চাকরি করছিলেন সাত বছর ধরে। মাসিক বেতন ছিল লাখ টাকার মতোই। সেই চাকরি ছেড়েছিলেন গ্রামের মানুষকে তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণ দেবেন বলে। এই চিন্তা থেকে শুরু। গত পাঁচ বছরে ১৩ হাজারের বেশি মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে গড়ে তুলেছেন শামীম হুসাইন। তথ্যপ্রযুক্তি আউটসোর্সিং খাতে মুক্ত পেশাজীবী বা ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করছেন শামীমের কাছে প্রশিক্ষিতরা। এই তরুণেরা এখন বাংলাদেশের জিডিপিতেও অবদান রাখছেন। আর শামীম নিজেও মাসে প্রায় পাঁচ হাজার ডলার আয় করেন, যা বাংলাদেশি টাকায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার মতো।
কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১১ সালে ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক শামীম হুসাইন ২০১১ সালে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। ডেভেলপার (অপারেশনস) হিসেবে। তিন বছর কাজ করার পর বহুজাতিক সেই সফটওয়্যার কোম্পানির প্রধান হঠাৎ একদিন তাঁকে সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং দলের প্রধান বানিয়ে দেন। ছিলেন প্রকৌশলী, হলেন বিপণন দলের প্রধান।
বিপণনের প্রায় কিছুই না জানা শামীম নিজ উদ্যোগে শেখা শুরু করলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিপণনের পাশাপাশি শামীম ডিজিটাল বিপণন শিখতে থাকেন। পেশার ক্ষেত্রে যেহেতু বিপণনের দিকে যাচ্ছে, শামীম সিদ্ধান্ত নেন কোর্স করার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট (আইবিএ) থেকে একটা ডিপ্লোমা কোর্স করেন। শামীমের দক্ষতা দেখে চাকরিজীবনের সাড়ে তিন বছরের মাথায় কোম্পানির প্রধান তাঁকে ডিজিটাল মার্কেটিং ম্যানেজার হিসেবে পদোন্নতি দেন।
এই ক্ষেত্রে এসে শামীম বুঝতে পারেন, এখানে দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে। বাংলাদেশে ডিজিটাল বিপণন বলতে শুধু ফেসবুক আর এসইও (সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) শেখানো হয়। কিন্তু এত বড় একটা খাতের অন্যান্য বিষয়ে বাংলাদেশে সে রকম দক্ষ মানুষ নেই। বিষয়টি শামীম বুঝতে পারেন, যখন তাঁর দলের জন্য একজন গুগল অ্যাডস ও ওয়েব অ্যানালিস্টের প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশ থেকে মনের মতো কাউকে পাওয়া যায়নি। পরে ভারত থেকে একজনকে এনে নিয়োগ দিতে হয়েছিল। তখনই শামীম চিন্তা করলেন তার নিজের দক্ষতাই যদি বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তবে একটা কাজের কাজ হবে। তারা যেমন দেশের বাজারে সহযোগিতা করতে পারবে, তেমনি আন্তর্জাতিক বাজার থেকেও আয় করতে পারবে।
নতুন কিছু করতে গেলে চাকরিটা ছাড়তে হবে। কারণ, নিয়ম অনুযায়ী চাকরিতে থাকার সময় কোনো কাজ করা যাবে না। চাকরিজীবনে শামীম মাসে লাখ টাকার মতো বেতন পান। শামীম চাকরি ছেড়ে দিয়ে যোগ দিলেন একটা ছোট প্রতিষ্ঠানে। বেতনও আগের থেকে কম। কিন্তু তিনি শর্ত দিলেন চাকরির পাশাপাশি তাঁকে অন্য কাজ করতে দিতে হবে।
২০১৮ সালে শুরু হলো শামীমের ফ্রিল্যান্সিং। প্রোফাইল তৈরি করলেন ফাইভার মার্কেটপ্লেসে (অনলাইনে আউটসসোর্সিং করার ওয়েবসাইট)এবং শুরু করলেন অ্যামাজনের জন্য অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং। প্রথম আলোকে শামীম বলেন, ‘অর্থনৈতিক সচ্ছলতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে বুকভরা আশা আর চোখভরা স্বপ্ন নিয়ে শুরু করলেন জীবনের আরেক অধ্যায়। সারা রাত কাজ করি আর সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য বাসের পেছনে ছুটি। ১৩ দিনের মাথায় ঘুম থেকে উঠে দেখি, ৫৫ ডলারের কাজের অর্ডার এসেছে। যেন স্বপ্ন ধরা দিতে শুরু করেছে।’
রাতভর ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ, সকালে অফিস। একটা ল্যাব ভাড়া নিয়ে শুক্রবার ছুটির দিনে শুরু করলেন ডিজিটাল বিপণন নিয়ে সেমিনার। এইভাবে কিছুদিন করার পর প্রতিষ্ঠা করলেন নিজের প্রতিষ্ঠান ‘স্কিলআপার’। উদ্দেশ্য একটাই, কম খরচে ডিজিটাল বিপণনের দক্ষতাগুলো বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া, যাতে তাঁরা ঘরে বসেই ফ্রিল্যান্সিং করে টাকা আয় করতে পারে।
এখন পর্যন্ত ১৩ হাজারের বেশি মানুষকে ডিজিটাল বিপণন প্রশিক্ষণ দিয়েছেন শামীম। তিনি ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের ৩টি বড় খাত—গুগল অ্যাডস, ওয়েব অ্যানালিটিক্স এবং সার্ভার-সাইড ট্র্যাকিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। শামীম হুসাইন বলেন, এঁদের কেউ কেউ মার্কেটপ্লেসে কাজ করেন। পাঁচ লাখ ডলারের বেশি বা প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা রেমিট্যান্স এনে দেশের জিডিপিতে অবদান রাখছেন।
মো. রফিকুল ইসলাম ও নুরজাহান বেগমের দ্বিতীয় সন্তান শামীম হুসাইনের বাড়ি ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা থানার আগুনিয়া পাড়া গ্রামে। শামীমের স্বপ্ন, পাঁচ লাখ মানুষকে প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষিত করা, যাতে তাঁরা গ্রামে বসেই ফ্রিল্যান্সিং করে উপার্জন করতে পারেন। সেই লক্ষ্যে অক্লান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছেন শামীম হুসাইন।