যেভাবে আপনার পকেট খালি করবে ফেসবুক

ফেসবুক
ফেসবুক

ফেসবুকের কাছে আপনার সব তথ্যই আছে। ফলে তারা আপনার সবকিছুর ওপর প্রভাব ফেলতে পারছে। এখন তাদের দরকার আপনার পকেটের তথ্য। সে ব্যবস্থাও পাকা হওয়ার পথে। ফেসবুক ‘লিবরা’ নামে একধরনের ভার্চ্যুয়াল মুদ্রা (ক্রিপটোকারেন্সি) ছাড়ার পরিকল্পনা করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফেসবুকের এ মুদ্রা যদি মূলধারার লেনদেন পদ্ধতি হিসেবে ঢুকে পড়ে, তবে গ্রাহকদের জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি হবে। অনেকের বাজে খরচের অভ্যাস গড়ে উঠবে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক আইনপ্রণেতা এ মুদ্রা আনার বিপক্ষে। সমালোচকেরাও এ নিয়ে মুখ খুলেছেন।

কনসোর্টিয়াম সহযোগী, পেমেন্ট সেবাদাতা, ক্রেডিট কার্ড কোম্পানি ও গ্রাহক কোম্পানিদের সঙ্গে নিয়ে নতুন মুদ্রা আনতে বেশ আটঘাট বেঁধে নেমেছে ফেসবুক। ২০২০ সালের প্রথমার্ধে এ মুদ্রা আনার পরিকল্পনা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। ফেসবুকের লিবরা সবাইকে একটি ইলেকট্রনিক ওয়ালেটের সুবিধা দেবে। ফেসবুক বলছে, আন্তর্জাতিক সব মুদ্রার মূল্যমানের সঙ্গে সংগতি রেখে এই মুদ্রার মূল্যমান ধরা হবে। প্রচলিত মুদ্রা দিয়ে লিবরা কেনা যাবে।

ফেসবুকের এক শ্বেতপত্রে বলা হয়, লিবরার সঙ্গে ফেসবুক ব্যবহারকারীর তথ্যের যোগসূত্র থাকবে না বলে তাদের লক্ষ্য করে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করা হবে না। তবে ফেসবুকের পক্ষ থেকে লিবরা পেমেন্টের সঙ্গে ফেসবুকের বিভিন্ন পণ্য যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে ফেসবুকের। ফেসবুকের এসব পণ্য কয়েক শ কোটি ব্যবহারকারী নিয়মিত ব্যবহার করছেন। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।

যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি আর্থিক পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর ক্রেডিট কাউন্সেলিংয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট ব্রুস ম্যাকলেরি বলেন, অনেক ব্যবহারকারীর জন্য খুব সহজে ফেসবুকের টুল ব্যবহার করে কেনাকাটা করার অভ্যাস বিপজ্জনক হবে। যাঁরা বাজেট নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হন, তাঁদের জন্য এটি ভয়ানক বিপদ ডেকে আনবে।

ফেসবুক কর্তৃপক্ষ অবশ্য এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।

সাম্প্রতিক এক জরিপের ফল বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের এক-তৃতীয়াংশের মত হচ্ছে, তাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অভিজ্ঞতা থেকে প্রভাবিত হয়ে অর্থ খরচ করেন। গত ফেব্রুয়ারি মাসে চার্লস সোয়াব এক হাজার ব্যক্তির মধ্যে এ জরিপ চালায়। জরিপে অর্থ ব্যবস্থাপনায় প্রভাব রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বাজে তালিকার শীর্ষে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।

নিউ জার্সির উডব্রিজ নামের বিনিয়োগ পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞ টাইরন রস বলেন, লিবরা চালু হলে অতিরিক্ত খরচ শুরু হবে। কারণ, এতে সহজে সবাই ঢুকতে পারবে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে। যেহেতু মানুষের অভ্যাস তাদের জানা থাকবে, তাই তাদের জন্য যেকোনো কিছু করা সহজ হবে। এটাই করতে চাইছে তারা।

বিটকয়েনের মতো ক্রিপটোকারেন্সির সঙ্গে এর পার্থক্য হবে সহজলভ্য ও সহজে ব্যবহার করার সুবিধা। বিটকয়েন ব্যবহার করে বিভিন্ন বিল দেওয়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ও সেবার দাম দেওয়া যাবে।

বিশেষজ্ঞ রস বলেন, লিবরা মূলত কোনো কিছু বিনিময়ের মুদ্রা বা কারেন্সি হিসেবে তৈরি করা হচ্ছে। এটি বিটকয়েনের মতো কোনো বিনিয়োগ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। একে স্থিতিশীল ডিজিটাল ক্রিপটোকারেন্সি হিসেবে বর্ণনা করেছে ফেসবুক। এর পেছনে বাস্তব সম্পদের সম্পূর্ণ বিনিয়োগ থাকবে।

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোসেফ ই স্টিগলিৎসের ভাষ্য, বিকল্প মুদ্রার প্রচলন করার উদ্যোগের সময়টিও বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। বিগত দিনে প্রচলিত মুদ্রা সম্পর্কে প্রধান অভিযোগ ছিল অস্থিতিশীলতা; অর্থাৎ হুট করেই মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেওয়া। ফেসবুকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অতর্কিত স্ফীতির কারণে এই প্রচলিত মুদ্রার ওপর মানুষের আস্থা কমছে। কিন্তু ডলার, ইউরো, ইয়েন এবং রেনমিনবি দীর্ঘদিন স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। আজকের দিনে এসব মুদ্রার স্ফীতি নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই, দুশ্চিন্তার কিছু যদি থেকেই থাকে, তবে তা মুদ্রাস্ফীতি অস্বাভাবিক হ্রাস নিয়ে থাকতে পারে।

ফেসবুক বলছে, ভার্চ্যুয়াল মুদ্রায় ব্যাংক ডিপোজিট, স্বল্পমেয়াদি সরকারি নিরাপত্তার মতো বিষয় যুক্ত থাকবে। এতে অন্যান্য ক্রিপটোকারেন্সির মতো মুদ্রাস্ফীতি হবে না।

বিনিময়ের উদ্দেশ্যে বিটকয়েনের মুদ্রা তৈরি হয়নি। এ ছাড়া এর ব্যবহার নিয়েও স্বচ্ছতা নেই। এ মুদ্রা ব্যবহারের জন্য কারিগরি জ্ঞান লাগে।

নিউইয়র্কের স্ট্যাস ওয়েলথের প্রতিষ্ঠাতা সহযোগী প্রিয়া মালানি বলেন, ডিজিটাল অর্থ বা গেমিফাই করার ফলে বাছবিচার না করে কেনাকাটা করবেন অনেকে। ফলে ব্যয় বাড়বে।

লিবরার উন্নয়নকারী ফেসবুকের ক্যালিব্রা বিভাগের প্রধান ডেভিড মার্কাস বলেন, ভবিষ্যতে ভার্চ্যুয়াল মুদ্রায় তাঁরা নানা আর্থিক সুবিধা দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। এর মধ্যে ঋণদানের মতো বিষয়ও রয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী তাঁর অ্যাকাউন্টে যে লিবরা জমা রাখবেন, তার বিপরীতে ফেসবুক তাঁকে কোনো সুদ দেবে না। কিন্তু ফেসবুক গ্রাহকের জমা রাখা সেই লিবরা বিনিয়োগ করে তা দিয়ে আয় করা যাবে। কোটি কোটি গ্রাহকের জমা রাখা কোটি কোটি লিবরা লগ্নি করে ফেসবুক আয় করবে, কিন্তু সেই আয়ের কোনো অংশ গ্রাহক পাবেন না।

মালানি বলেন, কারও যদি বেহিসেবি জীবনযাপন হয়, তবে ফেসবুকের একবারের কেনাকাটা তাঁকে ঋণী করে রাখবে। সারা বছর তাঁকে উচ্চ হারে সুদ দিতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর যুক্তরাষ্ট্রে গ্রাহকের দেনার পরিমাণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে এখন গ্রাহক দেনার পরিমাণ ৪ ট্রিলিয়ন ডলার।

জোসেফ ই স্টিগলিৎসের ভাষ্য, ফেসবুক নানা কারণে ইতিমধ্যে অনাস্থার কারণ হয়েছে। সে কারণে ব্যাংকিং খাতে তার এই আবির্ভাবকে সহজভাবে আস্থার সঙ্গে নেওয়া কঠিন। ২৪০ কোটি সক্রিয় ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য-উপাত্ত এ মুহূর্তে ফেসবুকের হাতে। অর্থ জালিয়াতিতে এই উপাত্ত ব্যবহৃত হবে না, ফেসবুক সে নিশ্চয়তা দিতে পারবে কি? এখন পর্যন্ত লিবরা প্রচলন করার বিষয়ে ফেসবুক যেসব তৎপরতা চালিয়েছে, তা যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে বিশদভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক খাত যেসব নীতিমালার আওতায় কাজ করে, ফেসবুককে একই নীতিমালার অধীনে আসতে হবে। ফেসবুক তার গ্রাহকদের জমা রাখা লিবরাকে প্রচলিত মুদ্রায় ভাঙিয়ে তা লগ্নি করবে না, সেই প্রতিশ্রুতি তাকে দিতে হবে।