অন্ধকার গুহার ভেতরে সুরক্ষা পোশাক পরিহিত একদল মানুষ ঢুকছেন। গুহায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে কারও পাখার ঝাপটানির শব্দ। স্বচ্ছ সুরক্ষা মুখোশ পেরিয়ে আতঙ্কিত কারও মুখের শঙ্কার রেখাও দেখা যাচ্ছে। এই পর্যন্ত পড়লে নিশ্চিতভাবেই একে কোনো হরর সিনেমার দৃশ্য বলে মনে হবে। কিন্তু আদতে তা নয়।
এখানে যে একদল মানুষের কথা বলা হচ্ছে, তাঁরা আসলে একদল গবেষক। হ্যাঁ, তাঁদের চোখে–মুখেও অবশ্য শঙ্কার রেখা থাকতে পারে। তবে তা কোনো ভূত–প্রেতের কারণে নয়। তাঁদের ভয়, যদি এই সুরক্ষা বর্ম পেরিয়ে কোনো জীবাণু শেষ পর্যন্ত তাঁদের শরীরের দেখা পেয়ে যায়, তাহলে কী হবে। এই গবেষকেরা ঘুরে বেড়ান গুহা থেকে গুহায়। বিশেষত যেসব গুহায় বাদুড়ের বাস, সেসব গুহার দিকেই তাঁদের নজর বেশি। পৃথিবীতে অঢেল রকমের শিকারি থাকলেও তাঁরা এক নতুন ধারার শিকারি। তাঁরা ভাইরাস–শিকারি। বিশ্বকে কোনো জীবাণুর কারণে সৃষ্ট মহামারির হাত থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে তাঁরা নতুন নতুন ভাইরাস খুঁজে বেড়ান।
মার্কিন বেসরকারি সংস্থা ইকো–হেলথ অ্যালায়েন্স মহামারি প্রতিরোধে নতুন ভাইরাস খোঁজার কাজে অভিজ্ঞ। এই সংস্থার প্রেসিডেন্ট পিটার ডাসজাক। চীনের দক্ষিণ–পশ্চিমের ইউনান প্রদেশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন গুহায় থাকা বাদুড়ের শরীর থেকে রক্ত ও মুখ থেকে লালারস সংগ্রহ করেন। এই রক্ত ও লালারস সংগ্রহ বেশ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। কারণ, এই সময়ে দুর্ঘটনাবশত যদি বাদুড়ের প্রস্রাব বা লালা বা এমন কিছু তাঁদের শরীরের সংস্পর্শে আসে এবং তাঁরা এটি বহন করে নিয়ে আসেন বাইরে, তবে এটিই হতে পারে সেই সম্ভাব্য মহামারির শুরু, যা প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ভাইরাসের খোঁজে তাঁরা নেমেছেন। সাম্প্রতিক কিছু ভয়াবহ ভাইরাসের উৎস বাদুড় হওয়াতেই এই গবেষক দল ভাইরাসের খোঁজে সেই সব গুহায় অভিযান চালায়, যেখানে বাদুড়দের বাস।
পিটার ডাসজাক ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ভাইরাস শিকার করছেন। এখন পর্যন্ত বিশ্বের ২০টির বেশি দেশ তিনি এ লক্ষ্যে ভ্রমণ করেছেন। নতুন জীবাণু, আরও ভালো করে বললে করোনাভাইরাস পরিবারের নতুন কোনো সদস্যের দেখা মেলে কি না, তা–ই তিনি খুঁজে বেড়িয়েছেন বছরের পর বছর, গুহা থেকে গুহায়। পিটার ডাসজাকের মতো এমন ব্যক্তিদের তৎপরতায় বিজ্ঞানীরা অন্য প্রাণীর শরীরে থাকা এবং মানুষের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, এমন ভাইরাস সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণাটি পেতে পারেন। আর এই জানার মধ্য দিয়েই তাঁরা বিশ্বকে পরবর্তী মহামারি প্রতিরোধে প্রস্তুত করে তুলতে পারেন।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে পিটার ডাসজাক বলেন, 'বাদুড় থেকে আমরা ১৫ হাজারের বেশি নমুনা সংগ্রহ করেছি। এসব নমুনা থেকে আমরা প্রায় ৫০০ নতুন করোনাভাইরাস শনাক্ত করতে পেরেছি। এর মধ্যে চীনের একটি গুহা থেকে ২০১৩ সালে একটি নমুনা আমরা পেয়েছিলাম, যা সম্ভবত এই কোভিড–১৯–এর জন্য দায়ী করোনাভাইরাসের পূর্বতন।'
ইকো–হেলথ অ্যালায়েন্সের সংগৃহীত নমুনাগুলো বিশ্লেষণের জন্য বিশেষ যন্ত্র তৈরি করেছেন সিঙ্গাপুরভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ডিউক–নাসের ভাইরোলজিস্ট ওয়াং লিনফা। নতুন নতুন ভাইরাস খোঁজার এই কার্যক্রম সম্পর্কে তিনি সিএনএনকে বলেন, '২০০৩ সালে সার্স মহামারির আগে করোনাভাইরাস পরিবারের ভাইরাসদের নিয়ে গবেষণায় এমন মনোযোগ ছিল না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণায় এটিকে খুব একটা আকর্ষণীয় শাখা বলে মনে করা হতো না। সে সময় পর্যন্ত মানবদেহে সংক্রমণে সক্ষম মাত্র দুটি করোনাভাইরাস আবিষ্কৃত হয়েছিল। এই দুটিও আবার আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৯৬০–এর দশকে।'
সার্সের প্রকোপের পর সবাই নড়েচড়ে বসে। ২০০৯ সালে ইউএসএইডের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত হয় 'প্রেডিক্ট' নামের একটি সংস্থা। এর নেতৃত্বে ছিল ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশন। এর আগেই অবশ্য গঠিত হয়েছে ইকো–হেলথ অ্যালায়েন্স ও ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক কোম্পানি মেটাবায়োটা। মূল লক্ষ্য, মানুষের মধ্যে বিস্তার পাওয়ার আগেই করোনাভাইরাসের মতো বিভিন্ন রোগের জীবাণুকে শনাক্ত করে ফেলা। সংস্থাটির ১০ বছরের কার্যকালে ২০ কোটি ডলারের মতো অর্থায়ন পেয়েছে বিভিন্ন উৎস থেকে।
গত ১১ বছরে সংস্থাটি কোভিড–১৯–এর জন্য দায়ী ভাইরাসটিসহ মোট পাঁচটি করোনাভাইরাসের সন্ধান পেয়েছে, যা মানুষকে আক্রান্ত করার ক্ষমতা রাখে। ডাসজাক জানান, বাদুড়দের মধ্য থেকে ১৫ হাজারের বেশি নমুনা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মাত্র কয়েক শ ভাইরাসের পরিচয় মানুষ জানে।
ইকো–হেলথ অ্যালায়েন্স মূলত চীনের দক্ষিণ–পশ্চিমের ইউনান প্রদেশের চুনাপাথরের পাহাড়ঘেঁষা গুহাগুলোয় বেশি মনোযোগী। এসব গুহায় প্রচুর বাদুড় থাকে। পিটার ডাসজাক বলেন, 'আমরা চীনের দিকে শুরুতেই দৃষ্টি দিই। কারণ, আমরা সার্সের উৎস খুঁজছিলাম। কিন্তু পরে আমরা টের পাই যে সেখানে শত শত ভয়াবহ করোনাভাইরাস রয়েছে। তাই আমরা এগুলো শনাক্তের দিকে মনোযোগ দিই।
এ ধরনের আরেক দল প্রেডপিক্ট কাজ করে বিশ্বের ৩১টি দেশে। শুরুতে তারা মিয়ানমার ও কেনিয়ায় কাজ শুরু করে। স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশনের গ্লোবাল হেলথ প্রোগ্রামের প্রধান সুজান মুরে বলেন, 'মিয়ানমারে আমরা এখন পর্যন্ত ছয়টি নতুন ধরনের করোনাভাইরাসের সন্ধান পেয়েছি।'
মিয়ানমার ও কেনিয়ার মতো দেশগুলো সম্পর্কে স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশনের ভাইরাস নমুনা সংগ্রহ বিভাগের প্রধান ডন জিমারম্যান বলেন, 'এসব এলাকায় প্রচুর জীববৈচিত্র্য রয়েছে। আবার প্রাকৃতিক পরিবেশে মানুষের পদচারণও ক্রমে বাড়ছে। পর্যটন বেড়ে উঠছে। গবাদিপশু ও পাখির সংখ্যাও বাড়ছে। এর অর্থ হচ্ছে নতুন ধরনের ভাইরাস বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার জোর আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে অঞ্চলগুলোয়।'
এরই মধ্যে এসব অঞ্চলের কিছু মানুষ এই নতুন অণুজীবগুলো দ্বারা আক্রান্তও হয়েছে। এমন প্রমাণ পেয়েছে খোদ ইকো–হেলথ অ্যালায়েন্স। পিটার ডাসজাক জানান, ২০১৫ সালে ইউনান প্রদেশের জিনিং কাউন্টিতে পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, সেখানকার ৩ শতাংশ মানুষের শরীরে এরই মধ্যে এমন ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, যা সাধারণত বাদুড়ের দেহে থাকে। এর অর্থ হচ্ছে, ওই ভাইরাস দ্বারা এরই মধ্যে ওই ব্যক্তিরা আক্রান্ত হয়েছে। তারা নিজের অজান্তেই এতে আক্রান্ত হয়ে আবার সেরেও উঠেছে।
মানুষের দেহে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটাতে হলে তাকে মানুষের কোষের গ্রাহক (সেল রিসেপ্টর) অংশের সঙ্গে যুক্ত হতে হয়। এ জন্য মানুষের খুব কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন স্তন্যপায়ীর শরীরকে অন্তর্বর্তী পোষক (হোস্ট) হিসেবে ব্যবহার করে এরা। এই পোষক হতে পারে উট, প্যাঙ্গোলিন কিংবা অন্য কিছু। সাধারণত এ ধরনের ভাইরাসের এক বিরাট উৎস হিসেবে কাজ করে বাদুড়। মানুষের জন্য ভয়াবহ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে এমন ভাইরাসের মধ্যে মারবার্গ, নিপাহ, ইবোলা ও সার্স বাদুড় থেকেই এসেছে।
নতুন ভাইরাসের উৎস হিসেবে বাদুড়ের দিকে বিশেষ নজর দেওয়ার আলাদা কারণ রয়েছে। পিটার ডাসজাক বলেন, 'বাদুড়েরা হচ্ছে এমন স্তন্যপায়ী প্রাণী, যারা উড়তে পারে। এই ওড়ার সময় তাদের শরীরের ওপর ব্যাপক চাপ তৈরি হয়। এতে তাদের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন হয়। ওড়ার সময় বাদুড়ের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা তুলনামূলক দুর্বল থাকে। এ কারণে বিভিন্ন ভাইরাসের পক্ষে তার শরীরে প্রবেশ করাটা সহজ হয়। গুহায় বাদুড়েরা দলবদ্ধ হয়ে বাস করায় এই ভাইরাসগুলো সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সহজেই।'
অজানা ভাইরাসের সংখ্যা আদতে কত, তার একটি ধারণা পাওয়া যাবে হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের রোগ বিশেষজ্ঞ প্যাট্রিক উ–এর কথায়। সিএনএনকে তিনি বলেন, নিউমোনিয়ার জন্য দায়ী ভাইরাসগুলোর মধ্যে অর্ধেকের কম ভাইরাস সম্পর্কে এখন পর্যন্ত আমরা জানতে পেরেছি।'
এই নতুন নতুন ভাইরাসের খোঁজেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন পিটার ডাসজাকের মতো গবেষকেরা। তাঁদের মূল লক্ষ্য, মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে এমন নতুন ভাইরাসের সন্ধান পাওয়া, যাতে আগে থেকেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়। পরবর্তী সময়ে কোনো ভাইরাস যাতে মহামারির কারণ হতে না পারে, তার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবেই তাঁরা ভাইরাস–শিকারির দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। কিন্তু এত সতর্কতার পরও তাঁদের দৃষ্টি এড়িয়ে নতুন এই করোনাভাইরাসের আবির্ভাব ঘটেছে, যা সংক্রমিত করছে বিশ্বের সব প্রান্তের মানুষকে।