স্মার্টফোন, নেটওয়ার্ক যন্ত্রপাতিসহ প্রযুক্তি দুনিয়ায় পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে পেছনে ফেলে হুয়াওয়ে তর তর করে এগোচ্ছে। একই সঙ্গে চীনের এই প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানটিকে ঘিরে পশ্চিমা দেশগুলোর সন্দেহ বাড়ছে। হুয়াওয়ের ওপর কড়া নজর রাখছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দারা। সেই সন্দেহের বশেই কানাডায় গ্রেপ্তার হয়েছেন হুয়াওয়ের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (সিএফও) মেং ওয়ানঝু। তাঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের বিষয়টি এখনো জানা যায়নি। এ ঘটনায় হুয়াওয়ের ওপর কি প্রভাব পড়তে পারে?
দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশে চীনের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (সিএফও) মেং ওয়ানঝুকে আটক করেছে কানাডা। বিষয়টি পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থা ও বেইজিংয়ের মধ্যে প্রযুক্তিগত স্নায়যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। বিষয়টি হুয়াওয়ের জন্য আকস্মিক বিপত্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্র যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, তা অমান্য করে হুয়াওয়ে তাদের কাছে টেলিকম যন্ত্রপাতি বিক্রি করেছে বলে যুক্তরাষ্ট্র সন্দেহ করছে।
দ্য গার্ডিয়ানের ডটকমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যদি যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার বিষয়টি প্রমাণ করতে পারে, তবে হুয়াওয়ের জন্য বিপদ হতে পারে। বিশ্বের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বাজারে জায়গা হারাতে পারে হুয়াওয়ে।
স্নায়যুদ্ধের শুরুটা করেন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান অ্যালেক্স ইয়াংগার। চলতি সপ্তাহে তিনি মন্তব্য করেন, ‘যুক্তরাজ্যের টেলিকম নেটওয়ার্কে হুয়াওয়ের যুক্ত থাকার বিষয়ে আমাদের আলোচনায় বসতে হবে।’ গত বুধবার একটি মোবাইল নেটওয়ার্ক থেকে নেটওয়ার্ক কিট সরিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটে।
যুক্তরাজ্যে ৫জি নেটওয়ার্ক তৈরি করছে টেলিকম প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ টেলিকম (বিটি)। এই নেটওয়ার্কের মূলে হুয়াওয়ের কোনো যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হবে না বলে প্রতিবেদনে জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনবিসি। বিটির বর্তমান ৩জি ও ৪জি নেটওয়ার্ক থেকেও হুয়াওয়ের যন্ত্রাংশ বাদ দেওয়ার ঘোষণা এসেছে। ২০১৬ সালে টেলিকম প্রতিষ্ঠান ইই-কে অধিগ্রহণ করেছে বিটি। দেশ জুড়ে ৫জি নেটওয়ার্ক চালু করতে ওই প্রতিষ্ঠানের বর্তমান নেটওয়ার্কই ব্যবহার করবে তারা।
সিএনবিসিকে দেওয়া এক ইমেইলে বিটির এক মুখপাত্র বলেন,৩জি ও ৪জি নেটওয়ার্ক থেকে হুয়াওয়ের যন্ত্রাংশ সরানোর কাজ ২০১৬ সাল থেকেই শুরু হয়েছে।
আগের সপ্তাহেই নেটওয়ার্ক নিরাপত্তায় গুরুতর ঝুঁকির কথা জানিয়ে ৫জি নেটওয়ার্কে হুয়াওয়ের যন্ত্রাংশ ব্যবহারের পরিকল্পনা বাতিল করেছে নিউজিল্যান্ড সরকার। এর আগে হুয়াওয়ের প্রযুক্তি ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র।
২০১৫ সাল থেকে বিশ্বের বৃহত্তম টেলিকম নেটওয়ার্ক যন্ত্রপাতি নির্মাতা হুয়াওয়ে। এ ক্ষেত্রে তারা প্রতিদ্বন্দ্বী এরিকসন, নকিয়া, জেডটিই ও দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাংয়ের চেয়ে এগিয়ে।
হুয়াওয়েকে অনেক দিন ধরেই পশ্চিমা দেশগুলোর সন্দেহের চোখে দেখে। তাদের বিরুদ্ধে চীন সরকারের চাপে বিদেশি টেলিকম সিস্টেমে আড়িপাতার অভিযোগ রয়েছে। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে নেটওয়ার্ক যন্ত্রপাতি বিক্রি নিষিদ্ধ।
মেং ওয়ানঝুর গ্রেপ্তারে ঘটনাটি নাটকীয় মোড় নিয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম টেলিকম যন্ত্রপাতি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সিএফও এবং ডেপুটি চেয়ারম্যান এবং হুয়াওয়ের প্রতিষ্ঠাতা রেন ঝেংফেইয়ের মেয়ে তিনি। রেনকে নিয়ে অবশ্য আগে থেকেই পশ্চিমা গোয়েন্দাদের সন্দেহ রয়েছে। কারণ, ১৯৮৭ সালে হুয়াওয়ে প্রতিষ্ঠা করার আগে চীনা সেনাবাহিনীতে তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেছেন।
দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মেংকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি চীনা প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতির ওপর সন্দেহ ও অবিশ্বাস তৈরির পরিবেশ সৃষ্টি করছে। ২০১৬ সালে কিছু স্মার্টফোন থেকে পশ্চিমা নাগরিকদের তথ্য চীনা সার্ভারে পাঠানোর বিষয়টি উদ্বেগ তৈরি করেছিল। প্রশ্ন উঠছে, সিস্টেমে কি ধরনের প্রযুক্তি যুক্ত করা হয়েছে তা নিয়ে।
গত অক্টোবর মাসে ব্লুমবার্গে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, অ্যাপল ও আমাজনের ব্যবহৃত সার্ভারে নজরদারির চিপ বসিয়ে রেখেছে চীন। অবশ্য ওই অভিযোগ অস্বীকার করে প্রতিষ্ঠান দুটি। কিন্তু প্রযুক্তি জগতে চীনের আধিপত্যের বিষয়টি ঝুঁকি তৈরি করছে বলে মনে করছেন কয়েকটি দেশের গোয়েন্দারা।
হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের মামলার একটি অংশ হিসেবে মেংকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি দেখা হচ্ছে। এটা এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন এ খাতের বিশেষজ্ঞরা। গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন চীনের আরেক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান জেডটিইর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইরানকে যন্ত্রপাতি বিক্রি করায় নিষিদ্ধ করে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠান জেডটিইকে চিপ সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানায়। একই সময় যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল সাইবার সিকিউরিটি সেন্টার যুক্তরাজ্যে জেডটিইর যন্ত্রপাতি ব্যবহারে ঝুঁকির কথা জানায়। ওই প্রান্তিকে ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি লোকসান গুনতে হয় প্রতিষ্ঠানটিকে।
যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার বিষয়ে হুয়াওয়েকে সন্দেহের চোখে দেখছে। জেডটিইর কাছ থেকে সংগ্রহ করা অভ্যন্তরীণ নথিতে ‘এফ৭’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ইরানের যুক্ত থাকার প্রমাণ মেলে।
এফ ৭ নামের ওই কোম্পানিটি হুয়াওয়ে কিনা তা জানতে চাইলে হুয়াওয়ে কর্তৃপক্ষ বলেছে, হুয়াওয়ে সব ধরনের আইন ও নিয়মনীতি মেনে পরিচালিত হয়। এর মধ্যে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রযোজ্য রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ও নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত আইন ও নিয়ম রয়েছে।
এখন যুক্তরাষ্ট্র যদি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময়কার দেওয়া নিষেধাজ্ঞা ভাঙার বিষয়টি প্রমাণ করতে পারে, তখন তারা হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারবে। যদি জেডটিইর মতো যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্মার্টফোন ব্যবসায় ব্যবহৃত মার্কিন যন্ত্রপাতি হুয়াওয়ে না পায়, তবে তাদের ব্যবসা থমকে যেতে পারে। বর্তমানে স্মার্টফোনের বাজারে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে হুয়াওয়ে। প্রথম স্থানটি দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান স্যামসাংয়ের। সম্ভাব্য পরিণতির কথা মাথায় রেখেই প্রস্তুতি নিচ্ছে হুয়াওয়ে। নিজস্ব স্মার্টফোন চিপ তৈরি শুরু করেছে তারা। হুয়াওয়েকে এখনো গুগলের অ্যান্ড্রয়েড সফটওয়্যারের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। গুগল মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। হুয়াওয়ে নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেম নিয়ে কাজ করছে বলেও গুঞ্জন রয়েছে।
বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইডিসির মোবাইল সিস্টেম বিশ্লেষক জন ডেলানি বলেন, হুয়াওয়ের ওপর মার্কিন সরকারের ক্ষুব্ধ হওয়ার অর্থ হতে পারে হুয়াওয়ের জন্য গুগলের অ্যান্ড্রয়েড সফটওয়্যারের লাইসেন্সের অনুমোদন বাতিল।