স্বার্থপর বিজ্ঞানী ও একটি প্রতিভার অপমৃত্যু

বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন (ফেব্রুয়ারি ১১, ১৮৪৭-অক্টোবর ১৮, ১৯৩১)। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন (ফেব্রুয়ারি ১১, ১৮৪৭-অক্টোবর ১৮, ১৯৩১)। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রাভঙ্গ করার লোকের অভাব এই সভ্য সমাজেও হয় না। সমাজের যাঁরা দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, তাঁরাও আছেন এই দলে। তাই বলে বিজ্ঞানীরা! তাও যেনতেন বিজ্ঞানী নন। ইতিহাসের পাতায় যাঁদের নাম সোনার হরফে ছাপা হয়ে গেছে, কর্মগুণে নিজেদের তুলেছেন অন্য এক উচ্চতায়, মানবসভ্যতা যাঁদের অবদানকে কুর্নিশ করে, সেই বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানীরা শঠতা আর নীচতায় কুটিল লোককেও হার মানান—ইতিহাসে এমন নজির কিন্তু কম নেই। বিখ্যাত মার্কিন উদ্ভাবক টমাস আলভা এডিসনের কুটিলতায় আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলার জীবনে নরক নেমে এসেছিল।

১৮৮৮ সাল। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটন। অজস্র লোক জড়ো হয়েছেন রাস্তার মোড়ে। তামাশা দেখতে। সাধারণ লোক তো বটেই, সাংবাদিকেরাও আছেন সেই লোকের ভিড়ে। তামাশাটা দেখাবেন বিখ্যাত মার্কিন উদ্ভাবক, লোকে যাঁকে আক্ষরিক অর্থেই ‘আলোক পুরুষ’ ভাবেন, যিনি কিছুদিন আগে বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার করে পৃথিবীর বুক থেকে অন্ধকার হটানোর রাস্তা পরিষ্কার করেছেন, সেই টমাস আলভা এডিসন রচনা করতে চলেছেন এক অন্ধকার ইতিহাসের অধ্যায়। রাস্তার মোড়ে একটা কুকুরকে বেঁধে রেখেছেন তিনি। সেটাই আপাতত বলির পাঁঠা। কুকুরের গাঁয়ে বিদ্যুতের তার জড়িয়ে দিয়েছেন এডিসন। তারপর সেই তারে দিলেন বিদ্যুৎ-সংযোগ। প্রচণ্ড শকে কেঁপে উঠল কুকুরটা। দুমড়েমুচড়ে গেল ওটার শরীর। সঙ্গে যন্ত্রণাকাতর চিৎকার। আসলে বিদ্যুতের এই ভয়াবহতাই এডিসন সাংবাদিক আর সাধারণ মানুষকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছিলেন। এর উদ্দেশ্য কিন্তু জনসচেতনতা বা জনকল্যাণ নয়, বরং নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সব প্রতিপক্ষকে কাবু করার জঘন্য পাঁয়তারা।

শরীরে বিদ্যুতের খোলা তার স্পর্শ করলে যে প্রচণ্ড শক পেতে হয়, এ কথা এখন কিন্ডারগার্টেনের বাচ্চারাও জানে। কিন্তু এডিসনের সেই কুকরকাণ্ডের আগে সে কথা জানত না সাধারণ মানুষ। এডিসন নিজে বিদ্যুৎ নিয়ে কাজ করেছেন, বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু সেই বিদ্যুৎ ছিল ডিসি বা ডাইরেক্ট কারেন্ট। মোবাইল, রেডিও, টর্চে যে ড্রাইসেল ব্যবহার করা হয়, এগুলো সবই ডিসি কারেন্ট। এগুলো দিয়ে বড়জোর ছোটখাটো ডিভাইস চালানো যায়। আমাদের নিত্যদিনে কলকারখানা থেকে শুরু করে বাড়ির টিভি, ফ্রিজ, ইলেকট্রিক ফ্যান, বৈদ্যুতিক বাতিতে যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করি, এগুলোই আসলে এসি বা অলটারনেটিং কারেন্ট। এডিসনের কারবার ছিল ডিসি কারেন্ট নিয়ে। এসি কারেন্টের খবর তিনি জানতেন না। কিন্তু সার্বিয়া থেকে আসা এক তরুণ প্রতিভা, যার নাম নিকোলা টেসলা, তিনি বুঝেছিলেন এসি কারেন্টের মাহাত্ম্য। বুঝেছিলেন আগামী পৃথিবী শাসন করবে তারই উদ্ভাবিত এসি কারেন্ট। টেসলার সঙ্গে এডিসনের বিরোধের সূত্রপাত তখনই।

বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলা (জুলাই ১০, ১৮৫৬-জানুয়ারি ৭, ১৯৪৩)। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

তখন টেসলা এডিসনের কোম্পানিতে চাকরি করেন। এডিসন বৈদ্যুতিক বাতির জনক। কিন্তু সেই বাতি অতটা কার্যকর ছিল না। এডিসন তাঁকে বলেছিলেন, ‘যদি একটা উন্নত মানের ডিসি জেনারেটরে চালানো যায়—এমন বৈদ্যুতিক বাতি তৈরি করতে পারো, তাহলে ৫০ হাজার ডলার পুরস্কার পাবে।’ টেসলা চিরকাল নিঃসম্বল মানুষ ছিলেন। সৃষ্টির নেশাতেই মেতে থাকতেন, টাকা-পয়সা কীভাবে কামাতে হয়, এ বুদ্ধি তাঁর ছিল না। চরম দরিদ্র জীবন পার করতে হচ্ছিল। এডিসনের ৫০ হাজার ডলারের প্রতিশ্রুতি তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল, দেখেছিলেন নতুনভাবে জীবন গড়ার আশা। কঠোর পরিশ্রম করে তিনি সত্যি সত্যি একটা কার্যকর বৈদ্যুতিক বাতির মডেল দাঁড় করান। এডিসনকে দেখান। এডিসন সেটা কাজে লাগানোর তোড়জোড় শুরু করেন। কিন্তু প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে তাঁর কোনো হেলদোল নেই। টেসলা তাঁকে মনে করিয়ে দেন সে কথা। এডিসন তখন হো হো করে হেসে বলেন, ‘আমেরিকানদের মশকরা তুমি বোঝেনি। ৫০ হাজারের প্রতিশ্রুতিটা নিতান্ত ফান ছিল।’ এডিসন শুধু টেসলার সাপ্তাহিক বেতনটা ১০ ডলার বাড়িয়ে ১৮ থেকে ২৮ ডলারে উন্নীত করেন।

রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে, অভিমানে চাকরি ছেড়ে দেন টেসলা। ভীষণ মর্মাহত হন। নিজেই চেষ্টা করেন একটা কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করার। এর জন্য টাকা তো চাই! টাকা জোগাড়ের জন্য নতুন নতুন জিনিস তৈরি করেন এবং সেগুলোর পেটেন্ট করান। খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। তাঁর এই সাফল্য নজরে পড়ে আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্সের কর্তাদের। টেসলার ডাক পড়ে সেখানে লেকচার দেওয়ার জন্য। সেখানেই পরিচয় হয় এডিসনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জর্জ ওয়েস্টিংহাউসের সঙ্গে। তিনি টেসলার সঙ্গে কথা বলেন এবং নিজের কোম্পানিতে চাকরির প্রস্তাব দেন। এডিসনকে জব্দ করার এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর কী হতে পারে?

টেসলা উদ্ভাবিত এসি ডাইনামো মেশিনের ড্রয়িং। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

দুজন মিলে গবেষণা করলেন এসি বিদ্যুৎ নিয়ে। তরতরিয়ে এগিয়ে চলছিল এসি বিদ্যুতের জয়যাত্রা। সেটাই এডিসনের জন্য হুমকি হয়ে ওঠে। এডিসন বুঝতে পারছিলেন তাঁর ডিসি কারেন্টের ব্যবহার বেশি দিন চলবে না, মানবসমাজে একচ্ছত্র আধিপত্য নেবে টেসলার এসি কারেন্ট। সুতরাং বাজারে টিকে থাকতে হলে মানুষকে ভুল বোঝাতে হবে। এসি কারেন্টের ভয়াবহতা যদি দেখানো যায় লোকসমাজে, সংবাদমাধ্যম যদি ফলাও করে সে সংবাদ প্রচার করে, তবে হয়তো রোখা যাবে টেসলাকে। তাই তিনি এসি কারেন্ট দিয়ে কুকুর মারার ওই আয়োজন করেছিলেন।

এডিসনের ওই কাণ্ড সক্ষম হয়েছিল মানুষকে ভুল বোঝাতে। টেসলা একটা বিশাল প্রজেক্টে হাত দিয়েছিলেন। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা মাঝপথে সেই প্রজেক্ট বন্ধ করে দেয়। আবার পথের ভিখারিতে পরিণত হন টেসলা। তবু তাঁকে দমানো যায়নি। ছোট-বড় প্রায় এক হাজার বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের জনক তিনি। কিন্তু বেশির ভাগেরই স্বত্ব চুরি করে অন্যের নামে পেটেন্ট রাইট করা হয়। সারা জীবন গরিব আর ব্রাত্যই রয়ে যান টেসলা। এক্স-রে, বেতারযন্ত্রের অন্যতম আবিষ্কারকও তিনি। কিন্তু এ কথা এখন কেউ বিশ্বাস করবে না। তাঁর জীবনটা ছিল ধূপের মতো। নিজেকে পুড়িয়ে সুবাস ছড়িয়ে গেছেন, আলো জ্বালিয়ে গেছেন পৃথিবীর বুকে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক ইতিহাস তাঁর কথা মনে রাখেনি।

লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা