গুগলের এআই কোয়ান্টাম টিম কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের ক্ষেত্রে আরেক ধাপ এগিয়ে গেছে। গুগলের সিকামোর প্রসেসর সাড়ে তিন মিনিট সময়ে এমন এক হিসাব সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে, যা প্রচলিত সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটারের করতে ১০ হাজার বছর সময় লাগত।
যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনায় ১১৬ বছর আগে রাইট ভ্রাতৃদ্বয় প্রথমবারের মতো উড়োজাহাজের উড্ডয়ন পরীক্ষা করেন। মাত্র ১২ সেকেন্ড স্থায়ী হয়েছিল তাঁদের সেই ফ্লাইট। কিন্তু বাতাসে ভেসে থাকার সেই ১২ সেকেন্ডের অভিজ্ঞতাই মানুষের সামনে খুলে দিয়েছিল এক দারুণ সম্ভাবনার দরজা। আজকের ড্রোন প্রযুক্তি থেকে শুরু করে অভাবনীয় সব প্রযুক্তির যুদ্ধ কিংবা যাত্রীবাহী বিমানের সাফল্যের সূত্রটি ওই ১২ সেকেন্ডেই রয়েছে।
আজকের দিনের যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে অনেক কিছুই বদলে গেছে শুধু এই উড্ডয়ন কৌশল আবিষ্কারের মাধ্যমে। বদলে গেছে অর্থনীতি থেকে শুরু করে সবকিছু। আজকের এই বিশ্বগ্রাম কখনো সম্ভবই হতো না হয়তো, যদি না ওই ১২ সেকেন্ডের সাফল্যটি ধরা না দিত। ঠিক এমনই এক সাফল্য এনে দিয়েছেন গুগলের বিজ্ঞানীরা। তাঁরা কোয়ান্টাম প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে এমন এক সমস্যার সমাধানের ঘোষণা দিয়েছেন, যা কিনা বিশ্বের শীর্ষ সুপার কম্পিউটারকেও স্তম্ভিত করে দিতে পারত। আর এই সাফল্যকে তাঁরা বর্ণনা করেছেন ‘কোয়ান্টাম আধিপত্য’ হিসেবে।
আধিপত্য শব্দটিকে নিঃসন্দেহে অনেক গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, এ প্রযুক্তির আবিষ্কার পুরো প্রযুক্তি বিশ্বকেই খোলনলচে বদলে দেবে। বিদ্যমান কম্পিউটার ব্যবস্থায় আনবে অভাবনীয় পরিবর্তন।
গুগলের এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) কোয়ান্টাম টিম জানিয়েছে, কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের দিকে তারা এক ধাপ এগিয়ে গেছে। অতি ক্ষুদ্র কণার বিচিত্র ধর্মকে কাজে লাগিয়ে বিপুলসংখ্যক তথ্য সন্নিবেশের প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করেই দাঁড়াতে চায় কোয়ান্টাম কম্পিউটার, যা এখনকার কম্পিউটারের বাইনারি পদ্ধতির দুটি সংখ্যাকে আলাদা নয়, বরং একই সঙ্গে ব্যবহার করতেও সক্ষম। আরও ভালো করে বললে এর ভিতে রয়েছে পদার্থবিদ্যার কোয়ান্টাম বলবিদ্যার তত্ত্ব, যেখানে অতি ক্ষুদ্র কণার ক্ষেত্রে কণা ও তরঙ্গ অনেকটা একীভূত হয়ে যায়। এ দুইয়ের রূপান্তর ও অস্তিত্ব সমভাবে ক্রিয়াশীল থাকে।
আজ বুধবার বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারে প্রকাশিত এ সম্পর্কিত প্রতিবেদনে বলা হয়, গুগলের এআই কোয়ান্টাম টিম কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের ক্ষেত্রে আরেক ধাপ এগিয়ে গেছে। গুগলের সিকামোর প্রসেসর সাড়ে তিন মিনিট সময়ে এমন এক হিসাব সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে, যা প্রচলিত সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটারের করতে ১০ হাজার বছর সময় লাগত।
এই একটি তথ্যই কোয়ান্টাম কম্পিউটারের শক্তি সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য যথেষ্ট। বলা জরুরি যে, গুগলের এই সাফল্য এখনো রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের সেই ১২ সেকেন্ডের সাফল্যের সঙ্গে তুলনীয়। তাদের এই সাফল্য সম্ভাবনার দরজার খিলটি আলগা করেছে মাত্র, পুরোপুরি খোলেনি। এ ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ সাফল্য এক অভাবিত বিশ্বকাঠামোর সন্ধান দিতে পারে, যেখানে বদলে যাবে যোগাযোগ ধারণা, তথ্য সংরক্ষণ পদ্ধতি এবং এমনকি মহাবিশ্ব সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিও।
কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি নিয়ে বিশ্বের বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। এ প্রতিযোগিতায় শামিল রয়েছে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোও। কারণ, এই প্রযুক্তি হাতে আসা মানে নিরাপত্তা, বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্যদের ওপর রাজ করার শক্তি পাওয়া। ফলে গুগলের এই আবিষ্কার শুধু গুগল নয়, যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়ে শুধু বড় বড় হিসাবই নয়, আজকের পুরো ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে এক তুড়িতে ধসিয়ে দেওয়া সম্ভব । তাই এ প্রযুক্তি যার হাতে আগে আসবে, সে অন্যদের চেয়ে অনেক গুণ এগিয়ে থাকার সুবিধা ভোগ করবে। এ ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে সুবিধাটি পাচ্ছে গুগল ও যুক্তরাষ্ট্র। গত মাসেই অবশ্য গুগলের এ সাফল্যের কথা প্রচার পেয়েছিল । নাসার ওয়েবসাইটে এ সম্পর্কিত গবেষণায় সাফল্যের তথ্য প্রকাশের পর আবার সরিয়ে নেওয়া হয়। সে সময় গুগলের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো সাফল্যের কথা স্বীকারও করা হয়নি। তবে এবার তারা গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেই তা স্বীকার করে নিল।
গুগলের এই সাফল্য নিয়ে অবশ্য নানা আলোচনা চলছে এখন। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীরা গুগলের দাবি নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলছে। এর মধ্যে আইবিএমই যেমন বলছে, গুগল যে হিসাবের কথা বলছে, তা করতে এখনকার কম্পিউটারের হয়তো আড়াই দিন সময় লাগত। তারা একই সঙ্গে গুগল কথিত ‘কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি’ শব্দটি নিয়েও আপত্তি করেছে। তারা বলছে, গুগল যেমনটা বলছে, তাতে মনে হয় যে, বর্তমানের কম্পিউটার পদ্ধতি এর মধ্য দিয়ে অকার্যকর হয়ে গেছে।
আইবিএমের বক্তব্যটিও গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হয়। কারণ গুগলের সিকামোর প্রসেসরের অনুরূপ শক্তিশালী প্রসেসর তারাও তৈরি করেছে। কথা হচ্ছে এই সিকামোরের শক্তি আসলে কেমন? এক কথায় উত্তর, এটি ৫৩ কিউবিটস শক্তিসম্পন্ন। কথা হলো এই কিউবিটস আবার কী?
বর্তমান কম্পিউটার মূলত বিট-এর মধ্যেই তথ্য সংরক্ষণ করে। এই বিট হচ্ছে বাইনারি ‘০’ অথবা ‘১’-প্রতিনিধিত্বকারী, যা বৈদ্যুতিক বা আলোক সংকেতের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে। এই বিটস পদ্ধতিতে আট বিট মিলে তৈরি হয় বাইট, যা সাধারণত একটি সংকেতকে সংরক্ষণে সক্ষম। তাহলে কিউবিট কী জিনিস? এটিও ০-১ বাইনারিকেই ব্যবহার করে তথ্য সংরক্ষণের জন্য। কিন্তু আলাদাভাবে নয়। একই সঙ্গে। অনেকটা কোয়ান্টাম তত্ত্বে বর্ণিত পদার্থের কণা ও তরঙ্গ ধর্মের মতো। কারণ, কোয়ান্টাম দুনিয়ায় একই কণা একই সঙ্গে একাধিক জায়গায় থাকতে পারে এবং তরঙ্গ ও কণাধর্মীতার মধ্যে তার বিচরণও সাবলীল। এটি কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মূল শক্তি, যা ০-১ এর সহাবস্থানের মাধ্যমে একসঙ্গে বহু তথ্য সংরক্ষণে একে সক্ষম করে তোলে। এটি এর শক্তিকে দ্বিগুণ নয়, বহুগুণ করবে। কারণ এই শক্তি জ্যামিতিক হারে বাড়ে। যেমন, দুই কিউবিটে যদি চারটি সংখ্যা সংরক্ষণ করা যায়, তবে তিন কিউবিটে যাবে আটটি, আর চার কিউবিট পারবে ১৬টি সংখ্যা সংরক্ষণ করতে। একই সঙ্গে এটি একই সঙ্গে একাধিক হিসাব করার সক্ষমতাও দেয়।