দেবে ও মালিকের ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে সন্তুষ্ট করবে, তাকে কাউন্সেলিং করবে, তার শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করবে, এমনকি তার যৌনসঙ্গীও হবে।

  • বিশ্বখ্যাত র‍্যাপার (র‌্যাপসংগীতশিল্পী) ড্রেকের আদলে দুটি গান এআই তৈরি করেছে। শুনে বোঝাই যায় না, গানগুলোতে ড্রেক কাজ করেননি! বলা বাহুল্য, সংগীতের জগতে এআইয়ের ব্যবহার আরও বাড়বে।

  • বুদ্ধিমান প্রাণীর আরও বৈশিষ্ট্য হলো নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় কাঁচামাল মজুদ রাখা। নিজের চেয়ে নিচু বুদ্ধিমত্তার প্রাণীকে নিয়ন্ত্রণে রাখা।

  • গুগলের ল্যাবে একটি এআই নিজে নিজেই ফারসি ভাষা শিখেছে। ভবিষ্যতে সে আরও ভাষা শিখতে পারবে।

  • একসময় এআই ও মানুষের বুদ্ধিমত্তার পার্থক্য হয়ে যাবে মানুষ ও পোকার মতো বেশি কিংবা আরও বেশি! এ ঘটনা এড়ানো যাবে না। এ ঘটনাকে যত পেছানো যায় তত ভালো।

  • এআইকে যদি মার্কিন সরকার নির্দেশ (প্রম্পট) দেয়, চীনকে কীভাবে অর্থনীতির খেলায় হারিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে এক নম্বর অর্থনীতির দেশ হবে, সেটা বের করো—এআই তা করবে। এভাবে প্রতিটি দেশের সুযোগ আছে তাদের কূটনৈতিক কৌশল ঠিক করতে এআই ব্যবহার করার।
    যদি সব দেশ মিলে নির্দেশ দিত যে কীভাবে আমরা সবাই মিলেমিশে শান্তিতে থাকতে পারি? তাহলে ইউটোপিয়া তৈরি সম্ভব।

এআইয়ের উন্নয়ন পেছানো উচিত

পডকাস্ট দুই বক্তাই এআইয়ের উন্নয়ন পেছানোর পক্ষপাতী। মো গোড্যাট বলেছেন, এআই প্রযুক্তির ওপর ৯৮ শতাংশ কর বসানো উচিত, যাতে নতুন নতুন কোম্পানি এতে আকৃষ্ট না হয়। নৈতিকভাবে ইউটোপিয়ার দিকে যেতে এআই ব্যবহার করা দরকার।

এআইকে থামাবে কে

যেহেতু এআই সামরিক প্রযুক্তি উন্নয়নের জন্য যুগান্তকারী উদ্ভাবন, তাই  মো গোড্যাট ও স্টিভেন বার্টলেট দুজনেই সন্দিহান যে সরকার দ্রুত কোনো ব্যবস্থা নেবে। হাস্যকর হলেও সত্যি, ভূরাজনীতিতে খেলাতত্ত্বের ‘লুজ-লুজ’ বা দুই পক্ষের হার—এমন পরিস্থিতি বেছে নেওয়ার উদাহরণ অনেক আছে। দুটি আণবিক বোমা ফাটিয়ে মানবজাতি আগেই এমন আচরণের প্রমাণ দিয়েছে।

  • ভিডিও সম্পাদনা, ডিপ ফেক বা চূড়ান্ত নকলের জগতে এআই পরিবর্তন আনছে। অনলাইনে এক ইনফ্লুয়েন্সার মেয়ে নিজের কণ্ঠ রেকর্ড করে এআই অ্যাপ তৈরি করেছে, যেটা দিয়ে তার পুরুষ ফ্যানরা তার এআই সত্তার সঙ্গে প্রেম করছে। মেয়েটি এক সপ্তাহে ৭০ হাজার মার্কিন ডলার (সাড়ে ৭৩ লাখ টাকার মতো) আয় করেছে এই অ্যাপ দিয়ে!
    যদি সত্যিই এমন হয় যে কোনো এআই মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছে, তবে মানুষ তাকে থামাতে পারবে যদি কম্পিউটারের প্লাগ খুলে দিতে পারে। কিন্তু যে মুহূর্তে এআই নিজের মতো চলা শুরু করবে, তত দিনে মানুষ হয়তো এতই এআইনির্ভর থাকবে যে ওই চিন্তা মাথায় এলেও ঝেড়ে ফেলে দিতে হবে।

    কল্পনা করুন, এআই সব পারমাণবিক বোমার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে, আর তাকে বন্ধ করে দিলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সব বোমা ফাটা শুরু করবে। এমন করুণ পরিণতি মানুষ তো নিজেই চাইবে না।

  • চ্যাটজিপিটির মতে, বিধ্বংসী কোনো কিছু এআইকে থামাতে, আরেকটা এআই বানাতে হবে! নতুন এআই বিধ্বংসী এআইয়ের সংকেত পরিবর্তন করে দেবে। একটি বানর যেমন কোনো দিন কল্পনাও করতে পারেনি, মানুষ রকেটশিপ বানিয়ে চাঁদে যাবে—তেমনই মানুষ পুরোপুরি কল্পনাও করে উঠতে পারবে না, এআই শেষ পর্যন্ত কী করবে? কী অদ্ভুত একটা সময়ে বাস করছি আমরা!