ফেসবুক বদলে যাচ্ছে। অন্তত বাংলাদেশের মতো তারুণ্যনির্ভর দেশের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্ন কৌশল নিতে চাইছে তারা। বিশ্বজুড়ে ভুয়া খবর আর প্রাইভেসি সমস্যা নিয়ে সমালোচিত হলেও বাংলাদেশে গঠনমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে চাইছে সামাজিক যোগাযোগের শীর্ষ এ সাইট। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে লিডারশিপ তৈরি ও গ্রুপগুলোকে প্রাধান্য দিতে চায় ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। এ ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশি ফেসবুক গ্রুপ ‘সার্চ ইংলিশকে’ আদর্শ হিসেবে ধরছে তারা।
বিশ্বজুড়ে প্রায় ২৪০ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীর মধ্যে বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারী তিন কোটির মতো। এর মধ্যে অধিকাংশ তরুণ। ফেসবুক চাইছে এ তরুণ ফেসবুক ব্যবহারকারীদের সৃজনশীল বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত রাখতে।
ইতিমধ্যে ভুয়া খবর ছড়ানো বা নির্বাচনে হস্তক্ষেপের মতো বিষয়গুলোয় কঠোর অবস্থান নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। গত বছরের ডিসেম্বরে নীতিমালার বাইরে গিয়ে কাজ করায় বাংলাদেশের নয়টি পেজ ও ছয়টি অ্যাকাউন্ট ডিলিট করে দেয় ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। ফেসবুক নিউজরুমের ‘টেকিং ডাউন কো-অর্ডিনেটেড ইনঅথেন্টিক বিহেভিয়র ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আমরা অনুসন্ধানের মাধ্যমে দেখেছি, এগুলোকে স্বতন্ত্র নিউজ আউটলেট মনে হলেও এসব পেজ দিয়ে সরকারবিরোধী ও বিরোধী দলের বিপক্ষে বিভিন্ন কনটেন্ট দেওয়া হতো।’ সেখানে আরও বলা হয়, ‘এই ধরনের কাজ আমাদের মিস প্রেজেন্টেশন পলিসির (মিথ্যা উপস্থাপন নীতিমালা) মাধ্যমে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমাদের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অন্যদের ভুল পথে পরিচালিত করার সুযোগ দেওয়া হয় না।’
সম্প্রতি ফেসবুকের বার্ষিক ডেভেলপার সম্মেলন এফ-৮-এ প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক জাকারবার্গ ফেসবুকে গ্রুপ পোস্টগুলোকে নিউজফিডে গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়ে ইঙ্গিত দেন। এ ছাড়া গ্রুপ নিয়ন্ত্রণে ফেসবুক বেশ কিছু কঠোর নীতিমালাও নিয়েছে। যেসব পেজ ও গ্রুপ থেকে ভুয়া খবর ছড়ানো হবে, তা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। গত বুধবার এ বিষয়ে সতর্ক করে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বলেছে, কোনো পেজ বা গ্রুপের ক্ষেত্রে যদি কমিউনিটি গাইডলাইন ভাঙার প্রমাণ পাওয়া না যায়, তারপরও ভুয়া খবর ছড়ালে সক্রিয়ভাবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর বিপরীতে যেসব গ্রুপে ইতিবাচক কাজ হবে, সেগুলোকে অর্থ আয়ের সুযোগ দেওয়া ছাড়াও বিভিন্ন সুবিধা দেবে ফেসবুক।
জাকারবার্গের মতে, ব্যবহারকারীরা অনেক সময় পাবলিকলি পোস্ট করতে সংকোচ করে। অনেক ক্ষেত্রে প্রাইভেট গ্রুপগুলোয় তারা তাদের মনের কথা জানাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। গ্রুপগুলোর প্রাধান্য এখন বেড়েছে। চাইলে গ্রুপগুলোয় দেওয়া পোস্ট এখন থেকে নিজের প্রোফাইলেও শেয়ার করা যাবে বলেও জানান তিনি। বর্তমানে মিম ও কমিউনিটি গ্রুপভিত্তিক গ্রুপগুলোর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই গ্রুপগুলোর জন্য আলাদা কিছু ফিচারও আনছে সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্টটি। যেমন স্বাস্থ্যবিষয়ক গ্রুপগুলোয় গ্রুপ অ্যাডমিনকে দিয়ে নিজের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করাতে পারবেন ব্যবহারকারীরা। গেমিংভিত্তিক গ্রুপগুলোর চ্যাটেও যুক্ত করা হবে বিশেষ কিছু ফিচার। গত পাঁচ বছরে ফেসবুকের ইন্টারফেসে এত বড় পরিবর্তন আর আসেনি।
ফেসবুকের এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের (এপিএসি) কমিউনিটি পার্টনারশিপস বিভাগের প্রধান গ্রেস ক্লাপহাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিদিন আমাদের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছে বাংলাদেশের মানুষ এবং পরস্পরের সহযোগিতার কমিউনিটি গড়ে তুলেছে। আমরা এতে আনন্দিত। তরুণদের ক্ষমতায়ন বা দাতব৵কাজের প্রয়োজন, যা-ই হোক না কেন, তা সম্ভব করতে আমাদের কমিউনিটি লিডাররা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কমিউনিটি লিডারশিপ প্রোগ্রামের মাধ্যমে কমিউনিটির মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব বাড়ানোর জন্য কমিউনিটি লিডারদের প্রয়োজনীয় সমর্থন দেয় ফেসবুক। বাংলাদেশের কমিউনিটিকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য সার্চ ইংলিশ প্রতিষ্ঠাতা রাজীব আহমেদকে নির্বাচিত করা হচ্ছে। তার কমিউনিটির লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করতে চাই আমরা।’
গত বছরের সেপ্টেম্বরে ফেসবুক গ্রুপে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় ফেসবুকের কমিউনিটি লিডার নির্বাচিত হন বাংলাদেশের রাজীব আহমেদ। ৪৬টি দেশের ১১৫ জন স্থান পায় এ তালিকায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে নির্বাচিত কমিউনিটি লিডারদের মধ্য থেকে পাঁচজনকে এক মিলিয়ন ডলার করে এবং অন্যদের ৫০ হাজার ডলার করে সহায়তা দেয় ফেসবুক। এ অর্থ দিয়ে উদ্যোক্তারা দক্ষ কমিউনিটি গড়ে তোলার কাজ করেন।
রাজীব আহমেদ বলেন, সার্চ ইংলিশ গ্রুপটি সেই ২০১৬ সালের ১ জুলাই থেকে বিশ্বের বাংলাভাষী সব মানুষের জন্য ইংরেজি ভাষা চর্চার একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। গ্রুপটি ইংরেজি ভাষার গ্রুপ, তাই এখানে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে অনেকে যোগ দিয়েছে এবং চর্চা করেছে। এতে ১৯ লাখ সদস্য যুক্ত হয়েছে। সার্চ ইংলিশের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো ভয় আর লজ্জা কাটিয়ে উঠে ইংরেজি চর্চা করতে উৎসাহিত করতে পারা। ঢাকায় এ গ্রুপের পাঁচ লাখ সদস্য আছে; ঢাকার বাইরে ১০ লাখের মতো। অন্য সদস্যরা বিশ্বের ১০০টি দেশ থেকে। এর মধ্যে ভারতের সদস্য বেশি। এটাই অনলাইন শিক্ষাক্ষেত্রে অন্যতম বড় গ্রুপ। ২০১৭ সালে ফেসবুক এ গ্রুপকে নিয়ে একটি ভিডিও প্রকাশ করে প্রচার করে।
সার্চ ইংলিশের পাশাপাশি দেশের অন্য গ্রুপগুলোর কার্যক্রমের দিকেও নজর রাখছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। এসব গ্রুপ থেকেও লিডারশিপ প্রোগ্রামে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিচ্ছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। রাজীব আহমেদ জানান, গ্রুপগুলোর জন্য করণীয় হচ্ছে ফেসবুককে মানুষের মঙ্গল সাধনের চেষ্টা করা। লিডারশিপ প্রোগ্রামে যুক্ত হতে আবেদন করতে হবে। গ্রুপ নিয়ে প্রয়োজনীয় প্রশ্নের উত্তর ইংরেজিতে তৈরি করে রাখতে হবে। এ ছাড়া গ্রুপ সক্রিয় রাখতে চেষ্টা করতে হবে। ফেসবুকের লক্ষ্য হচ্ছে গ্রুপ সদস্যদের জন্য ভালো কিছু করা। দেশে অনেকের ফেসবুক নিয়ে নেতিবাচক ধারণা আছে। ফেসবুকের এসব উদ্যোগে তাতে পরিবর্তন আসবে ও তরুণেরা উৎসাহ পাবে।
কমিউনিটি লিডারশিপের পাশাপাশি শিগগিরই বাংলাদেশে ফেসবুকের কান্ট্রি হেড নিয়োগ দেওয়া হবে বলেও ফেসবুক সূত্রে জানা গেছে। ফেসবুক সিঙ্গাপুর অফিসের অধীনে তিনি কাজ করবেন। যদিও বাংলাদেশে ফেসবুকের অফিস এখনই হচ্ছে না বলে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি স্পেনের বার্সেলোনায় মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে ফেসবুক প্রতিনিধিদের সঙ্গে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের বৈঠকের পরও এই প্রক্রিয়ায় গতি আসে।
গত কয়েক বছরে ফেসবুকে গুজব, ভুয়া খবর, অপপ্রচার, প্রশ্নফাঁসের মতো বিষয়ে ফেসবুকের সমালোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত সাড়া চাওয়া হয়।
বাংলাদেশের সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে সৃজনশীল বিষয়গুলোয় আরও গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে ফেসবুকের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে।