রেসিং কারের রেসিপি

কার্বন তন্তু বুনে তৈরি হয় গাড়ির কাঠামো।
কার্বন তন্তু বুনে তৈরি হয় গাড়ির কাঠামো।

রেসিং ট্র্যাকে শাঁই শাঁই করে ছুটে চলা গাড়ি দেখতে অনেকেরই ভালো লাগে। গাড়ি দেখে মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, কোন জাদুবলে তৈরি হয় এ ধরনের দৃষ্টিনন্দন গাড়ি? কার্বন ফাইবার ব্যবহার করে যেভাবে হালকা-পাতলা, ক্ষমতাসম্পন্ন স্পোর্টস কার তৈরি হচ্ছে, এতে এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

প্রশ্নের উত্তর জানতে চোখ রাখতে পারেন যুক্তরাজ্যের বাণিজ্যিক এলাকা ব্রিস্টলে। এখানেই আছে বার্থা নামের একটি সূচিশিল্প প্রতিষ্ঠান, যার কাজ হচ্ছে কার্বন ফাইবার বা কার্বনের বিশেষ তন্তুর বুননে গাড়ির বিভিন্ন উপকরণ তৈরি করা। বার্থা শব্দটির অর্থও এর কাজের সঙ্গে মিলে যায়। বার্থা মানে তাঁত বা বিশাল বয়নযন্ত্র। অটোমেটেড বা স্বয়ংক্রিয় বুনন মেশিন বার্থা ২৮৮টি ববিন থেকে কার্বন ফাইবারের ফিতা টেনে বিমানের প্রপেলার, জাহাজের হাইড্রোফয়েল বা স্পোর্টস কারের চাকা নিখুঁতভাবে বুনতে পারে। দ্রুত ও নিখুঁতভাবে যন্ত্রটি বুনে চলে আধুনিক স্পোর্টস কারের প্রয়োজনীয় উপকরণ।

ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন কারখানায় কার্বন ফাইবারের ব্যবহার শুরু হয়েছে। ১৮ শতকে পোশাকশিল্পে কারিগরি প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগে এবং আধুনিক কারখানার যাত্রা শুরু হয়। তখন থেকেই উৎপাদন শিল্পে বৈপ্লবিক মাত্রা পেয়েছে। এখন সেখানে কার্বন ফাইবারের মতো নতুন উপাদান ও ডিজিটাল প্রক্রিয়ার ব্যবহার শুরু হয়েছে। নতুন যেসব পদ্ধতি বর্তমানে ব্যবহার হচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে স্বয়ংক্রিয় বুননযন্ত্রে কার্বন ফাইবার তৈরির বিষয়টি। এতে ধীরগতির কর্মীনির্ভর উৎপাদনব্যবস্থার বদলে ব্যাপক উৎপাদনপ্রক্রিয়ার দিকে এগোচ্ছে এ শিল্প খাত। ফলে, এ খাতে ব্যাপক পরিবর্তন চোখে পড়ছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, কী এই কার্বন ফাইবার? ইকোনমিস্ট বলছে, অত্যন্ত হালকা কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী বলে কার্বন ফাইবার এখন গাড়িশিল্পসহ উৎপাদন খাতে আকর্ষণীয় উপাদান। এটি স্টিলের চেয়েও ১০ গুণ শক্তিশালী। এ ছাড়া এটি অত্যন্ত হালকা। এর ক্ষয় হয় না। তাই পরিবহনশিল্পে এর গুরুত্ব বেশি। কার্বন ফাইবার ব্যবহারে গাড়ি ও বিমান হালকা-পাতলা হয়। ফলে, এতে জ্বালানি খরচ কম লাগে। এ ছাড়া এতে দূষণ কমে।

গাড়ির কাঠামো।

ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ল্যাবরেটরি ন্যাশনাল কম্পোজিট সেন্টারের (এনসিসি) রিচার্ড ওল্ডফিল্ডের মতে, কার্বন ফাইবার ব্যবহারের আলাদা সুবিধাও আছে। অনেক জটিল ও বড় আকারের উপকরণ তৈরিতে কার্বন ফাইবার ব্যবহার করা হয়। ওয়েল্ডিং পদ্ধতিতে বিভিন্ন আকারের নাটবল্টু ব্যবহার করে বিমানের পাখা বা গাড়ির কাঠামো তৈরির পরিবর্তে কার্বন ফাইবার ব্যবহার করে পুরো কাঠামো এককভাবে তৈরি করা যায়। এতে সময় ও উপকরণ বাঁচে। এমনকি, নতুন নকশার পণ্য তৈরি করা যায়।

ষাটের দশক থেকেই প্রকৌশলীরা এই কার্বন ফাইবার নিয়ে আগ্রহ দেখাতে শুরু করেন। এতে কার্বোনাইজড পলিমার ব্যবহৃত হয়। কার্বন ফাইবার বা গ্রাফাইট ফাইবার বা কার্বন গ্রাফাইট হলো কার্বন অণুর ৫ থেকে ১০ মাইক্রোমিটার ব্যাসের সূক্ষ্ম তন্তু। ফাইবারে কার্বন অণুগুলো স্ফটিক আকারে প্রায় সমান্তরাল ও লম্বভাবে ভাবে বিন্যাসিত থাকে। কার্বন স্ফটিকগুলো লম্বালম্বিভাবে বিন্যস্ত থাকায় ওজনের অনুপাতে ফাইবারগুলো বেশ শক্তিশালী হয়। কার্বন ফাইবারের একটি আঁশ বা সুতা বানাতে কয়েক হাজার তন্তু এক সারিতে পাকিয়ে বা জোড়া দিয়ে বোনার উপযোগী সুতা বানানো যায়।

রেসিং কার

কার্বন ফাইবারের কয়েকটি বিশেষ ধর্ম, যেমন: শক্তিশালী, হালকা, উচ্চ তাপ ও চাপ সহ্যক্ষমতা, প্রসারণশীলতা ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের সঙ্গে বিক্রিয়া না করার কারণে এই ফাইবার অ্যারোস্পেস, গাড়ি নির্মাণ শিল্প, বাস্তুবিদ্যা, মিলিটারি যন্ত্রপাতি শিল্প এবং স্পোর্টস শিল্পে এর যথেষ্ট জনপ্রিয়তা রয়েছে। যৌগিক বা কমপোজিট পদার্থ তৈরি করার জন্য কার্বন ফাইবারের সঙ্গে অন্যান্য পদার্থের সংমিশ্রণ ঘটানো হয়। সাধারণত, আরও শক্ত ও শক্তিশালী কম্পোজিট পদার্থ তৈরির জন্য একে প্লাস্টিক রেজনের সঙ্গে একত্র করা হয়। এই নতুন ধরনের যৌগিক পদার্থকে বলা হয় কার্বন ফাইবার রিইনফোর্সড ম্যাটেরিয়াল (একে কার্বন ফাইবারও বলা হয়ে থাকে)। কার্বন ফাইবার কোন কাজের জন্য ব্যবহার করা হবে, সে অনুযায়ী ফেব্রিক শিট আকারে বুনে রাখা যায়। কার্বন ফাইবার তৈরির কাজ বা প্রিফর্ম প্রক্রিয়াটি আগে হাতে করা হতো। এখন পুরো প্রক্রিয়া কম্পিউটার সিস্টেমে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে করা হচ্ছে। বার্থার ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি অবলম্বন করা হচ্ছে।

১৯৮১ সালে বিশ্বের প্রথম ফর্মুলা ১ রেসিং কারে এ উপাদান ব্যবহারের পর থেকে যুক্তরাজ্যের মোটর রেসিং কার নির্মাতা ম্যাকলারেন কার্বন ফাইবার ব্যবহার করে আসছে। এখন সব এফ ১ কার কার্বন ফাইবারে তৈরি হয়। এতে এমন সুরক্ষাব্যবস্থা থাকে, যাতে দুর্ঘটনার পরও চালক নিরাপদে বের হতে পারেন। ম্যাকলারেন তাদের স্পোর্টস কার তৈরির শুরু থেকে ‘মনোসেল’ নামে কার্বন ফাইবার ব্যবহার করে আসছে। এটি গাড়ির মূল কাঠামো তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। মনোসেল তৈরিতে বিশেষজ্ঞ ঠিকাদার ব্যবহার করে মনোসেল। তবে তাদের ভবিষ্যৎ গাড়ির মডেলগুলোয় শেফিল্ডে অবস্থিত ম্যাকলারেন কম্পোজিটস টেকনোলজি সেন্টারের তৈরি হবে। ওই নতুন গাড়ির বিস্তারিত ম্যাকলারেন এখনো বলছে না। ওই কেন্দ্রের কারিগরি পরিচালক ক্লডিও স্যান্তোনি বলেন, ‘আমি প্রায়ই মনোসেলের দিকে তাকাই আর আশ্চর্য হয়ে ভাবি, এটা কীভাবে তৈরি করা সম্ভব হলো।’

ম্যাকলারেনের তথ্য অনুযায়ী, ভবিষ্যতের হাইব্রিড ও বৈদ্যুতিক গাড়িগুলোর ক্ষেত্রে ওজন কমানোর গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৫ সাল নাগাদ মনোসেল ব্যবহার করে বছরে ছয় হাজার গাড়ি তৈরি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। দামি ব্র্যান্ড হিসেবে তারা বেশি গাড়ির দিকে না গেলেও অন্য গাড়ি নির্মাতারা কিন্তু বড় আকারে ভাবছে। এর মধ্যে বিএমডব্লিউ রয়েছে। প্রতিদিন তারা আই ৩ ইলেকট্রিক মডেলের ১৩০টির বেশি গাড়ির কাঠামো তৈরি করছে। এ সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।

গাড়ির কাঠামো।

কার্বন ফাইবার তৈরির দ্রুততম আরেকটি পদ্ধতির নাম ওভারমোল্ডিং। এতে কার্বন ফাইবারের পাতে ইনজেকশন মোল্ডেড প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। ইনজেকশন মোল্ডেড পদ্ধতিতে আগে থেকেই প্লাস্টিকের যন্ত্রাংশ তৈরি হয়ে আসছে। এর মধ্যে দুটি প্রক্রিয়া একসঙ্গে করে ওভারমোল্ডিং পদ্ধতি চালু করা হয়। এতে প্লাস্টিকের যন্ত্রাংশে কার্বন ফাইবার যুক্ত করা হয়। এতে প্লাস্টিক শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তা গাড়ির দরজা, বিমানের অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জাসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ তৈরিতে কাজ লাগে।

এখন আসা যাক কার্বন ফাইবার তৈরির খরচের দিকে। আধুনিক প্রক্রিয়ার কার্বন ফাইবার তৈরির খরচ কমে গেছে। মানের ওপর নির্ভর করে এর দাম ওঠানামা কমে। তবে শিল্প খাতে ব্যবহৃত এক কেজি কার্বন ফাইবারের দাম ২০ মার্কিন ডলার। বিমানে ব্যবহৃত কার্বন ফাইবারের দাম আরেকটু বেশি। তবে গাড়িতে ব্যবহৃত স্টিলের খরচ কেজিতে ১ ডলার। কিন্তু কার্বন ফাইবার স্টিলের চেয়ে শক্তিশালী ও পাতলা হওয়ার পরিমাণে কম লাগে। তবে জ্বালানি খরচ ও বায়ুদূষণ কমানোর হার বিবেচনায় ধরলে কার্বন ফাইবারে খরচ আরও কম। কার্বন ফাইবারের খরচ কমলে শিল্প খাতে এর ব্যবহার আরও বাড়তে দেখা যাবে।

টেনেসি ওক রিজ ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির গবেষকেরা বলছেন, আরও উন্নত উৎপাদনপ্রক্রিয়া ব্যবহার করে কার্বন ফাইবার উৎপাদনের খরচ অর্ধেকে নামিয়ে আনতে পারবেন তাঁরা। তাঁরা সাশ্রয়ী উপাদান ও কম তাপমাত্রা ব্যবহার করে এ উপাদান তৈরির কথা ভাবছেন। এ ছাড়া রিসাইকেল করা উপাদান ব্যবহারের লক্ষ্য নিয়েও কাজ করছেন গবেষকেরা।

কম খরচে বেশি পরিমাণে কার্বন ফাইবার উৎপন্ন করা গেলে এবং রিসাইকেল প্রক্রিয়ায় কার্বন ফাইবার কার্যকর পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হলে বার্থার মতো আরও অনেক প্রতিষ্ঠান উঠে আসবে বলেই মনে করছেন এ খাতের বিশেষজ্ঞরা।