ইতিহাসের পরতে পরতে নিজের অমরত্বের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে কালজয়ী সব প্রেমের গল্প। যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভালোবাসার গঠন আর বহিঃপ্রকাশের মতোই ধরন পাল্টেছে ভালোবাসার স্মৃতি সংরক্ষণের। স্মার্টফোনের এই যুগে সুখকর মুহূর্তের ছবিগুলো মনের আগে ধরা পড়ে ফোনের ক্যামেরায়। দীর্ঘ সম্পর্কের সেসব ছবি অনেকেই ফ্রেমবন্দী করে ঘরে সাজিয়ে রাখেন। কেউ বা ভিডিওগ্রাফির আবহে স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমাই বানিয়ে ফেলেন।
তবে নাবিল ঈসার ভাগ্যে কোনোটাই জুটবে না এমন শঙ্কার উদয় হয়েছিল। শিক্ষার্থী হিসেবে অস্ট্রেলিয়ায় পড়ার সময় আনিকা চৌধুরীকে জীবনসঙ্গী হওয়ার প্রস্তাব দেন তিনি। ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ সেই নর–নারী বিদেশবিভুঁইয়ে জীবনের বাকি জীবন একসঙ্গে কাটানোর স্বপ্ন বোনেন। আর বিপত্তিটা ঘটে ওখান থেকেই। জীবনের অন্যতম সুখের মুহূর্তের সেই ক্যামেরাবন্দী সব স্মৃতি হারিয়ে ফেলেন নাবিল। এ নিয়ে মনোমালিন্যও হয় দুজনার। সময় পেরিয়ে একদিন চলে আসে তাঁদের শুভ লগনের দিন। আনিকা হয়তো ততদিনে ভুলেও গেছেন সে কথা। তবে ভোলেননি নাবিল। ক্ষণে ক্ষণে ভেবেছেন, সারা জীবন আগলে রাখার প্রতিশ্রুতি যাঁকে দিয়েছেন, তাঁর হারিয়ে ফেলা স্মৃতি যেমন করেই হোক ফিরিয়ে দিতে হবে।
সেসব ভাবনা থেকেই বাংলাদেশের একদল তরুণের সঙ্গে যোগাযোগ করেন নাবিল। নিজেদের ভালোবাসার গল্পের আদলে তৈরি করতে বলেন অ্যানিমেশন ছবি। আনিকাকে চমকে দিয়ে নিজেদের ভালোবাসার সেই গল্পের অ্যানিমেশন দেখান বিয়ের দিন। সবাই তো অভিভূত। সেই সঙ্গে অবাক হয়েছেন, বাংলাদেশেই এমন মানসম্মত অ্যানিমেশন তৈরি করা যায় ভেবে।
আশার চেয়ে বেশি কিছু পাওয়া
বিয়ের দিন শুধু নিজেদের ভালোবাসার একটা ছোট্ট গল্প তুলে ধরতে চেয়েছিলেন নাবিল ঈসা। তবে এত সুন্দর অ্যানিমেশন হবে আশা করেননি। বললেন, ‘অস্ট্রেলিয়ায় আমি আনিকাকে বিয়ের প্রস্তাব দিই একটি সমুদ্রের পারে। সে সময়ের তোলা প্রায় সব ছবিই হারিয়ে গিয়েছিল। আমি চেয়েছিলাম আমাদের গল্পটাই বিয়ের দিন উপহার দেব তাঁকে। অ্যানিমেশন দেখে আনিকা খুব খুশি হয়েছিল।’
শুধু অবাক হয়েছেন
‘ও (নাবিল) এমন কিছু করবে আমি সেটা টেরই পাইনি। বিয়ের দিন যখন পর্দায় আমাদেরকেই অ্যানিমেশন আকারে দেখতে পেলাম, আমি শুধু হা করে তাকিয়ে ছিলাম। আমি সত্যিই শুধু অবাক হয়েছি।’ আবেগ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলছিলেন আনিকা চৌধুরী।
গল্প শুনে শুনে
‘অ্যানিমেশন তৈরির প্রতিষ্ঠান পিক্সেলা স্টুডিওজ শুরু করে অনেক দিন অপেক্ষায় ছিলাম। বাণিজ্যিক অনেক কাজই করছিলাম। শুরু থেকেই চাইছিলাম ভিন্ন ধাঁচের একটা স্বল্পদৈর্ঘ্য অ্যানিমেশন বানাতে। তবে কোনো কিছুই মনেরমতো হচ্ছিল না আমাদের। এমন সময়ই নাবিল ঈসা এসে জানালেন তাঁর গল্পের একটা অ্যানিমেশন রূপ দিয়ে দিতে।’ নাবিল ও আনিকার ভালোবাসার গল্পের অ্যানিমেশন নির্মাতা পিক্সেলা স্টুডিওর অ্যানিমেটর দলের প্রধান মিজানুর রহমান বলছিলেন কথাগুলো। জানালেন অ্যানিমেশনটি বানানোর শুরু থেকে শেষের কথা।
‘নাবিল আমাদের বললেন, তিনি একটা গল্পের অ্যানিমেশন বানাতে চান। উনি পুরো গল্পটা বললেন আমাদের। আর আমাদের কাছে মনে হলো দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আমাদের মনেরমতো একটা কাজ পেয়েছি। এরপর প্রায় এক মাস দিনরাত এক করে দশজনের একটি দক্ষ দল কাজ করেছি অ্যানিমেশনটি তৈরি করতে।’
বাংলাদেশে অ্যানিমেশনের ধারণা বদলাচ্ছে
দেশে অ্যানিমেশনের শিল্পটা একদমই নতুন। এখনো হাতে গোনা মাত্র কয়েকটা মানসম্মত অ্যানিমেশনের দেখা মেলে। তবে এই শিল্পের বিকাশ ঘটছে বলে জানালেন মিজানুর রহমান। বললেন, ‘আমাদের দেশেই এখন ভালো ভালো অ্যানিমেশন তৈরি হচ্ছে। তবে এর জন্য দক্ষতার আরও প্রয়োজন রয়েছে। এ ছাড়া অ্যানিমেশনের বাজার বাড়ানোতে সবার একাগ্র সহযোগিতারও প্রয়োজন রয়েছে। প্রয়োজন সঠিক দিকনির্দেশনারও। আমরা সৌভাগ্যক্রমে সেটা পেয়েছি মোহাম্মদ আবদুল মতিনের কাছ থেকে। তাঁর দেখানো পথেই ভালো মানের কাজ করার অনুপ্রেরণা নিয়ে এগিয়ে চলেছি।’
অ্যানিমেশন নিয়ে আমাদের দেশে অনেকেরই অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। এর পেছনে দেওয়া শ্রম ও অর্থেরও যথেষ্ট মূল্যায়ন করেন না অনেকেই। এর কারণ জানতে চাইলে মিজানুর রহমান বলেন, ‘দেশের অ্যানিমেশন যাঁরা তৈরি করেন, তাঁদের অনেকের মধ্যে প্রচুর কাজ নিয়ে শুধু সাময়িক অর্থলাভের দিকটাই ভেবে থাকেন। ফলে কাজ হচ্ছে বটে, তবে সেটা মানসম্মত নয়। এতে গ্রাহকের মনে অ্যানিমেশন নিয়েই একটা নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হয়। নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের চেয়ে দেশের একটা সম্ভাবনাময় বাজার তৈরিতে সবার যোগদান এখন সবচেয়ে বেশি দরকারের।’