সুন্দর পিচাই যেভাবে গুগলের সিইও হলেন

২০০৪ সালে গুগলে যোগ দেওয়ার পর একের পর এক দায়িত্ব আসে সুন্দর পিচাইয়ের কাঁধে। তিনিও এগিয়ে যেতে থাকেন। এখন তিনি গুগল এবং এর মূল প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।

গুগল ও এর মূল প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেটের সিইও সুন্দর পিচাই
গুগল

গুগলের দুই সহপ্রতিষ্ঠাতা, ল্যারি পেজ এবং সের্গেই ব্রিন ২০১৯-এর ডিসেম্বরে ঘোষণা দেন, গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেটের নতুন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হবেন সুন্দর পিচাই। আর তাঁরা দুজনই সরে দাঁড়াবেন নেতৃত্ব থেকে।

সে সময় ল্যারি পেজ ছিলেন অ্যালফাবেটের সিইও, সের্গেই ব্রিন প্রেসিডেন্ট। আর অ্যালফাবেটের মূল ব্যবসা, অর্থাৎ গুগল সার্চ ইঞ্জিনের গুরুভার ছিল সুন্দর পিচাইয়ের কাঁধে। এরপর তাঁকে গুগলের তো বটেই, সার্বিকভাবে অ্যালফাবেটের সিইওর পদে আনা হয়।

কে এই পিচাই, তা এখন আমরা সবাই জানি। তবে কীভাবে তিনি বিশ্বের সফলতম প্রতিষ্ঠানগুলোর একটির শীর্ষে পৌঁছালেন, চলুন তা জানা যাক।

শৈশবে সংখ্যা মনে রাখায় দক্ষ ছিলেন

আইআইটি খড়গপুরে ডরমিটরির এই কক্ষেই থাকতেন পিচাই। দীর্ঘ ২৩ বছর পর ২০১৭ সালে সেখানে গিয়েছিলেন তিনি

সুন্দর পিচাইয়ের মূল নাম পিচাই সুন্দরারাজন। বড় হয়েছেন ভারতের চেন্নাইয়ে।

পিচাইয়ের বাবা রঘুনাথ তড়িৎ প্রকৌশলী ছিলেন, মা লক্ষ্মী ছিলেন স্টেনোগ্রাফার। উচ্চবিত্ত পরিবার ছিল না তাঁদের। ছোটবেলায় দুই ঘরের অ্যাপার্টমেন্টের বসার ঘরে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে ঘুমাতেন সুন্দর।

শৈশবে সংখ্যা মনে রাখায় বিশেষ দক্ষ ছিলেন পিচাই। ব্যাপারটি তাঁর বাবা-মা বুঝতে পারেন, যখন দেখলেন তাঁদের রোটারি ফোনে ডায়াল করার সব নম্বর পিচাইয়ের মুখস্থ। ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পিচাই এখনো মাঝেমধ্যে মিটিংয়ে তাঁর সেই দক্ষতার প্রমাণ দেন।

ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি) খড়গপুর থেকে মেটালারজিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়েন তিনি। এরপর বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ পান।

একসময় সিলিকন ভ্যালি ছিল তাঁর স্বপ্ন

তথ্যপ্রযুক্তিতে বরাবরই আগ্রহী ছিলেন পিচাই। প্রথম প্রোগ্রাম হিসেবে তৈরি করেন দাবা খেলার সফটওয়্যার। ভারতের দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে ২০১৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে পিচাই বলেছিলেন, ‘প্রযুক্তি আমার সব সময়ের পছন্দের বিষয় ছিল। আর সিলিকন ভ্যালি ছিল আমার স্বপ্ন, আমি এ নিয়ে লেখা পড়তাম, চাচার কাছ থেকে শুনতাম।’

গুগলপ্লেক্সের একাংশ

১৯৯৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যান সুন্দর পিচাই। স্ট্যানফোর্ড থেকে এমএস শেষে ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার হোয়ার্টন স্কুলে এমবিএ করেন। গুগলে যোগ দেওয়ার আগে অ্যাপ্লায়েড ম্যাটেরিয়ালস এবং ম্যাককিনসি অ্যান্ড কোম্পানি নামের দুটি প্রতিষ্ঠানে কিছুদিন কাজ করেছেন।

গুগলের মূল কার্যালয় গুগলপ্লেক্সে ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল চাকরির সাক্ষাৎকারের জন্য গিয়েছিলেন তিনি। এপ্রিল ফুলের সেই দিনেই জি–মেইল চালু করে গুগল। পিচাইসহ সবাই ভেবেছিলেন বিনা মূল্যের ই-মেইল সেবাটি নিশ্চয় মজা করার জন্য করা।

শুরুতেই দেন দক্ষতার প্রমাণ

বাবা-মার সঙ্গে সুন্দর পিচাই

গুগলের সার্চ টুলবার দিয়ে শুরু হয় পিচাইয়ের কাজ। তবে ২০০৬ সালে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় মাইক্রোসফট। জনপ্রিয় অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজে ওয়েব ব্রাউজার ‘ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার’–এর ডিফল্ট সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে ‘বিং’ ঠিক করে দেয় মাইক্রোসফট।

পিচাই সে সময় কম্পিউটার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাঁদের বিক্রি করা কম্পিউটারে গুগলের সার্চ টুলবার যুক্ত করার ব্যাপারে বোঝাতে সক্ষম হন। মাইক্রোসফটের সে উদ্যোগে যে ক্ষতির মুখে পড়েছিল গুগল, পিচাইয়ের কাজে তা অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হয়।

ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারের ফাঁড়াটি পিচাইয়ের জীবনে আশীর্বাদ হয়েই আসে। সে সময় গুগলের নিজস্ব ওয়েব ব্রাউজার তৈরির জন্য প্রতিষ্ঠানের দুই সহপ্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজ ও সের্গেই ব্রিনকে রাজি করাতে সক্ষম হন তিনি। ফলাফল? ক্রোম এখন বিশ্বের জনপ্রিয়তম ব্রাউজার।

বেশ কয়েকবার টুইটারের উচ্চপদে কাজের জন্য ডাক পেলেও গুগল ছেড়ে যাননি তিনি

অ্যান্ড্রয়েডের দায়িত্ব কাঁধে নেন

নেতা হিসেবে পিচাইকে সবাই পছন্দ করতেন। অনন্য হওয়ার চেয়ে বরং ভালো ফলাফলে গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি। ক্রমেই তাঁর কাঁধে দায়িত্ব বাড়তে থাকে। ২০১৩ সালে অ্যান্ড্রয়েড বিভাগের নেতৃত্বও দেওয়া শুরু করেন তিনি।

সুন্দর পিচাইয়ের নেতৃত্বে পরিচালিত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প হলো ‘অ্যান্ড্রয়েড ওয়ান’। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কম দামের অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন বাজারে ছেড়ে ৫০০ কোটি নতুন মানুষকে অনলাইনে যুক্ত করতে চেয়েছেন তিনি।

অ্যান্ড্রয়েডের দশম বর্ষপূর্তিতে ইনস্টাগ্রামে ছবিটি পোস্ট করেন সুন্দর পিচাই

অ্যান্ড্রয়েড যেন গুগলের সেবাগুলোর সঙ্গে চমৎকারভাবে মানিয়ে নিতে পারে, তা নিশ্চিত করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন পিচাই। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের আগে অ্যান্ড্রয়েড সম্পূর্ণ আলাদা ব্যবসা হিসেবে পরিচালিত হতো।

গুগলে পিচাইয়ের উত্থানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হলো, ২০১৪ সালে ৩২০ কোটি ডলারে নেস্ট অধিগ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। কম খরচের ক্রোমবুক ল্যাপটপ কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেম ‘ক্রোম ওএস’-এর পেছনেও আছেন পিচাই।

বেশ কয়েকবার টুইটারের উচ্চপদে কাজের জন্য ডাক পেলেও গুগল ছেড়ে যাননি তিনি। পিচাই প্রায়ই ল্যারি পেজের ‘অনুবাদকের’ ভূমিকা নিতেন বলে জানিয়েছে বিজনেস ইনসাইডার। অর্থাৎ, পেজের লক্ষ্য নিজে বুঝে বাকি কর্মীদের কাছে তা পৌঁছে দিতেন।

ল্যারি পেজ লিখেছিলেন, ‘এ কাজের জন্য তিনিই (পিচাই) সেরা।’

এরপর এগিয়ে যাওয়ার পালা

সেই দক্ষতা এবং ক্রোম, অ্যাপ ও অ্যান্ড্রয়েডে সাফল্যের ফলে ২০১৪ সালের শেষের দিকে কর্মজীবনের পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ পদোন্নতি পান তিনি। সার্চ, ম্যাপস, গুগল প্লাস, বিজ্ঞাপন, অবকাঠামোসহ প্রতিষ্ঠানটির প্রায় সব পণ্যের দায়িত্ব আসে পিচাইয়ের কাঁধে। পেজের ‘সেকেন্ড-ইন-কমান্ড’-এর ভূমিকায় দেখা যায় তাঁকে।

পিচাইয়ের পদোন্নতির ঘোষণা দিয়ে কর্মীদের কাছে পাঠানো বার্তায় পেজ লিখেছিলেন, ‘ভবিষ্যৎ দেখতে পারা এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজে কর্মীদের কাজে লাগানোয় পিচাইয়ের অসাধারণ দক্ষতা। পণ্যের ব্যাপারে আমাদের দেখার চোখ প্রায় একই। এ কাজের জন্য তিনিই সেরা।’

২০১৫ সালে গুগলের করপোরেট কাঠামোয় বড়সড় পরিবর্তন আনা হয়। প্রতিষ্ঠানের মূল বিভাগগুলোকে আলাদা প্রতিষ্ঠানে রূপ দেওয়া হয়। সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি হলো গুগল, যার অধীনে আছে সার্চ, ম্যাপস, বিজ্ঞাপন, ইউটিউবসহ মূল সেবগুলো। আর ‘অ্যালফাবেট’ নামে মূল প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়ে সব কটি বিভাগ সেটির অধীনে আনা হয়।

গুগলের মূল পণ্যগুলোর দায়িত্বে ছিলেন পিচাই। স্বাভাবিক কারণেই তাঁকে গুগলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা করা হয়।

সুন্দর পিচাইয়ের পছন্দের ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা।

গুগলে সবাই তাঁকে পছন্দ করে

কিছুটা অন্তর্মুখী স্বভাবের হলেও মাঝেমধ্যে নিজের মতামত জাহির করতে পিছপা হননি তিনি। অভিবাসীদের নিয়ে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এক ব্লগ পোস্টে তিনি লেখেন, ‘ভয় যেন আমাদের মূল্যবোধকে পরাজিত না করে।’

গুগলের সব পর্যায়েই নেতা হিসেবে পিচাইকে পছন্দ করেছেন কর্মীরা। সিইও হিসেবেও জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছান। প্রশ্নোত্তরভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোরায় এক গুগলকর্মী তাঁর ব্যাপারে লেখেন, ‘আক্ষরিক অর্থেই গুগলে সবাই তাঁকে পূজা করেন। প্রকৌশলীরা তাঁকে ভালোবাসেন। পণ্য ব্যবস্থাপকেরা তাঁকে ভালোবাসেন। ব্যবসায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা তাঁকে ভালোবাসেন।’

গ্লাসডোর নামের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, কর্মজীবনের একপর্যায়ে সবচেয়ে প্রশংসিত সিইওদের একজন ছিলেন পিচাই।

পিচাই সচরাচর এক চাপ আর অমলেট দিয়ে দিন শুরু করেন। সঙ্গে থাকে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল পত্রিকার এক কপি।
জাপানের ন্যাশনাল স্টেডিয়ামের সামনে পিচাই

পিচাই যা করেছেন, সবাই তা করার স্বপ্ন দেখে

২০১৭ সালের জুলাইয়ে পিচাইকে অ্যালফাবেটের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য করা হয়।

এমনকি তাঁর জন্মভূমি ভারতেও পিচাইকে নায়কের মর্যাদা দেওয়া হয়। দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এক প্রশ্নোত্তর পর্বে হার্শা ভোগলে বলেন, ‘আপনি এমন কিছু করেছেন, যা সবাই করার স্বপ্ন দেখে।’

কর্মজীবনে ক্রমেই উন্নতি করে গেলেও সব সময় বিনয়ী থেকেছেন পিচাই।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে অ্যালফাবেটের সিইও ল্যারি পেজ এবং প্রেসিডেন্ট সের্গেই ব্রিন ঘোষণা দেন, তাঁরা নিজ পদ থেকে সরে যাচ্ছেন, পিচাই হবেন অ্যালফাবেটের পরবর্তী সিইও।

১৯৯৮ সালে গুগল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পেজ ও ব্রিন। এরপর কোনো না কোনোভাবে গুগল পরিচালনার কাজে ছিলেন তাঁরা। পরিবর্তনের চিঠিতে তাঁরা লেখেন, অ্যালফাবেট ও গুগলে এখন আর দুজন সিইও এবং একজন প্রেসিডেন্টের দরকার নেই।

পিচাই এখন গুগল ও অ্যালফাবেট, দুটিরই সিইও।

২০২০ সালে মূল বেতন হিসেবে ২০ লাখ ২০ হাজার ডলার পান পিচাই। গুগল সে বছর নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ নানা কারণে তাঁর পেছনে আরও ৫৪ লাখ ১০ হাজার ডলার খরচ করে। আর ২০১৯ সালে সব মিলিয়ে পারিশ্রমিক এবং বোনাস হিসেবে পিচাই পান ২৮ কোটি ৬২ লাখ ডলার। অবশ্য বোনাস হিসেবে পাওয়া ২৭ কোটি ৬৬ লাখ ১০ হাজার ডলার মূল্যের শেয়ার ছিল এর মধ্যে।

আইআইটি খড়গপুরে পিচাইয়ের সহপাঠী ছিলেন অঞ্জলি। এরপর বন্ধুত্ব, প্রেম, বিয়ে। তাঁদের দুই সন্তানের নাম কাব্য ও কিরণ।
অঞ্জলির সঙ্গে সুন্দর পিচাই

সূত্র: বিজনেস ইনসাইডার