ভ্যাকসিন তৈরি কত দূর এগোল?

ভ্যাকসিন তৈরিতে কাজ করছেন গবেষকেরা। ছবি: এএফপি
ভ্যাকসিন তৈরিতে কাজ করছেন গবেষকেরা। ছবি: এএফপি

করোনাভাইরাস মহামারি ঠেকাতে একটি কার্যকর ভ্যাকসিনের খোঁজ করছেন গবেষকেরা। সে ভ্যাকসিনের খোঁজে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও চীনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি ভ্যাকসিন মানবদেহে পরীক্ষাও শুরু হয়ে গেছে। গবেষকেরা আশা করছেন, চলতি বছরের মধ্যেই হয়তো কোনো ভ্যাকসিন পাওয়া যেতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ১৩টি ভ্যাকসিন মানবদেহে পরীক্ষা করা হচ্ছে এবং আরও ১২০টি ভ্যাকসিন উন্নয়নের প্রাথমিক ধাপে রয়েছে।

জৈবপ্রযুক্তি ও ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অ্যাস্ট্রাজেনেকা, মডার্নার মতো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দ্রুত উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াচ্ছে এবং চলতি বছরের মধ্যেই তাদের পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিনের লাখো ডোজ সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।

চীনের ছয়টি ভ্যাকসিন নিয়ে মানবদেহে পরীক্ষা চালানো হচ্ছে। অন্যদিকে, জার্মান কোম্পানি কিউরভ্যাক বলছে, তাদের তৈরি ভ্যাকসিনের প্রথম ফলাফল এ বছরের সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে জানা যেতে পারে।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান বৈজ্ঞানিক সৌম্য স্বামীনাথান বলেছেন, তিনি এ বছরের মধ্যেই লাখো ভ্যাকসিন ডোজ আশা করছেন এবং আগামী বছরের মধ্যেই ২০০ কোটি ডোজ পাওয়ার আশা করছেন। তিনি আরও বলেছেন, ‘এ মুহূর্তে আমাদের হাতে কোনো প্রমাণিত ভ্যাকসিন নেই। কিন্তু আমাদের ভাগ্য ভালো হলে এ বছর শেষ হওয়ার আগেই এক বা দুটি সফল ভ্যাকসিন আমাদের হাতে থাকবে এবং আগামী বছর নাগাদ ২০০ কোটি ডোজ পাওয়া যাবে।’

যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মডার্নার তৈরি দুটি ভ্যাকিসন এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আলোচনায় রয়েছে। অন্যদিকে, বিশ্বের বৃহত্তম ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী হিসেবে পরিচিত গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন (জিএসকে) গত শুক্রবার তাদের ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা পর্যায়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, ভ্যাকসিন পরীক্ষার তৃতীয় ধাপে রয়েছে অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও মডার্না।

গ্লাক্সোস্মিথক্লাইনের ভ্যাকসিন প্রকল্পের প্রধান মেডিকেল কর্মকর্তা থমাস ব্রুয়েরার বলেছেন, তাঁরা ধীর ও টেকসই পদ্ধতি নিয়ে এগোবেন। প্রতিষ্ঠিত প্রযুক্তি ধরে এগোলেই তাঁরা সর্বোচ্চ জায়গায় পৌঁছাতে পারবেন। তাঁরা এখন অ্যাডজুভান্ট তৈরি করছেন, যা মূলত বুস্টার হিসেবে প্রচলিত ভ্যাকসিনের সঙ্গে কাজ করে। তিনি মনে করেন, অ্যাডজুভান্ট বয়স্কদের ক্ষেত্রে প্রতিরোধী ক্ষমতা বাড়াতে বেশি কার্যকর হবে। আগামী বছর ১০০ কোটি ডোজ বুস্টার তৈরি করবেন তাঁরা। তাঁরা চীনা জৈবপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ক্লোভার বায়োফার্মাসিউটিক্যালস, শিয়ামেন ইনোভ্যাক্স অ্যান্ড চংকুয়িন জেইফি ও অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও সানোফিকে এ অ্যাডজুভান্ট সরবরাহ করবে।

ক্লোভার জানিয়েছে, তাদের কোভিড-১৯ এস-ট্রিমার সাব-ইউনিট ভ্যাকসিন প্রথম ধাপে মানবপরীক্ষায় শুরু হয়েছে। তারা চীনের ষষ্ঠ ভ্যাকসিন নির্মাতা হিসেবে মানবপরীক্ষার ধাপে পৌঁছেছে।

রয়টার্স জানিয়েছে, ১৫০ জন প্রাপ্তবয়স্ক রোগীর মধ্যে তাদের ভ্যাকসিন পরীক্ষা করা হচ্ছে, যাতে জিএসকের বুস্টারের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের ডায়নাভ্যাক্সের বুস্টারের সঙ্গে তাদের ভ্যাকসিন পরীক্ষা করা হবে। অস্ট্রেলিয়ার পার্থে লিনেয়ার ক্লিনিক্যাল রিসার্চে এ গবেষণা চালানো হচ্ছে। আগস্টে এর ফল পাওয়া যাবে। এ বছরের শেষ নাগাদ এ নিয়ে পরের ধাপের পরীক্ষা চালানো হবে। এটি মূলত প্রোটিনভিত্তিক অ্যান্টিজেন পরীক্ষা, যা অ্যাডজুভান্টের সঙ্গে শরীরে প্রয়োগ করা হয়।

চায়না ডেইলি ডটকমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটির ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল বায়োলজির একটি কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন চীনে মানবপরীক্ষার দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশ করেছে। চায়নিজ একাডেমি অব মেডিকেল সায়েন্সের অধীনে থাকা ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল বায়োলজির গবেষকেরা এর আগে পোলিও এবং হেপাটাইটিস এ-র জন্য ভ্যাকসিন তৈরি করেছেন। তাঁরা কোভিড-১৯-এর জন্য একটি নিষ্ক্রিয় ভাইরাসের ভ্যাকসিনের প্রথম পর্বের পরীক্ষা চালিয়ে সফল হওয়ার দাবি করেছেন।

ভ্যাকসিনটির দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষায় মানবদেহে এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিরূপণ ও নিরাপত্তার বিষয়টি পর্যালোচনা করা হবে। এটি চীনের দক্ষিণ-পূর্ব ইউনান প্রদেশে পরীক্ষা করা হচ্ছে। গত মে মাসে ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল বায়োলজির গবেষকেরা ভ্যাকসিনের প্রথম ধাপের পরীক্ষা শুরু করেন। সিচুয়ান প্রদেশের ওয়েস্ট চায়না সেকেন্ড ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে ১৮ থেকে ৫৯ বছর বয়সী ২০০ স্বেচ্ছাসেবী ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছিলেন। এই ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে ইউনান প্রদেশের কুনমিংয়ে ভ্যাকসিন উৎপাদন কারখানা স্থাপন করা হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে। চলতি বছরের শেষ দিকে এ কারখানা থেকে ভ্যাকসিন উৎপাদন শুরু করবে তারা।

ইসরায়েল ইনস্টিটিউট ফর বায়োলজিক্যাল রিসার্চ সেন্টার দাবি করেছে, তারা ইঁদুরের ওপর করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনের সফল পরীক্ষা করেছে। টাইমস অব ইসরায়েলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছরের শেষ নাগাদ বা তার আগেই ভ্যাকসিন তৈরির চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যাওয়ার আশা করছেন গবেষকেরা।

যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকেরা দাবি করেছেন, মিসেলস, মাম্পস ও রুবেলা (এমএমআর) ভ্যাকসিন কোভিড-১৯–এর ক্ষেত্রে বাড়তি সুরক্ষা দিতে পারে। এ নিয়ে আরও ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার দাবি করছেন তাঁরা। ‘এমবায়ো’ সাময়িকীতে প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধে গবেষকেরা দাবি করেছেন, কোভিড-১৯ সংক্রমণে প্রদাহ কমাতে পারে এমএমআর ভ্যাকসিন।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন ছাড়াও ভ্যাকসিন তৈরির পথে রয়েছে জাপান। দেশটির জৈবপ্রযুক্তি উদ্যোগ অ্যানজিসের নেতৃত্বে গবেষকদের একটি দল আগামী বছরের মার্চ মাসের মধ্যে করোনার ভ্যাকসিনের ১০ লাখ ডোজ উৎপাদন ক্ষমতা প্রস্তুত করবে। দেশটির জনগণকে দ্রুত ভ্যাকসিন–সুবিধা নিশ্চিত করতে প্রকৃত পরিকল্পনার চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলেছে প্রতিষ্ঠানটি।

জাপানের নিক্কেই এশিয়ান রিভিউয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ও বিশ্বের আরও কয়েকটি কোম্পানি কয়েক শ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন উৎপাদনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু এ ভ্যাকসিন জাপান আমদানি করতে পারবে কি না, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই দেশটির সরকার করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় তরঙ্গ সামাল দিতে ভ্যাকসিনের সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। জাপানের ভ্যাকসিনটি এখনো উন্নয়ন পর্যায়ে রয়েছে।

নিউইয়র্ক টাইমস ভ‌্যাকসিনের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে তৈরি ভ্যাকসিন ট্র্যাকার অনুযায়ী নতুন করে মস্কোর গামেলা রিসার্চ ইনস্টিটিউট ও জার্মানির কিউরভ্যাক প্রথম ধাপের পরীক্ষা শুরু করেছে।