গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যানজট পেরিয়ে ঠিক সময়ে অফিসে আসা নিত্যদিনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজধানীতে। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে সময়মতো অফিসে আসার জন্য নিজের একটা গাড়ির স্বপ্ন রয়েছে অনেকের। কাওছার আলম তার ব্যতিক্রম নন। নিজের সঞ্চয় আর অফিস থেকে লোন নিয়ে চিন্তা করলেন এবার একটা গাড়ি কিনবেন। গাড়ি সম্পর্কে তিনি তেমন একটা জানেন না। বেশির ভাগ মানুষ রিকন্ডিশন্ড গাড়ির কথা বলেন। তিনিও চিন্তা করলেন গাড়ির দোকানে গিয়ে মনমতো একটা গাড়ি কিনে ফেললেই হবে। কিন্তু গাড়ির বাজারে এসে তাঁর মাথায় হাত। একই রকম গাড়ির হরেক রকমের মূল্য। রিকন্ডিশন্ড গাড়ির বাজারে গাড়ি কিনতে কিছু বিষয়ে জানা জরুরি। কেনার আগে কীভাবে সেরা গাড়িটি পছন্দ করবেন, তা জানাতেই এই প্রতিবেদন।
দেশে বেশির ভাগ রিকন্ডিশন্ড গাড়ি জাপান থেকে আসে। জাপানে ব্যবহৃত এই গাড়িগুলো পুনরায় যখন বাজারে বিক্রি হয়, তখন এই গাড়িগুলোকে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি বলে। সাধারণত পাঁচ বছরের বেশি পুরোনো গাড়ি রিকন্ডিশন্ড বাজারে আসে না। তাই গাড়ি কেনার আগে জাপানি গাড়ি নির্মাতা-প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে ধারণা অর্জন করতে হবে। তারপর সেই প্রতিষ্ঠানের নির্মিত গাড়ির মডেল এবং সাল অনুসারে গাড়ির ধারণা নেওয়ার জন্য ইন্টারনেটে ভিডিও বা ছবি দেখা যেতে পারে। পছন্দ হলে এবার গাড়ি বিক্রেতার কাছে যাওয়ার পালা।
ব্র্যান্ড মূল্য
বাংলাদেশের রিকন্ডিশন্ড গাড়ির বাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রীত গাড়ির নাম টয়োটা। গাড়ি নির্মাতা এই প্রতিষ্ঠানের পরেই রয়েছে হোন্ডা। এ ছাড়া নিশান, মাজদা, মিতশুবিশিসহ বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় জাপানি গাড়ি নির্মাতা-প্রতিষ্ঠানের গাড়ি দেশে জনপ্রিয়। ব্র্যান্ড পছন্দ হলেই জেনে নিতে হবে যে গাড়িটি কিনতে যাচ্ছেন, সেই গাড়িটি দেশের বাজারে কতটা জনপ্রিয়। বেশি বিক্রীত গাড়ির যন্ত্রাংশ সহজে পাওয়া যায়। যে মডেল যত বেশি জনপ্রিয়, সেই মডেলের গাড়ির যন্ত্রাংশ তত বেশি সহজলভ্য। গাড়ি রাস্তায় চললে যন্ত্রাংশের প্রয়োজন হবে। আর সহজে কেনা গেলে দামেও সাশ্রয়ী হবে।
গাড়ির চেহারা
কথায় আছে, আগে দর্শনদারি পরে গুণ বিচারি। সে হিসেবে যে গাড়িটি কিনবেন, তার ভেতর-বাহির আপনার পছন্দের সঙ্গে মিলিয়ে নিন। প্রতিটি গাড়ি মডিফাই করার সুযোগ রয়েছে। তাই মনের মতো ৮০ শতাংশ পেলে আর ২০ শতাংশ বাজার (আফটার মার্কেট) থেকে যন্ত্রাংশ কিনে সংযোজন করা যায়। গাড়ির রং, আসনের বর্তমান অবস্থা, ইঞ্জিনের বাইরের চেহারাসহ (আউটলুকিং) ভেতর ও বাইরেটা দেখে নিতে হবে।
নিলাম বা পরিদর্শনশিট
দেখা শেষ হলে শুরু হবে গুণের বিচার। জাপানের নিলাম প্রতিষ্ঠানগুলো (অকশন হাউস) গাড়ি উপস্থাপনের সময় গাড়ি-সম্পর্কিত একটি নিরীক্ষা প্রতিবেদনও প্রকাশ করে। এই অকশনশিটটি সাধারণত জাপানি ভাষায় হয়ে থাকে। একটি অকশনশিট পড়েই গাড়ি সম্পর্কে সব জেনে যাবেন, এমন ধারণাও ভুল। অকশন বা ইন্সপেকশনশিট সম্পর্কে মেভেন অটোসের স্বত্বাধিকারী মো. আশফাক ইবনে আবদুল আওয়াল বলেন, অকশনশিটে সর্বোচ্চ গ্রেড হলো এস বা সিক্স। এই গাড়িগুলো প্রায় নতুন (ব্র্যান্ড নিউ) গাড়ির মতো। তবে কেউ আপনাকে নিশ্চিত করে বলতে পারবে না যে এই গ্রেডের গাড়ি কিনে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হবেন কি না। কারণ গাড়িগুলো তেমন ব্যবহার না হওয়ার ফলে এর যন্ত্রাংশের কী অবস্থা তা জানা যায় না। যেমনটা একটি নতুন স্মার্টফোনও দুই দিন পরে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তবে অকশনশিট দেখে আপনি গাড়ি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পাবেন। তিনটি তারকা দেওয়া যে গ্রেড থাকে, সেটির গাড়ি না কেনাই উত্তম। কারণ এই গাড়িগুলো দুর্ঘটনাজনিত বা আগুনে পুড়ে যাওয়া, বন্যায় ডুবে যাওয়া অথবা খুব বেশি পরিবর্তন করা বা হাইলি মডিফায়েড গাড়ি হতে পারে। গাড়ির গ্রেডের চেয়েও গাড়ি কত কিলোমিটার চলেছে তা দেখা গুরুত্বপূর্ণ।
এস বা সিক্স গ্রেডের পরে ফাইভ, ফোর পয়েন্ট ফাইভ, ফোর, থ্রি পয়েন্ট ফাইভ, থ্রি, টু পয়েন্ট ফাইভ বা টু—এভাবে গাড়ির গ্রেডিং হয়ে থাকে। জাপানে গাড়ি রং করানো বেশ ব্যয়বহুল। তাই গাড়িতে দাগ পড়লেও সাধারণত জাপানিরা সেভাবেই গাড়ি ব্যবহার করে থাকেন। আর জাপানের বাতাসে ধুলাবালু কম থাকায় গাড়ির রং ধূসর হয়ে যায় না। কিন্তু বাংলাদেশে রং মলিন হয়ে যাওয়া সাধারণ ব্যাপার। গাড়ির রঙের ‘কালার কোড’ জানা জরুরি। এতে গাড়ির রং পরিবর্তনের তথ্য জানা যায়। এ ছাড়া গাড়ি কোথাও গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত কি না, যন্ত্রাংশ বদলানো, কোন বছর/মাসে উৎপাদন, সে সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা অকশনশিটে মেলে।
অকশনশিট পরীক্ষা করা
গাড়ি পছন্দ হয়ে গেলে গাড়ির চেসিস নম্বর নিয়ে অকশনশিটকে তৃতীয় পক্ষের নিরীক্ষা প্রতিবেদন নিয়ে যাচাই করা যায়। ৮-১০ ডলার (দেশি টাকায় ৮০০-১০০০ টাকা) খরচ করে অকশনশিটের সত্যতা যাচাই করা যায়। গাড়ির কোনো নকল অকশনশিট, মাইলেজ টেম্পারিং বা গাড়ির রং বদল করা হয়েছে কি না, তা এই পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায়। বেশির ভাগ গাড়ির অকশনশিট যাচাই করা গেলেও কিছু কিছু গাড়ি সম্পর্কে তৃতীয় পক্ষের কাছে প্রতিবেদন পাওয়া যায় না। তবে প্রতিবেদনটি না পেলেই যে গাড়ি খুব খারাপ, এমন ভাবারও কারণ নেই।
গাড়ির বিক্রেতা সম্পর্কে জানা
আপনি যে দোকান থেকে গাড়ি কিনবেন বলে ঠিক করেছেন, তার সম্পর্কে তথ্য জানার চেষ্টা করতে হবে। একজন গাড়ি আমদানিকারকের ওপর গাড়ির মূল্য নির্ভর করে। যিনি সারা বছরে ৪০০-৫০০ গাড়ি আমদানি করেন আর যিনি চার-পাঁচটি গাড়ি আমদানি করেন, তাঁরা সমান মানের হতে পারেন না। কারণ যত বেশি আমদানি, তত বেশি অভিজ্ঞতা। আর বেশি গাড়ি আমদানি করলে আমদানিকারক জাপানের বিক্রেতার কাছেও বাড়তি সুবিধা পান। এ ছাড়া জাপান থেকে অকশনে গাড়ি কেনার পর সেই গাড়িটি জাপানেই সামনাসামনি দেখার সুযোগ থাকে। যাঁদের প্রতিনিধি জাপানে থাকেন, তাঁরা এই কাজগুলো দক্ষতার সঙ্গে করতে পারেন। অনেক আমদানিকারকের জন্য এই সুবিধা নেওয়া কঠিন বটে। তাই বিশ্বস্ত বিক্রেতার কাছ থেকে গাড়ি কিনলে ঠকে যাওয়ার আশঙ্কা কম।
গাড়ির পুনর্নিরীক্ষণ
গাড়ি পছন্দ হলে সেই গাড়িটির ইঞ্জিন, সাসপেনশন, হুইল অ্যালাইনমেন্ট, চেসিস কন্ডিশন, আন্ডার বডি চেক করার জন্য বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। রহিমআফরোজ, নাভানা লিমিটেড অথবা আকিজ অটোমোবাইল সেন্টার এ ক্ষেত্রে জনপ্রিয়। পছন্দের গাড়িটিকে নিয়ে চলে যান গাড়ির চেকআপে। চেসিসে সমস্যা রয়েছে—এমন গাড়ি কেনা থেকে সাবধান। হাইব্রিড গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে গাড়ির ব্যাটারির অবস্থাও পরীক্ষা করে নেওয়া বাঞ্ছনীয়।
রয়েছে প্রি-অর্ডারের সুযোগ
ডিজিটাল যুগে প্রি-অর্ডার দিয়েও রিকন্ডিশন্ড গাড়ি কেনার সুযোগ রয়েছে। অনলাইনে গাড়ির ছবি দেখে গাড়ি বিক্রেতা আপনাকে গাড়ি কিনতে সহযোগিতা করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে বুকিং মানি দিয়ে গাড়ি পছন্দ করে নিশ্চিত করার ব্যবস্থা থাকে। অনেক গাড়ি বিক্রেতা যেসব গাড়ি জাপান থেকে জাহাজে উঠে যায়, সেসব গাড়ির মধ্য থেকেও গাড়ি পছন্দ করার সুবিধা দিয়ে থাকেন।
মিলবে ঋণ
গাড়ি কেনার জন্য ব্যাংক থেকে শুরু করে অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট সুদে লোন দিয়ে থাকে। গাড়ির শোরুমে আপনার যে পরিমাণ লোনের দরকার, তা উল্লেখ করে ব্যাংকের সঙ্গেও লেনদেন করার সুযোগ রয়েছে।
পরীক্ষামূলক চালনা
সবকিছু চেক করার পর গাড়ি মনঃপূত হলে তা চালিয়ে দেখতে হবে। নিজে ড্রাইভ না পারলে অভিজ্ঞ চালককে দিয়ে গাড়িটি চালানোর স্বাচ্ছন্দ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। গাড়ির শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্রটির প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। গাড়ির কোথাও জং পড়েছে কি না, ভালোভাবে পরীক্ষা করতে হবে।
বিক্রয়োত্তর সেবা
অনেক গাড়ি আমদানিকারকের বিক্রয়োত্তর সেবা দেওয়ার জন্য সার্ভিস সেন্টার থাকে। যে গাড়িটি কিনবেন, সেই গাড়িতে বিক্রয়োত্তর সেবা পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নিন। গাড়ির জন্য সার্ভিস গুরুত্বপূর্ণ। তাই সময়মতো সার্ভিস সেন্টারে পাঠালে গাড়ির কার্যক্ষমতা অটুট থাকে।
সালসাবিল কারের মহাব্যবস্থাপক মনিরুল আলম বলেন, গাড়ি পছন্দ করে বুঝেশুনে কিনলে ৮-১০ বছরে কিছুই হয় না। গাড়ি কেনার আগে কী প্রয়োজনে গাড়ি কিনছেন, তা নির্ধারণ করা জরুরি। দেশের বাজারে ১৫০০ সিসির গাড়ি জনপ্রিয়। এটা অবশ্য ট্যাক্সের কারণে। ছোট পরিবারের জন্য হলে পাঁচ আসন আর বড় পরিবারের জন্য হলে সাত আসনের গাড়ি কেনা উত্তম। গাড়ির রং অনুসারেও মূল্য ভিন্ন হয়ে থাকে। মোটকথা, যেভাবেই গাড়ি কেনেন, গাড়ি কেনার আগে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সময়মতো গাড়ি সার্ভিস করানোটাও গুরুত্বপূর্ণ।
স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ কেনার মতো গাড়ি কেনা অতটা সহজ নয়। অনলাইনে পড়াশোনা করেও গাড়ি সম্পর্কে ধারণা অর্জন করা যায়। তাই কেনার আগে সঠিক মডেলের গাড়িটি পছন্দ করুন। জেনে নিন গাড়িটি বিক্রি করতে গেলে কেমন দাম পেতে পারেন। মোটকথা, একজন ভালো গাড়ি আমদানিকারক এবং আপনার গাড়ি-সম্পর্কিত জ্ঞান চলার পথকে সহজ করে দিতে পারে। তো শুরু হোক রিকন্ডিশন্ড গাড়ির সঙ্গে পথচলা।
রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস এবং
বিমা সম্পর্কে
গাড়ি কেনার পর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) নিবন্ধিত হওয়া বাধ্যতামূলক। গাড়ি বিক্রেতা কি এ বিষয়ে আপনাকে সাহায্য করবে, না নিজের করতে হবে, এ সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য জানতে হবে। লোনে গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে প্রথম বছর প্রথম পক্ষ বিমা করা বাধ্যতামূলক।
পরামর্শ নিতে হবে বুঝেশুনে
রোগীর চেয়ে যেন চিকিৎসকের সংখ্যা বেশি। কারণ বেশির ভাগ মানুষ বুঝে অথবা না বুঝে উপদেশ দিতে পছন্দ করে। কেউ একটা গাড়ি চালিয়ে অন্য আরেকটা গাড়ি সম্পর্কে শোনা কথায় বিরূপ মন্তব্য করলে তার কথা শোনার আগে আবার চিন্তা করা উচিত। একই রাস্তা, একই গাড়ি, একই জ্বালানিশক্তি ব্যবহার করেও শুধু চালকের কারণে দুটি গাড়ির দক্ষতা ভিন্ন হতে পারে। তাই যিনি সত্যিকার অর্থেই গাড়ি সম্পর্কে জানেন তাঁর মন্তব্য নিন।