ঘটনা-১
লুনা (ছদ্মনাম) দেশের একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। হঠাৎ একদিন ফেসবুকে অপরিচিত আইডি থেকে বন্ধুত্বের অনুরোধ (ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট) আসে। লুনা তা গ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে কথাবার্তা হতে থাকে। একপর্যায়ে ওই ফেসবুক বন্ধু লুনাকে প্রেমের প্রস্তাব দেন। লুনা রাজি হয়ে যান। তাঁদের মধ্যে ভিডিও কলেও কথা চলতে থাকে। ছবিও আদান–প্রদান করা হয়।
একদিন ছেলেটি লুনাকে ব্যক্তিগত ছবি দিতে বলেন। তিনি ছবি দিতে রাজি হন না। পরে লুনাকে দেখা করতে বলেন ছেলেটি। লুনার মনে সন্দেহ জাগে। তাই তিনি দেখা করতে যাননি। তখনই ছেলেটি লুনাকে হুমকি দিয়ে বলেন, ‘তোমার ছবি এডিট (সম্পাদনা) করে “নোংরা ছবি” বানিয়ে ফেসবুকে ছেড়ে দেব। লুনা তাঁকে অনেক বোঝান। কিন্তু ছেলেটি তাঁর কাছে টাকা চান।’ উপায় না পেয়ে লুনা টাকা দেন ছেলেটিকে। লুনা বলেন, ‘তিনবার টাকা দেওয়ার পর আমার কাছে অনেক বেশি টাকা দাবি করলেন। যেটা আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব ছিল না। তখন তিনি আমার ছবি এডিট করে ফেসবুকে ছেড়ে দেন। কী করব বুঝতে পারছিলাম না।’
এরপর লুনা ৯৯৯ কল সেন্টারে যোগাযোগ করলেন। প্রয়োজনীয় প্রমাণ, তথ্য পাঠালেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই অনলাইন থেকে সব মুছে ফেলা হলো। ছেলেটিকেও আইনের আওতায় আনা হয়।
ঘটনা-২
মো. রাজু হোসেন (ছদ্মনাম) ঢাকার একটি স্কুলের শিক্ষক। অনলাইনে খুব একটা থাকেন না। হঠাৎ একদিন তাঁর এক সহকর্মী ফোন করে জানান, রাজু হোসেনের নামে অপপ্রচার হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে রাজু অনলাইনে গিয়ে দেখেন তাঁর ফেসবুক আইডি কাজ করছে না। এক বন্ধু জানালেন, রাজুর আইডি হ্যাক করা হয়েছে। আইডি বেদখল করে হ্যাকার তাঁর নামে মিথ্যা কথা ছড়াচ্ছে এবং রাজুর আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে।
এরপর রাজু হোসেন সাইবার অপরাধ বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁরা করণীয় সম্পর্কে বলে দেন। তিন দিনের মধ্যে তিনি তাঁর আইডি ফিরে পান।
দুটি ঘটনায় বোঝা গেল যে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হলে তার প্রতিকার পাওয়া সম্ভব। রাজধানীর রামপুরা থানার ওসি মো. রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আপনি আমাকে যে এখন ফোন দিয়েছেন, আমার সামনেই একজন ভিকটিম বসে আছেন অভিযোগ নিয়ে। সেটি সমাধান করার চেষ্টা করছি। আমাদের কাছে যাঁরা অভিযোগ নিয়ে আসেন, তাঁদের ৯৮ শতাংশই নারী। ছবি বা ভিডিও অনলাইনে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ কিংবা এসব নিয়ে হুমকির অভিযোগ এলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। কিন্তু বেশির ভাগই ভুক্তভোগী মামলা করতে চান না। আমাদের পরামর্শ হচ্ছে, কেউ সাইবার বুলিংয়ের শিকার হলে নিকটতম থানায় গিয়ে যেন অভিযোগ জানান।’
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. হায়দার তানভীরুজ্জামানের কাছে তারকাসহ অনেকে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে আসেন। তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে নিকটস্থ থানায় অভিযোগ বা জিডি করার পরামর্শ দিই। কোনো অশ্লীল, মানহানিকর বা হুমকিমূলক ই–মেইল আপনাকে পাঠানো হয় কিংবা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হলে থানায় অভিযোগের সঙ্গে সেগুলোর প্রিন্ট জমা দিতে হবে। আপত্তিজনক সাইটের ঠিকানা সংরক্ষণ করুন এবং তদন্ত কর্তৃপক্ষকে সরবরাহ করুন। তবে ফেসবুক বা অন্য সাইটের লগ ফাইলের ডেটা অক্ষত থাকা দরকার।
থানায় কোনো কারণে মামলা করা না গেলে, কোনো আইনজীবীর মাধ্যমে জেলা সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালতে সাইবার মামলা দাখিল করতে পারবেন।
সাইবার অপরাধের শিকার হয়ে একজন ভুক্তভোগী সিআইডির সাইবার পুলিশে যেতে পারেন বা ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইউনিটেও যেতে পারেন। জরুরি পুলিশ সেবার জন্য ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি সার্ভিস ৯৯৯–এ ফোন করতে পারবেন।
সাইবার বুলিংয়ের শিকার হলে প্রথমে নিজেকে বোঝাতে হবে, এর জন্য আপনি দায়ী নন।
সাইবার বা ডিজিটাল অপরাধের শিকার হলে আতঙ্কিত হওয়া যাবে না, ভয় পাওয়া যাবে না। মাথা ঠান্ডা রেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে।
সাইবার বুলিংয়ের শিকার হলে কখনোই আপনি সাড়া দেবেন না। নিজে পাল্টা আক্রমণ করবেন না।
আপনি আক্রমণের শিকার—এর পক্ষে যথাযথ প্রমাণ সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করবেন।
প্রাথমিকভাবে যে বা যার দ্বারা বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন, তাকে বুঝিয়ে বলতে পারেন। আপনি না পারলে আপনার বন্ধু বা আত্মীয়কেও এই আলোচনাটুকু করতে অনুরোধ করতে পারেন।
বুলিংয়ের শিকার যেহেতু নারীরা বেশি হন এবং সাধারণত তাঁরা তাঁদের সমস্যাগুলো এখনো পরিবারের সঙ্গে শেয়ার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না, তাই বুলিংয়ের শিকার হলে অবশ্যই একজন আপনজনকে জানাতে হবে।
সামাজিক যোগাযোমাধ্যমের সব অ্যাকাউন্টেই ব্লক করার সুবিধা থাকে। প্রাথমিক বুলিং হলে বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও অসংলগ্ন কথা বললে তাকে ব্লক করে দিতে পারেন।