চমক–জাগানিয়া উদ্ভাবনের জন্য বিখ্যাত এলন মাস্ক। মাঝেমধ্যেই তিনি এমন সব উদ্ভাবনী ভাবনা নিয়ে হাজির হন, যা শুনে সাধারণের চোখ কপালে ওঠে। এবার এমনই একটি নতুন প্রকল্পের ঘোষণা দিয়েছেন এলন মাস্ক। মানুষের মস্তিষ্কের সঙ্গে যন্ত্রের সংযোগ ঘটানোর অভিযানে নেমেছে তাঁর প্রতিষ্ঠান।
মস্তিষ্ক ও যন্ত্রের সংযোগ স্থাপনের ব্যাপারে নতুন ধারণার কথা শুনিয়েছেন মাস্ক। চলতি মাসের মাঝামাঝি সর্বসমক্ষে এর বিস্তারিতও জানিয়েছেন তিনি। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মস্তিষ্ক ও যন্ত্রের মধ্যে নতুন ধরনের এ সংযোগ স্থাপনের ব্যাপারে নেতৃত্ব দিচ্ছে মাস্কের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি নিউরালিংক। যন্ত্রের সঙ্গে মস্তিষ্কের সংযোগ স্থাপনের প্রচেষ্টা অনেক দিন ধরেই করে আসছেন বিজ্ঞানীরা। কিছুটা অগ্রসরও হয়েছেন তাঁরা। যেমন পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য নিউরোসার্জনরা রোগীর মস্তিষ্কে কিছু ইলেকট্রোড স্থাপন করেন। ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের একটি দল একটি ‘ব্রেন টু ব্রেন নেটওয়ার্ক’ গড়ে তুলেছে, যার সাহায্যে কেবল নিজেদের চিন্তাকে কাজে লাগিয়েই ভিডিও গেম খেলতে পারবে মানুষ। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক কথা বলার সময় মানুষের মস্তিষ্ক থেকে স্নায়বিক সংকেত রেকর্ড করতে সক্ষম হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে ওই সংকেতকে তথ্যে রূপ দিয়ে কম্পিউটারের মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তিক বক্তব্যেও পরিণত করেছেন তাঁরা।
তবে নিউরালিংক কেবল এটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাইছে না; প্রতিষ্ঠানটির আকাঙ্ক্ষা আরও বেশি। মস্তিষ্ক ও যন্ত্রের উন্নত সংযোগ স্থাপনের পাশাপাশি একটি ‘নিউরাল লেস’ বা ‘স্নায়বিক ফিতা’ও তৈরি করতে চাইছে তারা। অত্যন্ত সরু ইলেকট্রোডের সমন্বয়ে গঠিত এই নিউরাল লেস মস্তিষ্ক থেকে আরও বেশি তথ্য জোগাড় করতে পারবে। তবে এই নিউরাল লেস স্থাপন করার প্রক্রিয়াটি এত সহজ নয়। ইলেকট্রোডগুলোকে অবশ্যই নমনীয় হতে হবে, যাতে করে মস্তিষ্কের টিস্যুর কোনো ক্ষতি না হয়। ইলেকট্রোডগুলো যেন দীর্ঘমেয়াদি হয়, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনীয় ব্যান্ডউইথ সরবরাহের জন্য অন্তত কয়েক হাজার এমন ইলেকট্রোড মস্তিষ্কে স্থাপন করতে হবে। এতগুলো ইলেকট্রোড মস্তিষ্কে বসানোর প্রক্রিয়াটিকে নিরাপদ, ব্যথাবিহীন ও কার্যকর করতে হবে। সব মিলিয়ে সে এক বিরাট কর্মযজ্ঞ!
নিউরালিংকের দাবি, এসব লক্ষ্যপূরণের পথে তারা বেশ অনেকটাই এগিয়ে গেছে। ক্যালিফোর্নিয়া একাডেমি অব সায়েন্সেসে দেওয়া এক উপস্থাপনায় তারা একধরনের নিউরোসার্জিক্যাল রোবটের প্রদর্শনী করেছে। এই নিউরোসার্জিকাল রোবট অনেকটা সেলাইযন্ত্রের মতো কাজ করবে। রোবটটি ইলেকট্রোড ভর্তি একটি বস্তু করোটির সূক্ষ্ম ফুটো দিয়ে মস্তিষ্কে প্রবেশ করাতে পারবে। এই ইলেকট্রোড ভর্তি বস্তুটি মানুষের চুলের চেয়েও সরু! এগুলোয় থাকবে ৩২টি করে ইলেকট্রোড। কোম্পানিটির দাবি, তারা এমন এক চিপের নকশা করেছে, যা একসঙ্গে ৩ হাজার ৭২টি ইলেকট্রোড থেকে পাঠানো সংকেত নিয়ে কাজ করতে পারবে। বর্তমানের সেরা প্রযুক্তির তুলনায় এই সংখ্যা ১০ গুণ বেশি।
তবে বাস্তবে এ পরীক্ষা সফল হবে কি না, তা নিয়ে কিছুটা সংশয় থেকেই যায়। মস্তিষ্কের ভেতর নিউরনগুলো সাধারণত কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে না। কিন্তু এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সফটওয়্যার কেবল নির্দিষ্ট কাজ করে, এমন নিউরনের গতিবিধি রেকর্ড করতে সক্ষম। যেমন কম্পিউটারের কি–বোর্ড দিয়ে টাইপ করার সময় কিংবা মাউস নড়াচড়া করার সময় মানুষের মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে, তা মস্তিষ্কের মোটর কর্টেক্সে নির্দিষ্টসংখ্যক ইলেকট্রোড ঢুকিয়ে রেকর্ড করা সম্ভব। এরপর ওই তথ্যকে কাজে লাগিয়ে কম্পিউটারকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। কিন্তু যেসব কাজ ঠিক পুনরাবৃত্তিমূলক নয়, সেসব ক্ষেত্রেই সমস্যা দেখা দেয়।
নিউরালিংক এরই মধ্যে ইঁদুর ও বানরের ওপর এই গবেষণার সফল প্রয়োগ ঘটিয়েছে। এবার মানুষের ওপর পরীক্ষা চালাতে চায় সংস্থাটি। এলন মাস্ক ধারণা করছেন, নিউরাল লেস তৈরি করা গেলে তা দিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে মানুষ। আর এভাবেই পৃথিবীর বুকে টিকে থাকতে পারবে মানবজাতি। তবে এসব কিছুর জন্য আগে নিউরালিংকের গবেষণা থেকে কার্যকর ফলাফল পেতে হবে। আর তার জন্য অপেক্ষা ছাড়া গত্যন্তর নেই।