জ্বালানি হিসেবে তেল মানে অকটেন, পেট্রল ও ডিজেল বহুল পরিচিত। গাড়ি চালানোর খরচ কমাতে দেশে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে কমপ্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস (সিএনজি) বা প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহৃত হয়। এই গ্যাসের মূল্য কম হলেও ইঞ্জিনের জন্য কমবেশি ক্ষতিকর। সাধারণত আমাদের দেশে যে গাড়িগুলো আমদানি করা হয়, সেগুলো তরল জ্বালানি দিয়ে চালানোর জন্য তৈরি। সিএনজি গ্যাস শুষ্ক হওয়ায় ইঞ্জিনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। তেলের খরচ কমিয়ে এবং ইঞ্জিনের ক্ষতি না করে নতুন একটি জ্বালানি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। গ্যাসটির নাম লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি)। তরলীকরণ করা এই গ্যাসকে অটোগ্যাসও বলা হয়। বাসাবাড়িতে ব্যবহার হওয়া এই গ্যাস এখন গাড়িতেও ব্যবহৃত হচ্ছে।
সিএনজি না এলপিজি?
কোন জ্বালানি আপনার গাড়ির জন্য ভালো। ম্যাপল লিফ ইন্টারন্যাশনালের এলপিজি শাখার প্রধান টেকনিশিয়ান মো. রিপন চৌধুরী বলেন, যেসব গাড়ি সিএনজিতে রূপান্তর করা যায়, সেসব গাড়ি এলপিজিতেও রূপান্তরিত হতে পারে। এলপি গ্যাস তরল অবস্থায় ইঞ্জিনে প্রবেশ করে, তাই এতে ইঞ্জিনের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। সিএনজি গ্যাস সিলিন্ডারের চেয়ে এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের ওজন কম। এতে গাড়ির সাসপেনশনের ওপর অপেক্ষাকৃত কম চাপ পড়ে। ওজন হালকা হওয়ার কারণে এলপিজিতে রূপান্তরিত গাড়িগুলো প্রতি লিটার এলপিজিতে বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে।
এলপিজিকে ক্লিন বা গ্রিন ফুয়েল বলেও আখ্যায়িত করা হয়। প্রোপেন ও বিউটেনের সংমিশ্রণে উৎপন্ন এ গ্যাসটি পেট্রল ও অকটেনের বিকল্প হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। ইঞ্জিনের জন্যও এই জ্বালানি বেশি কার্যকর এবং নিরাপদ।
এক লিটার অকটেনের দাম ৮৯ টাকা। ক্ষেত্রভেদে এক লিটার এলপিজির মূল্য ৫০ থেকে ৫৪ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। এলপিজিতে ৪০ শতাংশের বেশি জ্বালানি খরচ সাশ্রয় হয়। তরল হয়ে এই গ্যাস ইঞ্জিনে প্রবেশ করায় আলাদা রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন হয় না।
গাড়িতে এলপি গ্যাস নেওয়ার জন্য যে সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয়, তা সিএনজি সিলিন্ডারের ওজনের তুলনায় প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ। সিএনজি গ্যাসে ২০০ বারের (বিএআর) অধিক চাপ বা প্রেসার থাকতে হয়। যেখানে এলপিজিতে ৭.৫ বার চাপ বা প্রেসার থাকে। একটি ৬০ লিটার সিএনজি সিলিন্ডারের পরিধি ও দৈর্ঘ্য হয় যথাক্রমে ১০৫৪ ও ১০১৬ মিলিমিটার। এলপিজি সিলিন্ডারের পরিধি ও দৈর্ঘ্য যথাক্রমে ৩১৪ ও ৮৬৩ মিলিমিটার। সিএনজি গ্যাস ইঞ্জিনে ২০০ থেকে ৫০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপ উৎপাদন করে। এলপি গ্যাসে এই তাপমাত্রা ১৩১ ডিগ্রি ফারেনহাইট।
একই পরিমাণ গ্যাস নিয়ে সিএনজিচালিত গাড়িগুলো যে পরিমাণ দূরত্ব পাড়ি দিতে পারে, সেই পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করে এলপিজি গাড়িগুলো ৩ থেকে ৪ গুণ বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। ৬০ লিটার সিএনজি দিয়ে রাজধানীতে ৮০ থেকে ৯০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়া যায়। এই ৬০ লিটার সিএনজি গ্যাসে বাতাসের সংমিশ্রণ থাকে। আবার সিএনজি নেওয়ার সময় ফিলিং স্টেশনের প্রেশারের ওপর নির্ভর করে কতটা গ্যাস গাড়িতে প্রবেশ করবে? এলপিজির ক্ষেত্রে প্রেশারের কোনো ব্যাপার নেই। তাই পুরো ট্যাংক ভরা গ্যাসে গাড়ি ৩০০ থেকে ৪০০ কিলোমিটার অতিক্রম করতে পারে। ফলে প্রতিদিন গ্যাস নেওয়ার চিন্তা নেই।
রাজধানীতে সিএনজি স্টেশন প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বন্ধ থাকলেও এলপিজি ফিলিং স্টেশনগুলো দিন-রাত গ্যাস সরবরাহ করতে পারে। সিএনজি ফিলিং স্টেশনের মতো এলপিজি স্টেশনে গ্যাস নেওয়ার জন্য দীর্ঘ লাইন দিতে হয় না। এলপি গ্যাস নিতে সময় লাগে ৩-৪ মিনিট। যেখানে সিএনজি নিতে দ্বিগুণ সময়ের দরকার হয়।
এলপি গ্যাসে সিএনজির তুলনায় কম কার্বন নিঃসরণ হয়। এলপিজির সিলিন্ডারের প্রেশার সিএনজি সিলিন্ডারের তুলনায় মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ। তাই এতে বিস্ফোরণের আশঙ্কা নেই বললেই চলে। সিএনজিতে ২৫ শতাংশ সিস্টেম লস থাকে, যেখানে এলপিজির সিস্টেম লস মাত্র ৫ শতাংশ।
সিএনজির মতো দুটি পদ্ধতিতে গাড়িকে এলপি গ্যাস জ্বালানিতে ব্যবহারের জন্য রূপান্তর করা হয়। সিকুয়েনশিয়াল পদ্ধতিতে কম্পিউটার দিয়ে ডায়াগনসিস ও টিউনিং করে গাড়িকে এলপি গ্যাসের জন্য রূপান্তর করা হয় এবং ইনজ্যাকশন পদ্ধতিতে ম্যানুয়েল টিউনিং করেও গাড়িকে রূপান্তর করা হয়।
এলপিজি ফিলিং স্টেশন
রাজধানীতে ৮টি এলপিজি ফিলিং স্টেশনসহ সারা দেশে ৬৯টির বেশি ফিলিং স্টেশন রয়েছে। সারা দেশে ৫০০টি এলপিজি স্টেশন স্থাপনের অনুমতি পেয়েছে শিল্প প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো। এ ছাড়া ওরিয়ন, সানোয়ারা, ওরিয়েন্টাল, নাভানা, এনার্জিপ্যাক, বাংলা ট্র্যাক, আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ, সোনার বাংলা গ্যাস অ্যান্ড পেট্রোলিয়াম, ওমেরা পেট্রোলিয়াম, মাহমুদ অ্যান্ড ব্রাদার্স, কোস্টাল গ্যাস, ডিক্যান এলপিজি, ইউরো পেট্রো প্রডাক্ট, ক্রিস্টাল এনার্জি, বিএনবি এনার্জি, এফ এন্ড এফ সিস্টেম, প্রমিতা অয়েল অ্যান্ড গ্যাস, গায়েন পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি, ইনডেক্স পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি, প্রজ্ঞা পেট্রোলিয়াম করপোরেশন, জেড অ্যান্ড জেড এনার্জি, জোলস পাওয়ার, বি এম এনার্জি, আম্বিয়া ট্যাংক টার্মিনাল অ্যান্ড রিফাইনারি ও আজনা অ্যান্ড আজনা প্রতিষ্ঠানগুলো দেশে এলপিজি ফিলিং স্টেশন স্থাপনার অনুমতি পেয়েছে।
রাজধানীতে ৮টি এলপিজি ফিলিং স্টেশনগুলো হলো, মতিঝিলের অটোগ্যাস ফিলিং স্টেশন,তেজগাঁওয়ের সাউদার্ন অটোমোবাইলস লিমিটেড, ক্লিন ফুয়েল ফিলিংস স্টেশন , মিরপুর পল্লবীর ইনট্রাকো সিএনজি ফিলিং স্টেশন, মিরপুর গাবতলীর ট্রেড কনসোর্টিয়াম অটোগ্যাস ফিলিং স্টেশন, মতিঝিলের ডিএস বিজনেস পয়েন্ট এলপিজি অটোগ্যাস ফিলিং স্টেশন ও মগবাজারের অনুদিপ সিএনজি এলপিজি ফিলিং স্টেশন।
গ্রিন ফুয়েল এলপিজি কনভারসেশনের বিপণন কর্মকর্তা রাজিব হায়দার বলেন, ‘আমরা গাড়িকে সিএনজি ও এলপিজি দুই জ্বালানিতেই রূপান্তর করি। সিএনজির দাম অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় এবং সিএনজি স্টেশন বেশি থাকায় গ্রাহকদের এখনো সিএনজির প্রতি আগ্রহ রয়েছে। তবে গত বছর থেকে এলপিজিতে রূপান্তরও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এলপিজিতে রূপান্তরিত গাড়িগুলোতে কম সমস্যা পাওয়া যায়। আর একবার ফুয়েল নিলে অনেক দূর পর্যন্ত যাতায়াত করা যায় বিধায় গ্রাহকেরা এলপিজিকেও পছন্দের সারিতে রেখেছেন। আমরা ৪০ থেকে ১২০ লিটার পর্যন্ত এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার দিয়ে রূপান্তর করি। ৪৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার মধ্যে গাড়িকে এলপিজিতে রূপান্তর করা সম্ভব।
কোথায় করা যাবে?
সাউদার্ন, তমা, ম্যাপল লিফ ইন্টারন্যাশনাল, গ্রিন ফুয়েলসহ রাজধানীতে ২০০টির বেশি ওয়ার্কশপে গাড়িকে এলপিজিতে রূপান্তর করা হয়। প্রাইভেট গাড়িতে এলপিজি ব্যবহারকারী মামুন বিল্লাহ বলেন, গাড়িতে এলপিজি রূপান্তর করার পর আমার জ্বালানি খরচ প্রায় অর্ধেক কমে গেছে। তবে গ্রাহকদের এলপিজির প্রতি উৎসাহিত করতে সরকারের গ্যাসটির মূল্য কমানো উচিত।
অকটেনের তুলনায় সাশ্রয়ী হওয়ার কারণে গাড়ির মালিকদের ঝোঁক এখন এলপি গ্যাসে। যেখানে ১ লিটার অকটেনের দাম ৮৯ টাকা, সেখানে মাত্র ৫০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে সমপরিমাণ অটোগ্যাস। এ হিসাবে মাসে ৩০০ লিটার অকটেন ব্যবহার করা হলে ব্যয় হয় ২৬ হাজার ৭০০ টাকা। অন্যদিকে একই পরিমাণ অটোগ্যাস ব্যবহার করা হলে ব্যয় হবে ১৫ হাজার টাকা।