যত দোষ যেন বাদুড়ের! যেকোনো অশুভের প্রতীক যেন পৃথিবীর একমাত্র উড়ুক্কু স্তন্যপায়ী প্রাণীটি। একে এভাবে তুলে ধরা হয় মানুষের সামনে। যেকোনো ভৌতিক চলচ্চিত্র কিংবা হ্যালোইন নিয়ে ট্যাবলয়েড কিছুই বাদ যায় না। বাদুড় মানেই যেন ভীতিকর। বর্তমানে কোভিড-১৯ মহামারি সৃষ্টির পেছনে দায়ী যে সার্স-কোভ-২ ভাইরাস, তার প্রকৃত উৎস বাদুড়, এমন প্রমাণ পাওয়ার পর থেকে বাদুড় সম্পর্কে আরও খারাপ ধারণা তৈরি হয়েছে। বাদুড়ের সংখ্যা কমানোর জন্যও সক্রিয় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে। কিন্তু তাতে অবস্থা কী দাঁড়াবে, তা কি একবারও কেউ ভেবেছেন?
সায়েন্টিফিক আমেরিকান ব্লগে এ নিয়ে একটি মতামত প্রকাশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ভারমন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের টিমোথি ট্রুয়ার, পর্তুগালের পোর্তো বিশ্ববিদ্যালয়ের রিকার্ডো রোচা ও ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলের কারা ব্রুক নামের তিনজন গবেষক।
গবেষকদের যুক্তি, বাদুড়ের প্রতি এমন নেতিবাচক মনোভাব দেখালে বাদুড় সংরক্ষণ আরও কঠিন হবে এবং এর ফলে বাদুড় আমাদের যে জটিল সুবিধাগুলো এনে দেয়, তা রক্ষা করা কঠিন হবে। এ ছাড়া তাদের বহন করা রোগটির জন্য বাদুড় মেরে ফেললে তা উল্টো আমাদেরই ক্ষতির কারণ হয়ে ফিরে আসতে পারে!
অনেক গবেষক ইবোলা, নিপাহ ও সার্স ভাইরাস ছড়ানোয় বাদুড়ের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা দেখতে পেয়েছেন। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাদুড় থেকে যত রোগ ছড়ায় তার সংখ্যাটা ভ্রু কুঁচকে দেওয়ার মতোই। সংক্ষেপে বলা যায়, কিছুটা প্যাথোজেনের আক্রমণাত্মক প্রতিরোধক্ষমতা সহ্য করার ক্ষমতা বাদুড়ের থাকতে পারে, যা জঘন্য ভাইরাসের সহ-বিবর্তনকে সূচিত করে। বাদুড় থেকে যখন অন্য স্তন্যপায়ীর ইমিউন সিস্টেমে এই ভাইরাস প্রবেশ করে, তখন তার জন্য একে সামলানো কঠিন হয়। তবে রোগের ঝুঁকি সৃষ্টির জন্য বাদুড়কে দায়ী করে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার আগে এর উপকারী দিকগুলোও বিবেচনা করতে হবে। বেশ কয়েকটি উপায়ে এটি মানুষকে সুস্থ থাকতে সাহায্যও করে।
বাদুড় থেকে সবচেয়ে বড় উপকার হচ্ছে আমাদের বনাঞ্চলে গাছের সংখ্যা বাড়ানো ও সার সরবরাহ। আমসহ বিভিন্ন ফলে পরাগায়ন ছাড়াও ৩০০ প্রজাতির শস্যে পরাগায়নে সাহায্য করে বাদুড়। বিভিন্ন ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ খেয়ে খাদ্য উৎপাদন বাড়ায়। বাদুড় অনুন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিক্ষেত্রে বিনা খরচে কীটপতঙ্গ দমনের কাজ করে ফসল উৎপাদনে ভূমিকা রাখে।
মথসহ অন্যান্য পোকা খেয়ে পরোক্ষভাবে আমাদের সুস্থ রাখতে ভূমিকা রাখে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে বাদুড় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ায় হোয়াইট নোজ সিনড্রোম নামে একটি সমস্যা সৃষ্টি হয়, যাতে কৃষিপ্রধান অঞ্চলগুলোতে শিশুমৃত্যু বেড়ে গিয়েছিল। সেখানে অতিমাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ করতে হচ্ছিল। এ ছাড়া অ্যানোফিলিস ও অন্যান্য রোগ সৃষ্টিকারী মশা খেয়ে আমাদের উপকার করে বাদুড়।
গবেষকেরা বলেন, ভুল অনুমানের ওপর ভিত্তি করে বাদুড়কে ক্ষতিগ্রস্ত করা বা নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হলে ভবিষ্যতের সার্স বা ইবোলার আরও বড় ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। পেরুতে রেবিজ প্রতিরোধে ভ্যাম্পায়ার বাদুড় মেরেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। উগান্ডাতেও মিসরীয় ফ্রুট ব্যাট ধ্বংস করে ফেলেও মারবার্গ ভাইরাসের প্রকোপ বাড়তে দেখা গেছে। অস্ট্রেলিয়াতে বাদুড় মেরে ফেলে হেনড্রা ভাইরাসের মতো রোগের ঝুঁকি বাড়তে দেখা গেছে।
গত মার্চ মাসে ইন্দোনেশিয়া বাজারের মধ্যে থাকা বাদুড় মেরে ফেলতে বলে। রুয়ান্ডাতেও ফ্রুট ব্যাট ফায়ারহোস হিসেবে বাদুড় মেরে ফেলার গুঞ্জন শোনা যায়। বর্তমান মহামারি মোকাবিলা করতে এ ধরনের পদক্ষেপ তাই ভবিষ্যৎ নিরাপদ করতে কোনো প্রভাব ফেলবে না।
আমরা পরবর্তী প্রাণী থেকে আসা মহামারি থেকে টিকে থাকার রেসিপি নিখুঁত করার চেষ্টা করছি। এর জন্য অবশ্যই বিস্তৃত রোগ নজরদারি এবং একটি উন্নত জনস্বাস্থ্য অবকাঠামোর প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া বাদুড়কে আমরা অন্যদের জন্য অশুভ হিসেবে তুলে ধরা বন্ধ করতে পারি। আমাদের বাদুড় সংরক্ষণের নির্দিষ্ট পদক্ষেপ প্রয়োজন।
আসলে বিপদ তখনই ঘটে যখন আমরা বাদুড়ের দুনিয়ায় হানা দিই বা তাদের আমাদের দুনিয়ায় টেনে আনি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই দেখুন। অপর্যাপ্ত বনজ সম্পদের কারণে বাদুড় খেজুরগাছে চলে আসছে। লোকেরা অজান্তেই কাঁচা খেজুরের রস পান করছে। ফলে নিপাহ ভাইরাস ছড়াচ্ছে। আরও সাধারণভাবে বললে, বাদুড় থেকে ভাইরাস ধাপে ধাপে আসে। বিভিন্ন বাহক যেমন ঘোড়া, উট বা শূকরেও বাদুড়ের ভাইরাস থাকতে পারে। তাদের আদি বাসস্থানে, বাদুড় থেকে পোষা প্রাণীতে ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়ার খুব কমই সম্ভাবনা থাকে। বাদুড়ের আবাসস্থল পুনরুদ্ধারে ব্যবস্থা নেওয়া হলে মানুষ বা আমাদের গৃহপালিত প্রাণীর সঙ্গে যোগাযোগ হ্রাস পাবে।
এ ছাড়া বাদুড়কে সহানুভূতি দেখাতে বন্য প্রাণী ব্যবসাতেও লাগাম টানা যায়। এতে মানুষ বা অন্য প্রাণীর সংস্পর্শে বাদুড় আসবে কম। ধারণা করা হয়, চীনের উহানে বন্য প্রাণীর বাজার থেকে বাদুড়ের মাধ্যমে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঘটেছিল। তবে এর জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার মানুষের স্বাভাবিক বুদ্ধি-বিবেচনা। নিরাপদে থাকার জন্য ১৪০০ স্বীকৃত বাদুড়ের প্রজাতির বিতরণ, সহ-আবাস এবং সংখ্যা ঠিক রাখার প্রবণতার জন্য অবিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা দাবি করে।
সুখবর হচ্ছে, আধুনিক জিনোম সিকোয়েন্সিং পদ্ধতিগুলো বাদুড়ের ভাইরাসের পূর্ববর্তী রহস্য খুলতে শুরু করেছে। বাদুড় নিয়ে যত নেতিবাচক প্রচার থাকুক না কেন বিজ্ঞানীদের অবশ্যই ঝুঁকির পাশাপাশি ভালোটির ওপর জোর দিতে হবে। বাদুড় নিয়ে বার্তা দিতে হবে যে বাদুড়কে টিকিয়ে রেখেও আমরা সুস্থ জীবন যাপন চালিয়ে যেতে পারি।