করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম-বেশি পুরুষ বা নারী সবারই আছে। কিন্তু দেখা গেছে পুরুষের তুলনায় নারীদের ঝুঁকি কম। ধরা যাক, একজন বয়স্ক ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হলেন। তাহলে সমবয়সী একজন নারীর তুলনায় তাঁর রোগের তীব্রতা বেশি হতে পারে। আমাদের দেশে প্রতিদিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে যে পরিসংখ্যান জানানো হয়, সেখানে দেখা যায়, কোভিডে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা পুরুষের চেয়ে নারীর অনেক কম। এর কারণ কী?
বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে নারীদের তুলনায় ছেলেদের রোগপ্রতিরোধী সক্রিয়তা কিছুটা দুর্বল হয়ে থাকে। তাদের গবেষণার ফলাফল ‘নেচার’ ম্যাগাজিনে আগস্টের শেষ দিকে প্রকাশিত হয়েছে। এ বিষয়ে ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এ বিস্তারিত ছাপা হয়েছে (২৬ আগস্ট প্রকাশিত, আপডেট ২৭ আগস্ট)।
সেখানে বলা হয়েছে, বিশেষভাবে ৬০-এর বেশি বয়সের পুরুষদের সংক্রমণ রোধের জন্য শরীরের স্বাভাবিক প্রতিরোধক্ষমতা খুব বেশি কাজে লাগে না। টিকার (ভ্যাকসিন) ওপর তাঁদের বেশি নির্ভরশীল হতে হয়। গবেষণায় নেতৃত্ব দেন ইয়েল ইউনিভার্সিটির ইমিউনোলজিস্ট আকিকো আইওয়াসাকি (Akiko Iwasaki)। তিনি বলেন, পুরুষদের ক্ষেত্রে সংক্রমণরোধী সক্রিয়তা সৃষ্টির উদ্দীপনা প্রয়োজনের তুলনায় স্পষ্টতই কম।
অভিজ্ঞতায় আমরা জানি, বিভিন্ন সংক্রমণের ফলে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দেহের রোগপ্রতিরোধী ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারীর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। গবেষণার ফলাফল এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। নারীরা দ্রুত ও শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। এর কারণ হয়তো এই, গর্ভের সন্তান বা নবজাতকের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে, এমন প্যাথোজেন মোকাবিলার সক্ষমতা নারীদের শরীরে থাকে।
বয়স্ক পুরুষদের দেহে রোগপ্রতিরোধী টি-সেল বেশ দুর্বল, সে জন্যই আক্রান্ত হলে বয়স্ক ব্যক্তিরা বেশি কাহিল হয়ে পড়েন। বয়স যত বাড়ে, টি-সেলের সক্রিয় প্রতিক্রিয়া তত বেশি দুর্বল হতে থাকে। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে তা হয় না। বয়স বাড়লে, এমনকি ৯০ বছর বয়সেও দেখা যায় তাঁদের টি-সেলের সক্রিয়তা বেশ ভালো।
তবে নারীদের যদি আগে থেকেই কিডনি, ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড বা যকৃতের সমস্যা থাকে অথবা ডায়াবেটিস বা অন্য কোনো জটিল অসুখ থাকে, তাহলে হয়তো নারীদের সংক্রমণও জটিল হয়ে উঠতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন কোম্পানি ‘টাচ টুলস’ নামের এক ধরনের ছোট যন্ত্র বিক্রি করছে। এটা ব্যবহার করে হাতের স্পর্শ ছাড়াই ঘরের দরজা খোলা, সুইচ টিপে ঘরের বাতি জ্বালানো-নেভানো, ইলেকট্রনিক রিসিপ্ট স্বাক্ষর করা যায়। তবে এত সতর্কতার প্রয়োজন আছে কি না, সে প্রশ্নটিও আলোচিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি (সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন) বলেছে, করোনাভাইরাস মূলত ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ছড়ায়। মুখে মাস্ক অবশ্যই পরতে হবে। অন্তত ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। বেশি ভিড় এড়িয়ে চলা এবং আবদ্ধ পরিবেশে না থেকে খোলামেলা পরিবেশে চলাফেরা বা কাজ করার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। লোকজনের মধ্যে হাঁচি-কাশি দিতে সাবধানতা, জোরে কথা না বলা। এবং কিছুক্ষণ পর পর সাবান দিয়ে হাত ধোয়া—এসব নিয়ম মেনে চললে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা খুব কমে যায়।
আমাদের দেশে অনেকে মুখে মাস্ক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন। কিন্তু অনেকে কিছুই মানতে চান না। আইনের ভয়ে হয়তো পকেটে মাস্ক রাখেন, মুখে পরেন না। এটা রোগ ছড়িয়ে পড়ার একটি বড় কারণ হতে পারে। তাই সবাইকে ন্যূনতম কিছু বিধিবিধান অবশ্যই মেনে চলতে হবে।
আবার অনেকে বেশি সাবধানী। বাজার থেকে শাকসবজি, মাছ-গোশত এনে সব ধুয়েমুছে নেন। দরজার হাতল, বাতির সুইচ সবকিছু সারাক্ষণ স্যানিটাইজার দিয়ে পরিষ্কার করেন। এর ফলে অনেকটা নিশ্চিত হওয়া যায়। কিন্তু কতটা সতর্কতা দরকার, সে বিষয়েও একটি নির্দেশিকা থাকা প্রয়োজন।
কোভিড-১৯ মহামারি আমাদের জীবযাত্রার ধরন, অফিসপদ্ধতি, শিক্ষাপ্রণালি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড—সবকিছু পাল্টে দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী এক নতুন ধারা চলছে। পুরোনো চলন-বলন অনেকটাই বদলে যাচ্ছে। যেমন এখন কারও সঙ্গে দেখা হলে একটু তফাতে থেকে হাত নেড়ে স্বাগত জানাই। হ্যান্ডশেক আর করি না। পরিবারের বয়স্ক সদস্যরা বাইরে কম যান। পরিচিত জনেরাও বয়স্ক কারও কাছাকাছি যেতে ইতস্তত করেন। এটা স্বাভাবিক। কারণ সাবধানে না থাকলে একজন অসুস্থ হবেন, আর তাঁর সঙ্গে পরিবারের অন্য কয়েকজনও অসুস্থ হবেন।
তাই আমাদের আগামী দিনে নতুন ধারার জীবনপ্রণালিতে অভ্যস্ত হতে হবে। হয়তো কোভিড-১৯ চলে গেলেও নতুন ধারার জীবনযাপন প্রণালি আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে যাবে। অন্তত সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, হাঁচি-কাশিতে সাবধানী হওয়া, যথাসম্ভব শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা, বাসার বাইরে মাস্ক পরা—এসব নতুন কিছু উপাদান আমাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠবে হয়তো।
আব্দুল কাইুয়ম: মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক
quayum.abdul@prothomalo.com