গুগলের অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহারে হুয়াওয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়তে শুরু করবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যযুদ্ধের ফল এ নিষেধাজ্ঞা। দ্রুত যদি এ সমস্যার সমাধান না হয়, তবে হুয়াওয়ের ভবিষ্যৎ স্মার্টফোনগুলোতে গুগলের সেবাগুলোর অভিজ্ঞতা নেওয়ার সুবিধা সীমিত হয়ে যাবে। এমনকি হুয়াওয়ে অ্যান্ড্রয়েড প্ল্যাটফর্ম পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেমে চলে যেতে পারে।
বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, হুয়াওয়ের ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞা দীর্ঘায়িত হবে কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়।
গত বুধবার ট্রাম্প প্রশাসন আনুষ্ঠানিকভাবে হুয়াওয়েকে যুক্তরাষ্ট্রে ‘কালো তালিকাভুক্ত’ করে। এতে সরকারি অনুমোদন ছাড়া মার্কিন সংস্থা থেকে হুয়াওয়ের জন্য প্রযুক্তিসেবা নেওয়ার পথ বন্ধ করা হয়। হুয়াওয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞায় যুক্তরাষ্ট্রের অনেক প্রতিষ্ঠান চীনের এ বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করছে।
ট্রাম্পের নির্দেশে হুয়াওয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা এলেও গুগল কর্তৃপক্ষ বিশ্বে বিক্রির দিক থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্মার্টফোন বিক্রেতার সঙ্গে পুরোপুরি সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইছে না। হুয়াওয়ের ফোন এখন বিশ্বের ৫০ কোটি মানুষের হাতে।
ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যুরো অব ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড সিকিউরিটি গুগলকে একটি লাইসেন্স দিতে পারে, যাতে গুগল হুয়াওয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারে। এমনকি পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতেও পারে। কিন্তু সমস্যা দ্রুত সমাধান না হলে এর ফল ভিন্ন হতে পারে।
গুগলের পক্ষ থেকে হুয়াওয়ের সঙ্গে এখন সব ধরনের ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার ও কারিগির সেবার সব কার্যক্রম রয়েছে। তবে এতে গুগলের অ্যান্ড্রয়েডের পুরোপুরি অ্যাকসেস হারাচ্ছে না হুয়াওয়ে। কারণ, কোর অপারেটিং সিস্টেমটি ওপেন সোর্স। এটি যেকোনো উৎপাদনকারী পরিবর্তন করে তাদের ডিভাইসে যুক্ত করতে পারে। এর জন্য অনুমতি দরকার হয় না। তবে অধিকাংশ স্মার্টফোন নির্মাতাকে বিভিন্ন সাপোর্ট বা সফটওয়্যার আপডেট সুবিধার জন্য গুগলের ওপর নির্ভর করতে হয়। গুগল বিভিন্ন অ্যাড অনের ওপর নিয়ন্ত্রণ রেখেছে।
বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইডিসির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের বাজারে ৩১ লাখ ইউনিট হ্যান্ডসেট এনেছে হুয়াওয়ে। বাজার দখলের হিসেবে হুয়াওয়ে অ্যাপল ও স্যামসাংয়ের পরের অবস্থানে রয়েছে সেখানে। যুক্তরাজ্যে কম্পিটাবিলিটি টেস্ট স্যুইট (সিটিএস) ও ভেন্ডর টেস্ট স্যুইট (ভিটিএস) নামের অনুমোদনপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় হুয়াওয়েকে।
এর ফলে গুগল তাদের নতুন সংস্করণের পণ্য ও প্লে মার্কেটপ্লেসের অথোরাইজড ডাউনলোড সেবা দিতে পারবে। এতে হুয়াওয়ের সঙ্গে তাদের সরাসরি চুক্তি করতে হবে না। তবে নিরাপত্তা হালনাগাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও জটিল। অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইস নির্মাতাদের বিভিন্ন নিরাপত্তাত্রুটি ঠিক করতে আগেভাগেই সফটওয়্যার হালনাগাদ দেয় গুগল। এখন হুয়াওয়ে আগেভাগেই সে নিরাপত্তা আপডেট পাবে না। অ্যান্ড্রয়েড ওপেন সোর্স প্রজেক্টের জন্য যেদিন নিরাপত্তা হালনাগাদ করা হবে, সেদিনই কেবল হুয়াওয়ে তা পাবে। এর ফলে ওই নিরাপত্তা আপডেট দিতে দেরি হবে হুয়াওয়ের।
হুয়াওয়ের পক্ষ থেকে অবশ্য প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে, স্মার্টফোনে সিকিউরিটি আপডেট দেবে তারা। এ ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে, কোনো মারাত্মক সফটওয়্যারত্রুটি দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে হুয়াওয়ের ফোনে তার হালনাগাদ সফটওয়্যার আপডেট পাওয়া যাবে না।
নতুন হ্যান্ডসেট নিয়ে বেশি সমস্যায় পড়বে হুয়াওয়ে। নতুন ফোনগুলোর জন্য সনদ না পেলে গুগল মোবাইল সার্ভিসেস (জিএমএস) তাতে প্রিইনস্টল করা থাকবে না। এতে গুগলের নিজস্ব অ্যাপ, যেমন: প্লে স্টোর, গুগল ফটোজ, ইউটিউব, গুগল ম্যাপস, গুগল ড্রাইভ ক্লাউড স্টোরেজ, গুগল ডুয়ো ভিডিও কলের মতো সেবা পাওয়া যাবে না।
চীনা স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে এতে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। কারণ, সেখানে গুগলের অধিকাংশ সেবা বন্ধ। তবে অন্যান্য দেশে এর ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে। সেখানে বিকল্প স্টোরগুলো থেকে থার্ড পার্টি অ্যাপ ডাউনলোড করা যাবে। এ প্রক্রিয়াটি ‘সাইড-লোডিং’ নামে পরিচিত। তবে গুগল থার্ড পার্টি অ্যাপ ডাউনলোড প্রতিরোধ করে। এতে অ্যাপ নির্মাতারা গুগল এপিআই ব্যবহারের সুযোগ না পাওয়ায় তাদের কার্যক্রমে সমস্যা হতে পারে। যেমন পুশ নোটিফিকেশনের মতো সেবার ক্ষেত্রে সমস্যা হবে।
প্রযুক্তিবিষয়ক ওয়েবসাইট এক্সডিএ ডেভেলপার্স ডটকমের সম্পাদক মিশাল রহমান বলেন, অ্যান্ড্রয়েডের সাম্প্রতিক সংস্করণেই হুয়াওয়ে আটকে যাবে—এমন গুঞ্জন রয়েছে। তবে অ্যান্ড্রয়েড কিউয়ের সোর্স কোড ইতিমধ্যে উন্মুক্ত হয়ে গেছে। ২০২০ সালের অ্যান্ড্রয়েড আর সংস্করণ থেকে সমস্যায় পড়তে পারে হুয়াওয়ে। শীর্ষ অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন নির্মাতা হিসেবে স্যামসাং ও হুয়াওয়ে গুগলের কাছ থেকে আগেভাগে সোর্স কোড পেয়ে আসছে। এতে তারা আগেভাগে নিজস্ব সফটওয়্যারের প্রস্তুতি নিতে পারে। সফটওয়্যারের আগাম সংস্করণ না পেলে হুয়াওয়ের নিজস্ব সফটওয়্যার তৈরিতে সময় লাগবে।
তবে হুয়াওয়ের ক্ষেত্রে বড় বাধা হবে, অ্যান্ড্রয়েড সোর্স কোর্ড ব্যবহার করে ডিভাইস বিক্রি করলে তারা তাকে বৈধ অ্যান্ড্রয়েড ফোন বলতে পারবে না।
হুয়াওয়ে কর্তৃপক্ষ বলেছে, তারা অ্যান্ড্রয়েডকে অগ্রাধিকার দিলেও দ্বিতীয় পরিকল্পনা হিসেবে নতুন অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করেছে। এ ছাড়া সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে তারা পরিকল্পনা করছে।
হুয়াওয়ে যুক্তরাজ্যের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট জেরেমি থম্পসন বলেছেন, ‘আমাদের বিকল্প আছে, যা গ্রাহককে খুশি করবে। স্বল্পমেয়াদে হুয়াওয়ের জন্য সুখবর না হলেও আমরা মানিয়ে নিতে পারব।’
হুয়াওয়ের কনজুমার ব্যবসা বিভাগের প্রধান রিচার্ড ইয়ু অ্যান্ড্রয়েডের বিকল্প তৈরির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। চীনে এ নিয়ে খুব বেশি সমস্যা হবে না। কারণ, সেখানে অধিকাংশ মানুষ উইচ্যাট ব্যবহার করেন। তবে অন্য ডেভেলপারদের দ্রুত নতুন অপারেটিং সিস্টেমের জন্য অ্যাপ তৈরিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। অন্যান্য দেশে এটি কিছুটা সমস্যা তৈরি করবে।
মিশাল রহমান বলেন, নতুন মোবাইল অপারেটিং সিস্টেমের সফলতা নির্ভর করছে এতে থাকা অ্যাপের ওপর।
অ্যাপলের পর অ্যান্ড্রয়েড এখন পর্যন্ত বৃহত্তম ডেভেলপার প্ল্যাটফর্ম।
আরও পড়ুন:
হুয়াওয়ের কপালে কী আছে?