একসময় কী রমরমা দিনই না ছিল নকিয়ার! মোবাইল সেট বলতেই হাতে হাতে নকিয়া। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মোবাইল সেটের দাপটে এখন সে দিন আর নেই। প্রতিযোগিতার বাজারে নকিয়া গত এক দশকে অনেকটাই পিছিয়ে। তবে নকিয়া আবার আশা দেখতে পাচ্ছে, শিগগিরই হয়তো ফিরবে তাদের সুদিন।
ফিনল্যান্ডের সবচেয়ে বড় কোম্পানির তকমা পাওয়া নকিয়ার বার্ষিক রাজস্ব ২৬ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১ লাখ ৩ হাজার কর্মী নিয়ে ফরচুন গ্লোবাল ৫০০ তালিকায় বর্তমানে ৪৬৬ নম্বরে রয়েছে নকিয়া। এসব তথ্য শুনতে ভালো লাগলেও এক দশক আগে নকিয়ার অবস্থানের কাছে এখনকার নকিয়া কিছুই না।
এক দশক আগে নকিয়ার যে সুদিন ছিল, এখন সেই সুদিন আর নেই। বৈশ্বিক কোম্পানি হিসেবে নিজেদের অবস্থান হারিয়ে ফেলেছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে ৫-জি নেটওয়ার্কিংয়ের নতুন যুগ শুরু হওয়ায় নকিয়ার নাম আবার জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে। অ্যান্ড্রয়েডচালিত স্মার্টফোন ও ক্ল্যাসিক ফিচার ফোনের হালনাগাদ সংস্করণ বাজারে এনে ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে কি ২০২০ সাল হবে নকিয়ার জন্য জায়ান্ট হিসেবে ফিরে আসার বছর?
২০১০ সালে স্মার্টফোনের দুনিয়ায় শীর্ষে ছিল নকিয়া। ২০১০ সালে যত স্মার্টফোন বিক্রি হয়েছিল তার এক-তৃতীয়াংশ বা ৩৩ দশমিক ১ শতাংশ ছিল নকিয়ার তৈরি। ওই সময়ে স্মার্টফোনের বিক্রি ৪৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ে। ওই সময়ে নকিয়ার ধারেকাছে কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না। নকিয়া যেখানে ১০ কোটি ইউনিট ফোন বিক্রি করেছিল, সেখানে অ্যাপল বিক্রি করেছিল ৪ কোটি ৭৫ লাখ আর স্যামসাং মাত্র ২ কোটি ৩০ লাখ ইউনিট স্মার্টফোন। অথচ, এক দশকের মধ্যেই বিশ্বের শীর্ষ স্মার্টফোন নির্মাতার খেতাব দখল করেছে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান স্যামসাং। ২০১০ সালে নকিয়া ফরচুন গ্লোবাল ৫০০-এর তালিকায় ১২০ নম্বরে ছিল। ওই সময় প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক রাজস্ব ছিল ৫৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বাজার বিশ্লেষকেরা বলেন, নকিয়া পতন শুরু হয় যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারায়। গুগল অ্যান্ড্রয়েডকে অবজ্ঞা করেছিল। গুগল তাদের মোবাইল অপারেটিং সিস্টেম অ্যান্ড্রয়েডকে ওই সময় থেকেই সামনে আনতে জোর প্রচেষ্টা চালায়। স্যামসাং এ সুযোগ গ্রহণ করে। নকিয়ার কর্তৃপক্ষ অ্যান্ড্রয়েডকে পাত্তাই দেয়নি। তারা সিমবিয়ানেই ভরসা রাখে। তাদের ওই পরিকল্পনা ও বদলের সহযোগী না হওয়ার মনোভাব বিপদ ডেকে আনে। স্যামসাং যখন বাজার দখল করতে থাকে, তখন আবার ভুল সিদ্ধান্ত নেয় নকিয়া।
২০১১ সালে অ্যান্ড্রয়েডকে পাত্তা না দিয়ে নকিয়া মাইক্রোসফটের সঙ্গে যৌথভাবে বাজার দখলের চেষ্টা করে। লুমিয়া স্মার্টফোনে উইন্ডোজ চালু করে। কিন্তু নকিয়ার উইন্ডোজ ফোন প্রকল্প ব্যর্থ হয়। বিশ্বে ১৬০ কোটি ফোন বিক্রির মধ্যে নকিয়া ওই সময় মাত্র সাড়ে তিন কোটি ফোন বিক্রি করতে পারে। তাদের বাজার দখল ৫ শতাংশে নেমে আসে। অ্যাপল ১৩ কোটি ৫৮ লাখ ইউনিট ফোন বিক্রি করে। স্যামসাং অ্যান্ড্রয়েডচালিত গ্যালাক্সি ফোন বাজারে এনে বিক্রি করে ২১ কোটি ৩০ লাখ ইউনিট স্মার্টফোন। মাত্র ৪ বছর, অর্থাৎ ২০১৪ সালেই নকিয়ার পতন ঘটে যায়। স্মার্টফোন ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হয় নকিয়াকে। মাইক্রোসফটের কাছে ৭২০ কোটি মার্কিন ডলারে স্মার্টফোন ব্যবসা বিক্রি করে দিতে হয় তাদের।
সেখান থেকে নকিয়া তাদের নেটওয়ার্কিং যন্ত্রপাতি ব্যবসায় ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু এটা তাদের ব্যবসার আলাদা ক্ষেত্র। ২০১৬ সালে নকিয়ার পক্ষ থেকে অ্যাপলের বিরুদ্ধে পেটেন্ট ভঙ্গের অভিযোগে মামলা করে কিছু অর্থ আদায়ের প্রচেষ্টা চালানো হয়। তারা অ্যাপলের সঙ্গে সমঝোতায় এসে পৌঁছায়। অ্যাপলের কাছ থেকে পাওয়া অর্থের কিছুটা পরিধানযোগ্য প্রযুক্তিপণ্য তৈরিতে ব্যয় করে। পরিধানযোগ্য প্রযুক্তিপণ্যের বাজারে তখন অ্যাপল ওয়াচ দিয়ে রাজত্ব শুরু করেছে অ্যাপল। ওই সময় ফ্রেঞ্চ হেলথ স্টার্টআপ উইথিংসকে ১৯ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলারে কিনে নেয় নকিয়া। কিন্তু এতে খুব বেশি সুবিধা করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। তাই লোকসান দিয়ে আবার ২০১৮ সালে এটি বিক্রি করে দেয় নকিয়া। এরই মধ্যে নকিয়া তাদের পেটেন্টের লাইসেন্স বিক্রি করতে শুরু করে। গত দশকের শেষ নাগাদ নকিয়ার আয়ের প্রাথমিক উৎস ছিল নেটওয়ার্কিং যন্ত্রপাতি ও পেটেন্ট লাইসেন্স ব্যবসা।
নতুন দশকের শুরুতে তাই ব্যর্থতার গত এক দশক পেছনে ফেলে আসতে চাইবে ফিনল্যান্ডের প্রতিষ্ঠানটি। ইতিমধ্যে তারা মোবাইল ডিভাইস নির্মাতা ফক্সকনের সঙ্গে চুক্তি করে মোবাইল ফোনের বাজারে নকিয়া নামটিকে ফিরিয়ে এনেছে। এর মধ্যে রয়েছে মিডরেঞ্জের নানা অ্যান্ড্রয়েড ফোন ও ক্ল্যাসিক নকিয়া ফিচার ফোন। নকিয়া শুরুতেই হয়তো স্মার্টফোনের ব্যবসা থেকে অ্যাপলের মতো ব্যাপক মুনাফা করতে পারবে না, তবে প্রতিটি স্মার্টফোনে লাইসেন্স ফি হিসাবে ১১ থেকে ২৩ মার্কিন ডলার পাবে তারা।
নতুন দশকে নকিয়ার জন্য আরেকটি বড় সুযোগ ৫-জি নেটওয়ার্কিং। তাদের নেটওয়ার্কিং বিভাগ টেলিকম অপারেটরদের জন্য এন্ড-টু-এন্ড ৫-জি সেবা চালু করছে। চীনা টেলিকম যন্ত্রপাতি নির্মাতা হুয়াওয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে বাধার মুখে পড়ায় নকিয়ার জন্য বড় সুবিধা হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। এ ছাড়া ৫-জি স্মার্টফোনের গ্রাহক বাড়লে নকিয়ার জন্য স্মার্টফোন বাজারেও বড় সুযোগ রয়েছে। তাদের ৫-জি পেটেন্ট থেকে প্রতিটি স্মার্টফোন থেকে সাড়ে তিন মার্কিন ডলার হিসাবে লাইসেন্স ফি আদায় করতে পারবে। বাজার বিশ্লেষকেরা তাই ২০২০-এর দশটিকে নকিয়ার জন্য সম্ভাবনার এক নতুন দশক হিসেবেই দেখতে পাচ্ছেন। তথ্যসূত্র: রয়টার্স, এনডিটিভি, ফোর্বস, ইনভেস্টরপ্লেস