এখন আর অ্যাপ তৈরি করতে বিদেশনির্ভর থাকতে হচ্ছে না। দেশের অ্যাপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতেই তৈরি হচ্ছে জনপ্রিয় সব অ্যাপ। এ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, স্থানীয় অ্যাপের বাজার এক হাজার কোটি টাকা পার হয়ে গেছে। আগে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেখানে ভারতসহ বাইরের দেশ থেকে অ্যাপ তৈরি করে আনত, সেখানে এখন দেশীয় প্রতিষ্ঠানের ওপরেই ভরসা বাড়ছে। দেশের উদ্যোক্তাদের হাতেই তৈরি হচ্ছে জনপ্রিয় বিভিন্ন অ্যাপ সেবা।
সফটওয়্যার সেবা খাতের সংগঠন বেসিসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করে—এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এখন কয়েক শ। গত কয়েক বছরে প্লে স্টোরসহ অ্যাপ প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশের ডেভেলপারদের তৈরি অ্যাপের সংখ্যা কয়েক লাখ। অ্যাপ তৈরিতে বাংলাদেশে ডেভেলপাররা এখন হাজার কোটি টাকার বাজার ধরার চেষ্টা করছেন।
অ্যাপস নির্মাণের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বলছেন, ২০১৭ সালে দেশে অ্যাপের বাজার ছিল ৫০০ কোটি টাকার মতো। ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮০০ কোটি টাকায়। বর্তমানে তা হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। দেশে অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপগুলোর মধ্যে বিশ্বে জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে টুলস, কমিউনিকেশন, ভিডিও প্লেয়ার্স অ্যান্ড এডিট, ভ্রমণ ও স্থানীয় বিভিন্ন অ্যাপ। আইওএসের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ইউটিলিটিস, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ছবি, ভিডিও ও গেমভিত্তিক অ্যাপ। ৮ বছর আগেও দেশে অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট খাতে উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না। এ খাতে গত আট বছরে বাংলাদেশের ডেভেলপাররা দ্রুত এগিয়েছেন। বাংলাদেশের তরুণেরা এখন গেমস, অ্যাপস, রোবটিক মিডিয়াসহ দরকারি অ্যাপ তৈরি করছেন।
সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ বলছে, দেশের বিশালসংখ্যক মানুষ এখন স্মার্ট মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। ফলে এই দেশই এখন বিশাল একটা বাজার। দেশীয় অ্যাপ ও কনটেন্টের চাহিদা বাড়ছে। বাজারও বড় হচ্ছে। যে গতিতে ডেভেলপাররা উঠে আসছে, তাতে অ্যাপসের স্থানীয় বাজারে ছাপ রাখছে। সরকারি নানা উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার কারণে দেশের কিছু কিছু অ্যাপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান খুব ভালো করছে।
দেশে মোবাইল অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবা পরিবহন ব্যবস্থাকে জাদুর কাঠির মতো বদলে দিয়ে নতুন এক রূপ দিয়েছে। দেশেই তৈরি হয়েছে পাঠাও, সহজের মতো রাইড শেয়ারিং অ্যাপ। দেশের পরিবহনসেবায় নতুন মাত্রা দেওয়ার পাশাপাশি সৃষ্টি হয়েছে নতুন কর্মসংস্থান। হাজার হাজার তরুণ নিজেদের এই সেবায় নিযুক্ত করেছেন। এর বাইরে দেশে বিকাশ, নগদের মতো অ্যাপ এখন দারুণ জনপ্রিয়।
দেশের বেসরকারি বা উদ্যোক্তা পর্যায়ে সফল অ্যাপের উদাহরণ হিসেবে টেন মিনিট স্কুল, ইয়ুথ অপরচুনিটি, শেয়ার ট্রিপ, সেবা এক্সওয়াইডজেড অ্যাপের কথা বলা হয়। ব্যাংকিং খাতের সফল উদাহরণ হিসেবে সিটি টাচ এখন সবারই জানা। দেশের উদ্যোক্তারা ‘হিরোজ অব ৭১’–এর মতো সফল গেমিং অ্যাপ্লিকেশন তৈরিতেও সফলতা দেখিয়েছেন।
অনলাইন লার্নিং প্ল্যাটফর্ম কোরসেরার বৈশ্বিক দক্ষতা সূচক বা ‘গ্লোবাল স্কিলস ইনডেক্স ২০১৯’ (জিএসআই) অনুযায়ী, প্রযুক্তিগত দক্ষতার দিক থেকে অ্যাপ উন্নয়ন, অপারেটিং সিস্টেম, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো ক্ষেত্রে ভালো করছে বাংলাদেশ। প্রযুক্তিগত দক্ষতার ক্ষেত্রে ভালো করছে বাংলাদেশ।
ব্রেন স্টেশন ২৩-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রাইসুল কবির বলেন, গত এক দশকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অ্যাপ তৈরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক উন্নত হয়েছে। সরকারি বিভিন্ন পদক্ষেপ ও স্টার্টআপ কালচার গড়ে ওঠার কারণে দেশে অ্যাপ তৈরির হারও বেড়েছে। গড়ে উঠছে অ্যাপের বাজার।
রাইসুল বলেন, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম তথ্যপ্রযুক্তি সেবাদাতা কোম্পানি এখন ব্রেন স্টেশন ২৩। ব্রেন স্টেশন ২৩-এর শুরুটাই হয়েছিল পেপালের ক্রেডিট সেবা (বিল মে লেটার) সমন্বয় করার কাজটির মাধ্যমে। এরপর একের পর এক বিদেশি এমএনসি ব্রিটিশ টেলিকম, টেলিনর, নিশান, আজিয়াটা, মারুবশি, টয়োটা প্রভৃতি বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করতে থাকে ব্রেন স্টেশন। ২০০৬ থেকে ২০১২-তে ব্রেন স্টেশন ২৩ শুধু দেশের বাইরে, বিশেষ করে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোতে সফটওয়্যার সেবা দিয়ে আসছিল। ২০১২-তে সিটি ব্যাংকের সিটি টাচ অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্টের প্রস্তাব আসে ব্রেন স্টেশনের কাছে। সিটি ব্যাংক তখন ভারতীয় নির্মাতাকে নিয়ে খুবই অসন্তুষ্ট ছিল। চ্যালেঞ্জিং কাজটি ব্রেন স্টেশন ২৩-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও রাইসুল কবির নেওয়ার পর তৈরি হয় বাংলাদেশের অন্যতম সেরা মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপটি। গড়ে ৩৫ শতাংশ গ্রোথ রেট নিয়ে টেকসই গতিতে এগিয়ে চলছে ব্রেন স্টেশন। ২০২১ সাল নাগাদ ৫০০ মানুষের কোম্পানিতে উপনীত হওয়ার লক্ষ্যে পৌঁছাবে ব্রেন স্টেশন। ব্রেন স্টেশনের মতো দেশি অ্যাপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে জনবল বাড়াতে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে।
ড্রিম ৭১-এর প্রধান নির্বাহী রাশাদ কবির বলেন, দেশের অ্যাপ নির্মাতাদের প্রতি প্রতিষ্ঠানগুলোর আস্থা বাড়ছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা উদ্যোগের মাধ্যমে দেশেই তৈরি হচ্ছে প্রয়োজনীয় অ্যাপ। ইতিমধ্যে তাঁর প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিমান, ওয়াসা, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমসহ ১৭টি অ্যাপ তৈরি করেছে। সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের হাতেই তৈরি হচ্ছে এসব অ্যাপ্লিকেশন।
সরকারি উদ্যোগ
সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সফটওয়্যার ও অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট খাতটি বড় হচ্ছে। দেশে স্মার্টফোন ব্যবহারকারী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বড় হচ্ছে স্মার্টফোনে সেবা ও নানা রকম অ্যাপের বাজার। ব্যক্তিগত উদ্যোগের পাশাপাশি বাংলাদেশে ইতিমধ্যে সরকারের সফল অ্যাপ হিসেবে মাই গভ, কৃষি অ্যাপ, রেল, বিমান, একপে, একসেবা, একশপ, টিচার্স পোর্টালের মতো দরকারি অ্যাপ তৈরি হচ্ছে। এসব অ্যাপের মাধ্যমে নানা সেবা পাচ্ছে মানুষ। সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ বাজার সচেতনতা, প্রশিক্ষণ, প্রতিযোগিতা, পুরস্কার প্রদানসহ নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে অ্যাপ খাতকে এগিয়ে নিচ্ছে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, সরকার এখন ইগভ থেকে এমগভের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জনগণের দোরগোড়ায় সরকারের সব ধরনের সেবা সহজে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। জনগণকে সহজে সরকারি সেবা দিতে ৬০০ সেবা অনলাইনে আনা হয়েছে। আরও ২ হাজার ২০০ সার্ভিসে অনলাইনে আনা হবে। এসব সেবার মধ্যে প্রয়োজনীয় অ্যাপও রয়েছে। দেশি উদ্যোক্তাদের এসব কার্যক্রমে যুক্ত করা হবে। সরকারি সেবাগুলোতে সবার দোরগোড়ায় পৌঁছাতে অনলাইনে অর্থ পরিশোধ সেবা একপে, অনলাইনে কেনাকাটার ক্ষেত্রে একশপের মতো সেবা চালু করা হয়েছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী ১৭২টি সেবার প্ল্যাটফর্ম মাইগভ চালু করেছেন, যাতে বিভিন্ন সেবা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে।
প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ বলেন, দেশের অ্যাপ খাতের সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগানোর জন্য ইতিমধ্যে ৩১ হাজারের বেশি প্রশিক্ষিত দক্ষ জনবল তৈরি করেছে সরকার। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ তৈরির মাধ্যমে মোবাইল গেম ও অ্যাপ্লিকেশন উন্নয়নে স্থানীয় বাজার সম্প্রসারণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের জন্য বাংলাদেশকে প্রস্তুত করার লক্ষ্যে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের উদ্যোগে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরির ওপর দেশব্যাপী বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
জুনাইদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০২৫ সালের মধ্যে দক্ষ জনবল তৈরি ও বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ৫ বিলিয়ন ডলারের যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে, তা অর্জনে বাংলাদেশের অ্যাপ খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের গত ৬ বছরের যথাযথ উদ্যোগের ফলে অ্যাপ খাতের সাফল্য এখন সামনে উঠে আসছে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের মুঠোর সেবা স্মার্টফোনের মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া। এককথায় আমরা কেনাকাটা, যোগাযোগ করব। সবকিছু যেন মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে হয় সে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।’