অনেকেই টুক করে ঘুমিয়ে পড়েন, আবার অনেকেই এপাশ-ওপাশ করে ঘুমাতে পারেন না। যাঁদের ঘুম হয় না, তাঁদের কত আয়োজন আর হিসাব-নিকাশ করতে হয়! সেখানে সিলিকন ভ্যালির প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের তো সবকিছুতেই হিসাব-নিকাশ। ঘুমের ক্ষেত্রেও কি ব্যতিক্রম হবে?
স্টার্টআপ বা প্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তা ব্রায়ান জনসনের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই? নিজের তৈরি একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ৮০ কোটি মার্কিন ডলারে ইবের কাছে বিক্রি করে ইতিমধ্যেই আলোচনায় এসেছেন তিনি। বর্তমানে ‘কার্নেল’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব আছেন। ব্রেইন কম্পিউটার ইন্টারফেস নিয়ে কাজ করে তাঁর প্রতিষ্ঠান। তাঁর ‘ঘুমের স্বাস্থ্যবিধির’ রুটিনটাই দেখুন।
সম্প্রতি এক ব্লগ পোস্টে ব্রায়ান লিখেছেন, আগে শোয়ার ঘরের জানালা বন্ধ করে দেন তিনি। বিকেল চারটার মধ্যে খাওয়া শেষ করেন। সন্ধ্যা ছয়টার পর সামান্য পানিও খাওয়াও বন্ধ। আটটার মধ্যে নীল আলো ঠেকানোর চশমা পরে নেন। শোয়ার ঘরের তাপমাত্রা ১৯ দশমিক ৪ ডিগ্রিতে রেখে ইলেকট্রিক চাদরের তাপমাত্রা ২১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে রাখেন। ৮টা ৪৫ মিনিটে ৫ থেকে ১০ মিনিটের ধ্যান বা মেডিটেশন। এরপর ডিপ ওয়েভ সাউন্ড মেশিন চালু করেন। আঙুলে ঘুম ট্র্যাক করার জন্য ‘অরা’ আংটি পরে নেন। এভাবেই ঘুমের জন্য পূর্বপ্রস্তুতি সারেন তিনি।
ঘুমের জন্য এত আয়োজন কেন ব্রায়ানের? ব্রায়ান স্বীকার করেন, ঘুমানোর অদ্ভুত অভ্যাসের ফলে তাঁর সামাজিক জীবন শেষ হয়েছে। তাঁর সঙ্গী পৃথক ঘরে ঘুমান। কিন্তু কষ্ট করে ঘুমের আয়োজনের সুফল তিনি পাচ্ছেন। তাঁর গভীর ঘুম বা ‘ডিপ স্লিপ’ ১৫৭ শতাংশ বেড়ে গেছে। এখন তাই তাঁর প্রতিষ্ঠানের সব কর্মীর জন্য অরা আংটি কিনেছেন তিনি। এই অরা আংটি হচ্ছে ফিনল্যান্ডের একটি প্রতিষ্ঠানের তৈরি বিশেষ হাইটেক আংটি, যা ঘুম পর্যবেক্ষণ করতে পারে।
ব্রায়ানের ঘুমানোর অদ্ভুত নিয়ম সবার জন্য পালনীয় নয়, সে কথা ব্রায়ান নিজেও জানেন। তবে ঘুমানোর স্বাস্থ্যকর অভ্যাস বিষয়ে পরামর্শ ও উৎসাহ দিতে তিনি বিষয়টি সবার সামনে এনেছেন। প্রযুক্তি দুনিয়ার অনেকের মতো তিনিও মানেন, ঘুমানোর স্বাস্থ্যবিধি মানলে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে। শেখার ক্ষেত্রে একাগ্রতা জন্মায় এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ে।
সম্প্রতি অরা আংটির উদ্যোক্তার পেছনে বিনিয়োগকারীর লাইন লেগেছে। বিনিয়োগকারী হিসেবে যুক্ত হয়েছেন ইউটিউব ও টুইচের সহপ্রতিষ্ঠাতা, ফেসবুক, স্কাইপ ও বক্স ডটকমের সাবেক অনেকেই। তাদের উৎসাহের কারণ, এ আংটি ব্যবহারকারীদের একজন টুইটার সহপ্রতিষ্ঠাতা জ্যাক ডরসি। টুইটারের সহপ্রতিষ্ঠাতা সুস্থ থাকার জন্য ‘অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ড’ করার ব্যাপারে ইতিমধ্যে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। তিনি সুস্থ থাকতে নিয়ার ইনফ্রারেড সোনার, তেজস্ক্রিয়তা প্রতিরোধক ফ্যারাডে তাঁবু, দীর্ঘ সময় উপবাস এবং ক্রিপটোথেরাপির মতো নানা পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। নিউইয়র্ক টাইমস তাঁকে ‘সিলিকন ভ্যালির গিনেথ প্যালট্রো’ হিসেবে অভিহিত করেছে।
ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রযুক্তি বিশ্বে ফিট বা সুস্থ থাকার নতুন উপায় ‘পর্যাপ্ত ঘুম’ বিষয়টি নিয়ে ট্রেন্ড চলছে। ঘুম পর্যবেক্ষণ ও এ–সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের জন্য বাজারে এখন প্রচুর গ্যাজেটস পাওয়া যাচ্ছে। ইলেকট্রিক চাদর, ম্যাট্রেস, সাউন্ড মেশিন, স্মার্ট রিং, স্মার্ট বালিশ, ঘুম পর্যবেক্ষণের ঘড়ি, ব্রেসলেট, বুদ্ধিমান ঘুমানোর মাস্ক, মস্তিষ্ক উদ্দীপক হেডব্যান্ড, স্লিপ সেন্সর ও অসংখ্য ঘুম পর্যবেক্ষণের অ্যাপ এখন হাতের মুঠোয়। বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান পারসিসটেন্সের তথ্য অনুযায়ী, ঘুম পর্যবেক্ষণ ও ভালো ঘুমের জন্য ব্যবহৃত প্রযুক্তির বাজার ২০১৪ সালে ছিল ৫ হাজার ৮০০ কোটি মার্কিন ডলারের। ২০২০ সাল নাগাদ তা বেড়ে দাঁড়াবে ৮ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলারে। এ খাতের বড় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে অ্যাপল, বোস, নকিয়া ও ফিলিপাইন। জ্যাক ডরসির মতো প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের কারণে এ ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার আরও বাড়ছে।
ঘুমসংক্রান্ত প্রযুক্তির পেছনে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর ছুটে চলার কারণ হচ্ছে বর্তমান চল বা ট্রেন্ড। সিলিকন ভ্যালির প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের ওরকস (অবজেকটিভস অ্যান্ড কি রেজাল্টস), কেপিআই (কি পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটর) ও ডিজিটাল অ্যানালাইটিকস ড্যাশবোর্ড ব্যবহারে আসক্তই বলা চলে। এতে কোনো পণ্য বা ফিচারের নির্দিষ্ট পারফরম্যান্স জানতে পারেন তাঁরা। ঘুমের ক্ষেত্রে বা জীবনযাপনের অন্যান্য ক্ষেত্রে একই পদ্ধতি তাঁরা প্রয়োগ করেন। যৌক্তিক এ পদ্ধতি সিলিকন ভ্যালিতে ‘কোয়ান্টিফাইড সেলফ’ পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত।
সিলিকন ভ্যালির উদ্যোক্তারা উৎপাদনশীলতাকে গুরুত্ব দেন। স্লিপ ট্র্যাকিং বা ঘুম পর্যবেক্ষণের বিষয়টি তাই তাঁদের সঙ্গে মানিয়ে যায়। উদ্যোক্তারা নিজেদের আরও বেশি কর্মক্ষম, কার্যকর ওই সফল দেখতে চান। এ কারণে তাঁরা নানা উপায় নিয়ে কাজ করেন। পোশাক পরতে সময় নষ্ট হবে ভেবে তারা একই পোশাক প্রতিদিন পরেন। অ্যাপলের সহপ্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবসের মতো পোশাক পরার ধরন, জটিল ডায়েট ও না খেয়ে সুস্থ থাকার রুটিন মানার চেষ্টা করেন। এখানেই স্লিপ ট্র্যাকিং ডিভাইসের চাহিদা বাড়ছে। এ ধরনের ডিভাইস থেকে প্রত্যক্ষ উন্নতির বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পান তাঁরা। অরা বিষয়টি তাদের ব্র্যান্ডিংয়ে কাজে লাগিয়েছে। তারা ডিভাইসটিকে বলছে ‘ব্যক্তিগত উন্নতির গোপন অস্ত্র’।
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল ও ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের গবেষকেরা ২০১৫ সালে একটি গবেষণা করেন। তাতে দেখা যায়, ঘুম পর্যবেক্ষণের ডিভাইসগুলো প্রকৃত ঘুমের তথ্য নিখুঁতভাবে দিতে পারে না। বিষয়টি এ ধরনের ডিভাইসের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৭ সালের শিকাগোর গবেষকেরা ‘অর্থোসোমনিয়া’ নামের একটি বিশেষ রোগ সম্পর্কে সতর্ক করেন। এটি মূলত ‘পারফেকশনিস্টদের’ দিনের সময় সঠিকভাবে কাজে লাগাতে সঠিক ঘুমের খোঁজ করা নিয়ে উদ্বেগের বিষয়। অনেকেই ভালো ঘুমাতে পারছেন না বলে প্রতিপক্ষের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছেন এমন উদ্বেগে ভুগতে থাকেন।
প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের মধ্যে ধারণা—কাজে সফলতাই আগে, জীবনের অন্য কিছু এর পরে। এ খাতের উদ্যোক্তাদের দীর্ঘ সময় কাজ করতে হয় বলে তাঁরা ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না। এ ধরনের সমস্যাগুলো থেকে মুক্তি হিসেবে অনেকেই ঘুম পর্যবেক্ষণের প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকে পড়ছেন।
এক দশক আগে ‘ফিটনেস ট্র্যাকিং’ প্রযুক্তি যে জায়গায় ছিল, এখন সেখানে ‘স্লিপ ট্র্যাকিং’ প্রযুক্তি এসে দাঁড়িয়েছে। এখন অ্যাপল ওয়াচের মতো ফিটনেস ট্র্যাকার ডিভাইস মূলধারার পণ্য হিসেবে বাজারে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। কতটুকু হাঁটলেন বা দৌড়ালেন, ফেসবুকে সে তথ্য দিলে মানুষ আর ভ্রু কুঁচকে দেখে না। একই ঘটনা ঘটতে পারে ঘুমপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে। এখন যেমন ই–মেইল, অনলাইন শপিং, অ্যাপ দিয়ে গাড়ি ভাড়ার মতো বিষয়গুলো সহজ হয়ে গেছে, ঘুমানোর প্রযুক্তিগুলোর ক্ষেত্রেও ভবিষ্যতে তা–ই হয়তো ঘটতে দেখা যাবে।