>প্রযুক্তি যত এগিয়েছে, লেখালেখির মাধ্যমেও তত পরিবর্তন এসেছে। সিসার টাইপ, টাইপ রাইটার, কম্পিউটার হয়ে এখন স্মার্টফোনেও বাংলা লেখা যায় সহজে। যন্ত্রে যন্ত্রে বাংলা লেখার নানা প্রযুক্তি নিয়ে এবারের প্রচ্ছদ আয়োজন।
নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনের সঙ্গে সঙ্গে লেখার মাধ্যমগুলোরও পরিবর্তন হয়ে আসছে। বহুদিন আগে থেকেই হাতে লিখে তথ্য সংরক্ষণ করা হতো। লেখালেখির যন্ত্র উদ্ভাবনের সঙ্গে সঙ্গে লেখার জন্য সেগুলোর ব্যবহার বাড়তে শুরু করে। ছাপাখানার উদ্ভাবন ও ছাপাখানা ঘিরে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভাবন হতে থাকে। গবেষণার মাধ্যমে এমন সব প্রযুক্তি সহজলভ্য হতে থাকে, যার মাধ্যমে লেখালেখি, সম্পাদনা ও ছাপার মান বাড়তে থাকে। কম্পিউটার উদ্ভাবন ও সেটি প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পরপরই এসব প্রযুক্তি একটা নতুন মাত্রায় পৌঁছে যায়। একটা সময় পর্যন্ত লেখা প্রকাশ, সংরক্ষণ ও আদান–প্রদান কেবল কাগজে সীমাবদ্ধ ছিল বলা যেতে পারে। ইন্টারনেটের ধারণা প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশনা ও লেখালেখি তথা তথ্য আদান–প্রদানের একটি সম্পূর্ণ নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়।
লেখালেখির প্রযুক্তি উন্নয়নের প্রতিটি ধাপে অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গেই বাংলায় সেই প্রযুক্তি ব্যবহারের ইতিহাস রয়েছে। তবে এই প্রযুক্তিগুলোর প্রথম উদ্ভাবন হয়েছিল ইংরেজি ভাষার জন্য। বাংলা ও ইংরেজি ভাষাগত পার্থক্যের কারণে এবং অপর ভাষার একটি প্রযুক্তি বাংলার জন্য তৈরি হতে কিছুটা সময় ব্যয় হয়েছে। বাঙালি হিসেবে বাংলায় সঠিকভাবে লিখতে পারা স্মার্টনেস, একেবারে শুরু থেকে যাঁরা বাংলা লেখার মান উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁরা মূলত নিজেদের ভালোবাসার থেকেই এগিয়ে এসেছেন।
যন্ত্রে বাংলা লেখার শুরু
১৭৭৮ সালে হুগলিতে মুদ্রিত হলহেডের বই থেকে বাংলা মুদ্রণের ইতিহাস শুরু। সিসার তৈরি হরফে প্রকাশনা শিল্প জনপ্রিয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাও এগিয়ে যেতে থাকে। টাইপরাইটারের উদ্ভাবন হয়েছিল ইংরেজির জন্য এবং এটি তুমুল জনপ্রিয় হলেও প্রথমে বাংলার জন্য কোনো টাইপিং কিবোর্ড লেআউট ছিল না। শহীদ মুনীর চৌধুরী ১৯৬৫ সালে বাংলার ম্যানুয়েল কি-বোর্ডের জন্য শব্দের পৌনঃপুনিকতা যাচাই করে প্রথম একটি বিজ্ঞানসম্মত কি–বোর্ড প্রণয়ন করেন। তাঁর এই কাজে তাঁকে সহায়তা করে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড। নাম দেওয়া হয় অপটিমা মুনীর।
বাংলাদেশে কম্পিউটারে ব্যবহার উপযোগী যে বাংলা সফটওয়্যার তৈরি হয় তা ‘শহীদলিপি’ নামে পরিচিত। সাইফ উদ দোহা শহীদ এটি তৈরি করেন। ফন্ট ও কি–বোর্ড ড্রাইভার নিয়ে তৈরি এই প্যাকেজ ১৯৮৪ সালে বাজারে আসে। তবে এটি তেমন একটা ব্যবহৃত হয়নি।
১৯৮৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ম্যাকিন্টোশের জন্য তৈরি ফন্ট ও কি–বোর্ড প্যাকেজ ‘বিজয়’ প্রকাশ করে ঢাকার আনন্দ কম্পিউটার্স। পরবর্তীকালে উইন্ডোজ ৩.১-এর উপযোগী বিজয় কি–বোর্ড সফটওয়্যার প্রকাশ করা হয়। এই কি–বোর্ড ব্যবহার করে আগের তুলনায় কয়েক গুণ দ্রুতগতিতে টাইপ করা সম্ভব হয়ে ওঠে। তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বিজয়, যা এখনো কম্পিউটারে বাংলা লেখার বেলায় শীর্ষ স্থানে রয়েছে।
প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত প্রায় সবাই বিজয় সফটওয়্যার ব্যবহার করতে শুরু করে। প্রকাশনা শিল্পে বিজয় কি–বোর্ড একটি নতুন যুগের সূচনা করেছিল, পরবর্তীকালে এটি ইউনিকোডের উপযোগী হিসেবে প্রস্তুত করা হয়। বিজয় কি–বোর্ডের নির্মাতা বর্তমানে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘বিজয় কি–বোর্ড ও সফটওয়্যারটি হঠাৎ করে জনপ্রিয়তা পেয়েছে এমন নয়, এই লে–আউট তৈরি করার জন্য আমি একেবারে শুরু থেকে বাংলা শব্দের ফ্রিকোয়েন্সি যাচাই করে লে–আউট নকশা করেছি, সফটওয়্যারের বৈশিষ্ট্য সংযোজন ও মান উন্নয়ন করেছি নিয়মিতভাবে। ম্যাকিন্টোশ থেকে উইন্ডোজ, আসকি থেকে ইউনিকোড—সবক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য বিজয় লে–আউট ও সফটওয়্যারটি উপযোগী।’
ইউনিকোড
১৯৯১ সালে ইউনিকোডের প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ইউনিকোড পদ্ধতিটি ডেস্কটপে ও অনলাইনে লেখার ক্ষেত্রে অনন্য এক অধ্যায় শুরু করে। একই সঙ্গে ইন্টরনেটে বাংলার ব্যবহার সহজ হয়ে যায়। বর্তমানে সব ধরনের লেখার জন্য ইউনিকোড একমাত্র পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ইউনিকোডের বিশেষ সুবিধা হলো এটি ফন্টনির্ভর হয়, ইউনিকোডের মান অনুযায়ী তৈরি যেকোনো ফন্ট ব্যবহার করে এটি লেখা যায়, এবং বিশেষ কোনো সফটওয়্যারনির্ভরও নয়। ফলে নতুন নতুন সফটওয়্যার ও ফন্ট তৈরি হতে শুরু করে, যেগুলো ব্যবহার করে বাংলা লেখার চর্চা বাড়তে থাকে।
বাংলাদেশের জাতীয় কি–বোর্ড নামে একটি লে–আউট রয়েছে যেটি সরকার কর্তৃক স্বীকৃত। এটি ইউনিকোড সমর্থন করে এবং বাংলা লেখার যেকোনো সফটওয়্যারে এই লে–আউট যুক্ত করে বাংলায় টাইপ করা সম্ভব। লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেমভিত্তিক সব ডিস্ট্রিবিউশনে এই লে–আউট ব্যবহার করে বাংলা লেখা যায়।
অভ্র কি–বোর্ড
ইউনিকোডে বাংলা লেখার সফটওয়্যার হলো অভ্র কি–বোর্ড। অভ্র ফোনেটিক নামের একটি কি–বোর্ড লে–আউটসহ জনপ্রিয় অন্যান্য আরও কয়েকটি লে–আউটে লেখার সুবিধা রয়েছে এখানে। মূল সফটওয়্যারটি উইন্ডোজের জন্য তৈরি করা হলেও কি–বোর্ড লে–আউটগুলো সব অপারেটিং সিস্টেমে ব্যবহারের উপযোগী। এই সফটওয়্যারের আরও সুবিধা হলো এটি ব্যবহার করে ডেস্কটপে ও ইন্টারনেটে বাংলায় লেখা যায়। ফলে নতুন একদল ব্যবহারকারী তৈরি হতে শুরু করে, যারা আগে কখনোই হয়তো বাংলা টাইপিং জানত না। সফটওয়্যার প্রকৌশলী মেহদী হাসান খান অভ্র তৈরি করেন ওমিক্রন ল্যাবের নামে। তাঁর সঙ্গে যোগ দেন আরও স্বেচ্ছাসেবক। এটি বর্তমানে মুক্ত সফটওয়্যার হিসেবে সহজলভ্য। নিয়মিতই হালনাগাদ হচ্ছে অভ্র।
বিজয় এখন জাতীয় কি–বোর্ড
জাতীয় কি–বোর্ড লে–আউট বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল কর্তৃক প্রণীত একটি লে–আউট, এটিকে প্রমিত লে–আউট হিসেবে ধরা হয়। ২০০৪ সালে এটি প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেই সময় প্রচলিক একাধিক কি–বোর্ড লে–আউটের বিভ্রান্তি দূর করে একটি প্রমিত লে–আউট তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। ৪ স্তরবিশিষ্ট একটি কি–বোর্ড লে–আউটটি প্রচলিত অন্যান্য লে–আউট থেকে কিছুটা জটিল হওয়ায় তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল জাতীয় কি–বোর্ড লে–আউটটি সংশোধন করে এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় বিজয় কি–বোর্ড লে–আউটকে জাতীয় কি–বোর্ড লে–আউট হিসেবে ঘোষণা করে। এমনকি বাংলা লেখার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কম্পিউটার কাউন্সিলের উদ্যোগে জাতীয় কি–বোর্ডের মাধ্যমে বাংলা লেখার একটি সফটওয়্যার তৈরি করে বিনা মূল্যে সবার জন্য প্রকাশ করা হবে।