বিনিয়োগকারীর মুখোমুখি হওয়ার আগে ৫ বিষয়

নতুন স্টার্টআপ তৈরির ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগোতে হবে। ছবি: পিক্সমামা
নতুন স্টার্টআপ তৈরির ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগোতে হবে। ছবি: পিক্সমামা

দেশের তরুণ উদ্যোক্তারা নতুন ধারণা, পণ্য ও সেবা তৈরির মাধ্যমে স্টার্টআপ বা উদ্যোগ গড়ে তুলছেন। তাঁদের সে স্টার্টআপ বা উদ্যোগকে সামনে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন বিনিয়োগ। কিন্তু বিনিয়োগ চাইলেই তো পাওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য নিজের ব্যবসাকে বিনিয়োগকারীর সামনে যথাযথভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন।

এ ক্ষেত্রে নিজের ব্যবসা সম্পর্কে যেমন স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে, তেমনি আয়-ব্যয়, লাভ-ক্ষতির মতো সাধারণ বিষয়গুলো উদ্যোক্তার নখদর্পণে থাকতে হবে। রবির আর-ভেঞ্চারসের মতো প্ল্যাটফর্মে নিজের ধারণা স্পষ্টভাবে তুলে ধরে বিনিয়োগ পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে শুধু নিজের ব্যবসার ধারণা উপস্থাপন করলেই বিনিয়োগ পাওয়া যায় না। বিনিয়োগকারীর সামনে নিজের উদ্যোগ তুলে ধরার কোনা সুযোগ পেলে স্বল্প সময়েই গুছিয়ে তা তুলে ধরতে হয়। বিনিয়োগকারীর প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে হয়। সাধারণত বিনিয়োগকারী ব্যবসার নানা বিষয়ে প্রশ্ন করে প্রকৃত অবস্থা জানার চেষ্টা করেন। যথাযথ উত্তর দিয়ে বিনিয়োগকারীকে সন্তুষ্ট করতে পারলে মিলতে পারে ব্যবসার মূলধন। পিচিং প্ল্যাটফর্মে যেসব প্রশ্ন করা হয় সেগুলোর উত্তর শুনে বিনিয়োগকারী বা ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টরা বিনিয়োগের বিষয়ে তড়িৎ সিদ্ধান্ত নেন। তবে প্রশ্নের উত্তর ঠিকমতো না দিতে পারলে বিনিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা হতাশ হতে পারেন। পিচিং করার আগে ৫ টি বিষয় সম্পর্কে অবশ্যই ধারণা থাকতে হবে:

১. ব্যবসার মডেল, দাম ও রাজস্ব: কেউ লোকসান করার জন্য ব্যবসায় নামেন না। বিনিয়োগকারী তাঁর বিনিয়োগ করা অর্থ কাজে লাগিয়ে ব্যবসা বাড়ানোর সম্ভাবনা দেখবেন। তাই তিনি জানতে চাইবেন ব্যবসার মডেল কী হবে? কী উপায়ে বিনিয়োগ করা অর্থ উঠে আসবে। কোনো উদ্যোক্তা যখন বিনিয়োগকারীর সামনে তাঁর ব্যবসা সম্পর্কে বলবেন, তখন ব্যবসার মডেল সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেতে চাইবেন বিনিয়োগকারী। ব্যবসার ক্ষেত্রে সরাসরি গ্রাহকের কাছে পণ্য বা সেবা যাবে (বিটুসি) নাকি বা ব্যবসায়ী থেকে ব্যবসায়ী (বিটুবি) নাকি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে, তা জানতে চাইবেন বিনিয়োগকারী। সাবস্ক্রিপশন মডেল, চুক্তি, গ্রাহক সম্পর্কিত নানা প্রশ্ন করে ব্যবসার পুরো বিষয়ে সন্তুষ্ট হলেই বিনিয়োগ পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। উদ্যোক্তা যে পণ্য ও সেবা তৈরিতে কাজ করছেন, তার মূল্য জানতে চান বিনিয়োগকারী। সেখান থেকে আসা রাজস্ব, ট্র্যাকশন, প্রবৃদ্ধি, অগ্রগতির তথ্য শুনতে চাইবেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ আয় কীভাবে বাড়ানো হবে এবং কয়েক বছর ধরে এ আয় কোন দিকে যাবে, এমন হিসাবও বিনিয়োগকারীর কাছে তুলে ধরতে হতে পারে। উদ্যোগে রেভিনিউ মডেল, সেখান থেকে খরচ, উদ্যোক্তার লাভ-ক্ষতি বিষয়ে প্রশ্ন আসবেই। এ বিষয়ে আরও জানতে পারেন 

২. গ্রাহক তথ্য ও বাজার সম্ভাবনা: বিনিয়োগকারীদের মনে তথ্য ও গ্রাহক বাড়ানোর বিষয়টি সব সময় থাকে। একেকটি মাইলস্টোন সম্পর্কে প্রশ্ন আসতে পারে। হয়তো প্রশ্ন হতে পারে, ১০ লাখ সাবসক্রিপশন হতে কত দিন লাগবে? আপনার ব্যবসা টেকসই করতে কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন। হঠাৎ লোকসান হলে কীভাবে তা সামাল দেবেন? উদ্যোগে রেগুলেটরি বা সরকারি কোনো বাধা আছে কি না, বাধাগুলো কীভাবে দূর হবে? এ ছাড়া অন্যের সঙ্গে সহযোগিতা বা অংশীদারত্ব চুক্তি, তথ্য সংগ্রহ ও ব্যবহারের পরিকল্পনা বিষয়ক প্রশ্ন তুলবেন বিনিয়োগকারী। যে উদ্যোগ নিয়ে বিনিয়োগকারীর সামনে ধারণা উপস্থাপন করছেন তা কতখানি অনন্য, বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করেন বিনিয়োগকারী। বাজারে যদি একই ধরনের পণ্য, সেবা বা উদ্যোগ থেকে থাকে, তবে তার চেয়ে কতটা ভালো তা-ও বোঝার চেষ্টা করতে নানা প্রশ্ন করা হতে পারে। প্রশ্ন হতে পারে, বাজারে কতটা টেকসই আপনার উদ্যোগ? বিনিয়োগ না পেলে কীভাবে বাজারে টিকবেন? প্রতিদ্বন্দ্বীদের সম্পর্কে কতটা ধারণা আছে? বাজারে টিকে যাওয়ার সম্ভাবনা ও গ্রাহকবান্ধব উদ্যোগ হলে বিনিয়োগকারী সন্তুষ্ট হন। তখন এ বিষয়ে আরও খুঁটিনাটি প্রশ্ন করেন। অধিকাংশ বিনিয়োগকারী যেসব উদ্যোগ সামনে বড় ব্যবসা হিসেবে দাঁড়াবে এবং অর্থপূর্ণ হবে, তার পেছনে ছোটেন। আপনার ব্যবসাকে সেই সম্ভাব্য ব্যবসা হিসেবে তাঁদের সামনে তুলে ধরাটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই যে সমস্যার সমাধান হিসেবে উদ্যোগ দাঁড় করিয়েছেন সেখানে সম্ভাবনাকে বড় করে দেখাতে ভুলবেন না। যদি প্রথম পণ্য বা সেবাটি ছোট আকারে দেখাতে হয়, তবে সেখান থেকে ভবিষ্যতে আর যেসব ব্যবসা বা পণ্য বেরিয়ে আসবে সে বিষয়গুলোতে ধারণা রাখুন। বিনিয়োগকারী প্রকৃত বাজারের আকার ও সেই বাজারের কতটুকু দখল করতে চান, তা জানতে চাইবেন। বিষয়টি দেখতে পারেন 

কয়েকজনের একটি দক্ষ টিম তৈরি করে স্টার্টআপ তৈরি করলে সফলতা আসতে পারে। ছবি: পিক্সমামা

৩. লক্ষ্য কী, কত টাকা চান: যাঁরা স্টার্টআপ তৈরি করে বিনিয়োগকারীর মুখোমুখি হন, তাঁদের সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্নটি করা হয় তা হচ্ছে—আপনার লক্ষ্য কী? পরবর্তী ছয় মাসে আপনার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কী? বিনিয়োগ পেলে আপনি কী করবেন? কত টাকা বিনিয়োগ আপনার প্রয়োজন হবে। সে বিনিয়োগের টাকা সবার আগে কীভাবে খরচ করবেন? অর্থাৎ, বিনিয়োগকারী উদ্যোক্তার কাছে সবার আগে নিজের ব্যবসার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেতে চান। উদ্যোক্তা যদি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ধরে ব্যবসা করেন এবং প্রবৃদ্ধি অর্জনের সম্ভাবনা থাকে, তবে বিনিয়োগকারী সন্তুষ্ট হন। বেড়ে যায় বিনিয়োগ পাওয়ার সম্ভাবনা। তাই এ বিষয়ে উদ্যোক্তার ধারণা থাকতে হবে। বাংলাদেশে স্টার্টআপগুলোর কাছে শুরুতেই কত টাকার প্রকল্প সে সম্পর্কে বিনিয়োগকারীরা একটা অলিখিত মূল্যায়ন করেন। এরপর উদ্যোক্তার কাছে জানতে চান, তাঁর উদ্যোগ সফল করতে বা সামনে এগিয়ে নিতে কত টাকা প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রে সময় নির্ধারণ করে বলেন, আগামী ৫ বছরে কত টাকা হলে ব্যবসা কত দূর নিতে পারবেন। এসব ক্ষেত্রে যৌক্তিক উত্তর দেওয়াটা আবশ্যক। আকাশকুসুম কল্পনার চাইতে বাস্তবসম্মত ধারণা ও বিনিয়োগ চাইলে বিনিয়োগকারী আগ্রহ দেখান। এ বিষয়ে জানতে 

৪. ঝুঁকি, চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণ: ব্যবসা করতে হলে ঝুঁকি নিতেই হবে। বিনিয়োগকারীও তাই ঝুঁকির বিষয়টি আগেভাগেই জেনে নিতে চান। ব্যবসার কোন ক্ষেত্রে কী ধরনের ঝুঁকি আছে, তা উদ্যোক্তাকে আগে থেকেই জেনে রাখতে হবে। বিনিয়োগকারী জানতে চাইলে ঝুঁকির বিষয়গুলো তুলে ধরে তা থেকে বের হওয়ার উপায়গুলো জানাতে হবে। বিনিয়োগকারী ব্যবসার মূল সমস্যা, আইনগত জটিলতা, প্রযুক্তিগত ঝুঁকি, মানসম্মত পণ্যের দায়বদ্ধতার মতো বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারেন। বিনিয়োগকারীর সামনে ধারণা উপস্থাপন করতে গেলে সবচেয়ে পরিচিত যে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় তা হচ্ছে, আপনার চ্যালেঞ্জ কোথায়? আপনার সক্ষমতার সঙ্গে যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা দূর করতে আপনি কী কী করতে পারবেন? অর্থাৎ, ব্যবসা বা উদ্যোগে আপনার আত্মনিয়োগ বা ডেডিকেশন দেখতে চান বিনিয়োগকারী। যদি, আপনার উদ্যোগ আপনার আবেগের জায়গা হয় এবং ব্যবসার জন্য সবকিছু করতে পারেন, তবে চ্যালেঞ্জ যেমন উতরে যাবেন তেমনি বিনিয়োগকারীর মনও জয় করে ফেলবেন। আপনার দূরদৃষ্টিও দেখতে চান বিনিয়োগকারী। প্রশ্ন করে বসতে পারেন, আপনাকে টাকা দেওয়া হলে ব্যবসা কত দূর পর্যন্ত বাড়াবেন? আরও জানুন 

৫. নিজেকে মূল্যায়ন ও ব্যবসার টিম: বিনিয়োগকারী উদ্যোক্তাকে পুরোপুরি বাতিল করে দেওয়ার আগে একটি লাইফলাইন দিতে পারেন। সেখানে উদ্যোক্তাকে তিনি ও তাঁর উদ্যোগ কেন সেরা, তা বলার সুযোগ দিতে পারেন। এ সুযোগে তাঁর স্টার্টআপের ধারণা, উদ্যোগ, পণ্য ও সেবা কেন অনন্য সে ব্যাখ্যা দিতে পারেন। বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে প্রশ্ন আসতে পারে, গ্রাহক কেন আপনার পণ্য গুরুত্ব দেবে? পণ্যে আর কী কী ফিচার বা গুণগত পরিবর্তনের কথা ভাবছেন। আপনাকে বিনিয়োগ দেওয়া হলে কত দূর যেতে পারবেন। বিনিয়োগকারীর প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়ে খুশি করতে পারলে হয়তো পেয়ে যাবেন পরবর্তী সাক্ষাতের দিন-তারিখ। অনেক সময় একজন উদ্যোক্তা নিজেই ব্যবসা চালান। অনেক সময় কয়েকজন মিলে শুরু করেন ব্যবসা। ব্যবসা শুরুর পর সেখানে মানবসম্পদ দেখা, বিপণন, উৎপাদন, প্রযুক্তি নানা খাতের কর্মীর প্রয়োজন হতে পারে। সব মিলিয়ে একটি টিম সফলভাবে কাজ করলে তবেই সে ব্যবসা সফল হতে পারে। বিনিয়োগকারীর চোখ থাকে ব্যবসায় সফল টিমের দিকে। বিনিয়োগকারীদের চোখ অনেক সময় ‘জহুরির’ চোখ হতে হয়। ভালো টিম দেখলে তিনি বিনিয়োগে উৎসাহী হন। তাই টিম সম্পর্কিত প্রশ্ন করতে পারেন। প্রশ্ন হতে পারে, আপনার টিমে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কে? তাঁর ভূমিকা কী? আরও জানতে যেতে পারেন এ লিংকে