কম্পিউটার ও ইন্টারনেট—এই দুই বস্তুতে ছেয়ে গেছে পৃথিবী। বিশ্বায়নের ধারণাকে আক্ষরিক অর্থে বাস্তবে রূপ দিয়েছে ইন্টারনেট। আর কম্পিউটার শুরুতে শুধু জটিল হিসাব-নিকাশের কাজ করলেও এখন মানুষের ঘরের ফ্যান চালানো থেকে শুরু করে দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসা করছে অবলীলায়। কিন্তু এই সর্বগ্রাসী কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় মানুষ কতটা নিরাপদ?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কম্পিউটারের দুনিয়ায় নতুন বিপ্লব আসছে। আর এই বিপ্লব নিয়ে আসবে ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি)। সাধারণত ইন্টারনেটে যুক্ত ডিভাইসকেই আইওটি বলা হয়ে থাকে। সেই হিসেবে আপনার স্মার্টফোন থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ-চালিত গাড়ি—সবকিছুই ইন্টারনেট অব থিংসের আওতার মধ্যে পড়ে। দিন দিন বড় হচ্ছে ইন্টারনেট অব থিংসের বাজার। এখন মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে আরও সহজ করে তোলার জন্য আইওটি ডিভাইস ব্যবহার করার চেষ্টা চলছে। আবার শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের খাতে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালুতেও অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট। ব্যাপক চাহিদা থাকায় প্রযুক্তি-প্রতিষ্ঠানগুলোও এমন ডিভাইস তৈরির ক্ষেত্রে নিত্যনতুন উদ্ভাবনের জোর চেষ্টা চালাচ্ছে।
এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করছে ইন্টারনেটে যুক্ত যন্ত্র বা আইওটি। এসব যন্ত্রেও থাকে কম্পিউটার চিপ। তাই আইওটি ডিভাইসও একধরনের কম্পিউটারই বটে। এক পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে, আগামী ২০৩৫ সালের মধ্যে পুরো পৃথিবীতে ইন্টারনেটে যুক্ত এমন ডিভাইসের সংখ্যা এক লাখ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। আর এসব ডিভাইস যেমন মানুষের জামাকাপড়ে থাকবে, তেমনি থাকবে বড় বড় অবকাঠামোতেও।
ভবিষ্যতে আইওটি ডিভাইস বিশ্বে কি ভূমিকা নেবে, তার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে বহুজাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সিসিএস ইনসাইট। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, গত শতাব্দীতে ভোক্তা ও বাণিজ্যের জগৎকে বদলে দিয়েছিল বিদ্যুৎ। জ্বালানি খাতে এই যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিল বিদ্যুৎশক্তি। চলতি শতকে তথ্যের জগতে সেই ভূমিকা নিতে চলেছে আইওটি। কারণ, আইওটি ডিভাইস যত বেশি ব্যবহৃত হবে, ভোক্তাদের ও বাণিজ্যসংশ্লিষ্ট তত বেশি তথ্য জমা হতে থাকবে। আর আসছে দিনে তথ্যই ক্ষমতার সবচেয়ে বড় উৎসে পরিণত হয়ে উঠবে।
আইওটি ডিভাইস কেন বাড়ছে?
ইন্টারনেট অব থিংস বা আইওটি ডিভাইস তৈরির হার বাড়ছে কাঁচামালের সহজলভ্যতা ও উৎপাদনের খরচ ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ার কারণে। আর ব্যবহারকারীরাও এখন ইন্টারনেটে যুক্ত যেকোনো কিছুতে বেশি ঝুঁকছে। চাহিদা ও জোগান—দুই-ই সর্বোচ্চ অবস্থানে থাকায় প্রযুক্তি-প্রতিষ্ঠানগুলোও এই প্রবণতায় গা ভাসিয়েছে।
এর ফলস্বরূপ আইওটি খাতে ব্যয় ক্রমাগত বাড়ছে। মার্কিন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বেইন অ্যান্ড কোম্পানি মনে করছে, ২০২১ সালের মধ্যে আইওটি খাতে ব্যয় ৫২ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছাবে। আরেক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাককিনসে বলছে, আইওটি খাতের অর্থনৈতিক প্রভাব ২০২৫ সাল নাগাদ প্রতিবছর প্রায় ১১ লাখ কোটি ডলারে পৌঁছাতে পারে।
যেকোনো ধরনের কম্পিউটার ডিভাইসের উৎপাদন ব্যয় অতীতের তুলনায় কতটুকু কমেছে, তার কিছু চিত্র দেখা যাক। ১৯৭০ সালের দিকে যখন প্রথম বাণিজ্যিকভাবে মাইক্রোপ্রসেসর বিক্রি শুরু হয়েছিল, তখনকার তুলনায় এখন কম্পিউটার–প্রতি খরচ ১০ কোটি ভাগের ১ ভাগ। ১৯৫৬ সালে ১ মেগাবাইট ডেটা ব্যবহারের খরচ ছিল প্রায় ৯ হাজার ২০০ ডলার। আর এখন তা ১ ডলারের কম।
কম্পিউটার পরিচালনার খরচও নাটকীয়ভাবে কমেছে। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির দেওয়া এক হিসাব বলছে, এখনকার সস্তা কম্পিউটার চিপগুলো ১৯৭০ সালের সুপার কম্পিউটারের তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর ও দ্রুতগতির। বরং এই সস্তা চিপগুলো আগের তুলনায় ঢের কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করে থাকে। খরচ কমার এই প্রবণতা এখনো চলছে। গোল্ডম্যান স্যাকসের প্রতিবেদন জানাচ্ছে, আইওটি ডিভাইসে যেসব সেন্সর ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর দাম ক্রমাগত কমছে। ২০০৪ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে এসব সেন্সরের দাম প্রায় দেড় ডলার থেকে কমে ৬০ সেন্টে নেমে গেছে।
যেহেতু টেলিযোগাযোগব্যবস্থা দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে এবং খরচ কমছে, ফলে ইন্টারনেটব্যবস্থাও সহজলভ্য হয়ে পড়েছে। ফলে বাড়ছে ইন্টারনেটে যুক্ত মানুষের সংখ্যাও। ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ) বলছে, ২০১৮ সালের মধ্যেই পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫১ দশমিক ২ শতাংশ ইন্টারনেটে যুক্ত হয়ে গেছে। অথচ এর ১০ বছর আগে এই সংখ্যাটি ২৩ দশমিক ১ শতাংশ কম ছিল।
ঝুঁকি কী কী?
কম্পিউটারব্যবস্থায় চূড়ান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সব সময়ই কঠিন। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শুরু করে আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি—কেউই হ্যাকারদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। আইওটি ডিভাইসের ব্যাপক ব্যবহার পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে নিয়ে যেতে পারে। যখন একটি বিশ্বে অনেক বেশিসংখ্যক কম্পিউটার থাকবে এবং সেগুলো ইন্টারনেটে যুক্ত থাকবে, তখন হ্যাকারদের দৌরাত্ম্যও বাড়বে বৈ কমবে না।
বর্তমানে যেহেতু আইওটি ডিভাইসগুলো ব্যবহারকারীদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে বেশি সম্পৃক্ত, তাই যদি আইওটি ডিভাইসে হ্যাকাররা হানা দেয়, তবে তা মানুষের জীবন ও সম্পদকে বিপদাপন্ন করে তুলতে পারে। বৃহৎ শিল্পগুলো স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় ঝোঁকার ফলে সেখানেও নিরাপত্তা একটি বড় বিষয় হয়ে উঠেছে। হিসাব-নিকাশ থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিভিন্ন স্তরে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করায়, হ্যাকারদের এক আক্রমণেই সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
ব্রিটিশ সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ বলছে, হ্যাকারদের মোকাবিলা করা খুব সহজ কাজ নয়। কম্পিউটার সফটওয়্যার বেশ জটিল। লাখ লাখ লাইন কোডের যেকোনো একটিতে ত্রুটি হলেও বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। আর যত বেশি আইওটি ডিভাইস ব্যবহৃত হবে, ব্যবহারকারীদের তত বেশি ব্যক্তিগত তথ্য বিভিন্ন প্রযুক্তি-প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে যাবে। ধরুন, একটি স্মার্টওয়াচ বা ফিটনেস ওয়াচ ব্যবহার করছেন। তা থেকেই নির্মাতা-প্রতিষ্ঠান জেনে যাবে আপনার স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত নানা তথ্য। বিশ্লেষণের পর ওই সব তথ্যই আবার অন্যান্য চিকিৎসাসেবা-সম্পর্কিত কোম্পানিকে বিক্রি করে দেওয়া হতে পারে। হয়তো বাড়িতে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়ে স্মার্টফোনে অ্যাপের মাধ্যমে পরিচালনা করছেন। এই সূত্রে আপনার বাড়ি-সম্পর্কিত নানা তথ্যও অন্যের কাছে চলে যেতে পারে। অর্থাৎ আপনার স্পর্শকাতর ব্যক্তিগত তথ্য আপনার অগোচরেই বেহাত হওয়ার আশঙ্কা রয়ে যাচ্ছে।
আবার পণ্যের মালিকানা আদৌ ক্রেতার হাতে থাকছে কি না, সেটিও একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি জানা গেছে, বিদ্যুৎ-চালিত গাড়ির ক্ষেত্রে টেসলা তাদের সদর দপ্তর থেকেই দূরনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় গ্রাহকের গাড়ির অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। অর্থাৎ আইওটি ডিভাইস কেনার পরও তার ওপর ক্রেতার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ থাকছে না। তখন কিন্তু আর সেটি কোনো বিক্রীত পণ্য থাকছে না, বরং একধরনের সেবা হয়ে যাচ্ছে। ফলে নিয়ন্ত্রণের গ্যাঁড়াকলে আটকে পড়ছে ব্যবহারকারীরা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার ক্রমশ বাড়তে থাকায় পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে।
আবার অন্যান্য ইলেকট্রনিক পণ্য, যেমন: রেফ্রিজারেটর, ওয়াশিং মেশিন ইত্যাদি মানুষ কেনে দীর্ঘ সময় ব্যবহারের জন্য। কিন্তু স্মার্টফোন ও আইওটি ডিভাইসের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হচ্ছে না। আইফোন কেনার পর অ্যাপল পাঁচ বছর পর্যন্ত ব্যবহারকারীদের নানা আপডেট দিয়ে থাকে। অ্যান্ড্রয়েড এই আপডেট-সুবিধা দেয় মোটে দুই বছর। ফলে ওই নির্দিষ্ট সময়ের পর ডিভাইসগুলো আর সুরক্ষিত থাকছে না। তৈরি হচ্ছে হ্যাকারদের আক্রমণের আশঙ্কা।
রক্ষার উপায় কী?
বিজ্ঞানের প্রতিটি উদ্ভাবনেরই ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক থাকে। মানবকল্যাণে ব্যবহারের জন্য এসব উদ্ভাবনের নেতিবাচক দিক কমিয়ে ইতিবাচক দিকটিকে ছড়িয়ে দিতে হয়। এটি ঠিক যে, ইন্টারনেট ও কম্পিউটার অনেক কাজ সহজে ও নিখুঁতভাবে সমাধা করছে। এর বিকল্প খুব একটা নেই। কিন্তু ব্যক্তিগত তথ্য বেহাত হওয়া, পণ্যের নিয়ন্ত্রণ, হ্যাকারদের আক্রমণ প্রভৃতি বিষয়ও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। যদি এসব বিষয়ে এখনই উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয়, তবে ভবিষ্যতে বিরাট বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।
আইওটি ডিভাইস আদতে মানুষের জন্য আশীর্বাদ হবে, নাকি অভিশাপ—সেটি নির্ভর করবে মানুষ কীভাবে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করবে তার ওপর। আর্থিক লাভের পেছনে ছুটতে গিয়ে যদি প্রযুক্তি-প্রতিষ্ঠানগুলো নীতি-নৈতিকতা জলাঞ্জলি দেয়, তবে আর সাধারণ ব্যবহারকারীরা এর সুবিধাভোগী হতে পারবে না। বরং তথ্যপ্রযুক্তিতে উন্নত এক কারাগারে পরিণত হবে পুরো বিশ্ব।