স্বপ্নের পেছনে ছুটতে ছুটতে সাধ পূরণ করেছেন শফিকুল ইসলাম। পৌঁছে গেছেন লালিত লক্ষ্যে। জার্মানিতে বসবাসরত বাংলাদেশি এই তরুণ প্রাণিবিজ্ঞানী নিজস্ব অর্থায়নে দেশের জন্য প্রথমবারের মতো তৈরি করেছেন প্রাণীদের তথ্যসমৃদ্ধ অ্যাপ। মুঠোফোনে হাতের নাগালে পাওয়া যাবে দেশের কোন এলাকায় কোন প্রাণী রয়েছে। পাওয়া যাবে এ নিয়ে বিশদ তথ্য। অ্যাপটি তৈরিতে শফিকুলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন দেশি-বিদেশি ২৭ জন প্রাণিবিজ্ঞানী।
কাল রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ ও বাংলাদেশ প্রাণীবিজ্ঞান সমিতি যৌথভাবে এই অ্যাপের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহমুদ-উল আমীন মিলনায়তনে। অ্যান্ড্রয়েড ফোনের প্লে স্টোর থেকে ওয়াইল্ডমেনটর নামের অ্যাপটি মুঠোফোনে ইনস্টল করে নেওয়া যাবে। এই অ্যাপের ক্ষেত্রে মূল সমন্বয়ের কাজ করছেন অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত আরেক বাংলাদেশি প্রাণিবিজ্ঞানী রোখসানা সুলতানা এবং বিশেষজ্ঞ হিসেবে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম নিয়ামুল নাসের।
মাসখানেকের জন্য জার্মানি থেকে বাংলাদেশে এসেছেন শফিকুল ইসলাম (৩০)। কিছুদিন আগে তাঁর সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। আলাপচারিতায় তিনি জানান অ্যাপ তৈরির গোড়ার কথা, শুরুর ব্যর্থতা, নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। তিনি বলেন, এই কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ। কাজটি হচ্ছেও বাংলাদেশকে নিয়ে। এই অ্যাপের উদ্দেশ্য সাধারণ জনগণের সঙ্গে বিজ্ঞানীদের সম্পর্ক তৈরি এবং এ সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে দুই পক্ষের মধ্যে তথ্য আদান–প্রদানের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা।
শফিকুল জানান, এই সময়ে শুধু অ্যান্ড্রয়েড ফোনে অ্যাপটি ব্যবহার করা যাবে। শুরুতে ৭৫২ প্রজাতির প্রাণী, উদ্ভিদ, বুনো ফুল এবং ঔষধি গাছের তথ্য যুক্ত করা হয়েছে। তবে এতে মূল আলোকপাত করা হয়েছে প্রাণীর ওপর। তিন মাস পর অ্যাপটি ডেস্কটপ কম্পিউটার ও ট্যাবলেটে ইনস্টল করা যাবে। আরও কিছু পরে নতুন ফিচার নিয়ে অ্যাপটি আইফোনে ব্যবহার করা যাবে।
শফিকুল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে স্নাতক শেষ করে বন্য প্রাণী বিভাগে মাস্টার্স করেন। উচ্চতর ডিগ্রি নিতে ২০১৪ সালে তিনি জার্মানি চলে যান। সেখানে ২০১৭ সালের অক্টোবরে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেন। গত বছরের এপ্রিলে পাখির বিবর্তনের ওপর পিএইচডি করছেন। এখন ড্রেসডেনে ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে গবেষক হিসেবে কাজ করছেন।
প্রথম উদ্যোগটি ব্যর্থ হয়েছিল
শফিকুল জানান, দেশের প্রাণীদের নিয়ে অ্যাপ তৈরির ভাবনা নিয়ে ২০১২ সালে প্রথম কাজ শুরু করেন। ২০১৫ সালে এতে জার্মানি, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও বাংলাদেশের আরও কয়েকজন তরুণ প্রাণিবিজ্ঞানী স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যুক্ত হন।
শুরুতে ভাবনা অনুযায়ী কাজ করতে পারেনি। সেটাকে ‘ব্যর্থ প্রকল্প’ হিসেবে ফাইলবন্দী করেন। ২০১৬ সাল থেকে শুরু করেন নতুন উদ্যমে। ইউনিভার্সিটি অব মিউনিখ ও টরোন্টো ইউনিভার্সিটির বিদেশি শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলাভিত্তিক প্রাণীর ম্যাপিং এবং প্রাণীগুলোর বর্ণনা তৈরি করে দেন। পরে জার্মানিতে বসবাসরত আরেক বাংলাদেশি তরুণ টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব মিউনিখের ছাত্র শাহ নাজমুস সাকিব এই দলে যোগ দেন। প্রাণীদের ক্ষেত্রে মানুষ কোন বিষয়গুলোয় বেশি অনুসন্ধান করে, তা পর্যালোচনা করে সিস্টেম নকশা নতুনভাবে করেন তিনি। কেউ কেউ বন্য প্রাণীদের জীবনযাপন দেখতে পছন্দ করেন, কেউ শুধু ছবি দেখেন, কেউবা শুধু তথ্য পেতেই আগ্রহ দেখান।
এর বাইরে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন প্রাণীর ছবি যুক্ত করা এবং তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যুক্ত আছেন।
অ্যাপে যা থাকবে
অ্যাপে বাংলা ও ইংরেজি দুটো ভাষা থাকবে। অ্যাপ খুললে প্রাণিজগতের নয়টি বিভাগের শ্রেণি, গোত্র ভেসে উঠবে। এর মধ্যে যেকোনো একটি বিভাগে ক্লিক করলে প্রাণীর বৈজ্ঞানিক নাম, ইংরেজি ও বাংলা নাম, স্থানীয় নাম, বৈশিষ্ট্য ও ৫০ শব্দের মতো বর্ণনা আসবে। বাংলাদেশের আটটি বিভাগ অনুসারে প্রাণীগুলোর ম্যাপিং করা হয়েছে। প্রাণীগুলোর ছবি স্বত্বমুক্ত। যেকেউ তা শেয়ার করতে পারবেন। একটি টেক্সট বাটন আছে, যেখানে যেকেউ তাঁর দেখা কোনো প্রাণীর বর্ণনা ও ছবি যুক্ত করতে পারবেন। এ ছাড়া এখানের তথ্য ও ছবি বার্তার মাধ্যমে অন্য কাউকে পাঠাতে পারবেন। ব্যবহারকারীদের জন্য অ্যাপে লাইভেরও সুযোগ রাখা হয়েছে। অ্যাপ দলে এখন ৩৫ জন সদস্য রয়েছেন। তাঁরা ব্যবহারকারীদের প্রাণীবিষয়ক প্রশ্নের জবাব দেবেন।
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) তালিকা অনুসারে বাংলাদেশে প্রাণীর সংখ্যা ১ হাজার ৬১৯। অ্যাপে ১ হাজার ৩০০–র মতো প্রাণী যুক্ত করার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে প্রাথমিক অবস্থায় অ্যাপে রাখা হয়েছে ৭৫২ প্রজাতি। এর মধ্যে স্তন্যপায়ী ২৭ প্রজাতি, সরীসৃপ ৫৬, উভচর ২২, মাছ ২৭, প্রজাপতি ২২৭, মথ ১২, ঘাসফড়িং ২৫, বিষধর সাপ ৮, মশা ও মাছি ৮, চিংড়ি ৫, মাকড়সা ৫, বুনো ফুল ৯০, ঔষধি গাছ ১৪ এবং পাখি ২২৬ প্রজাতির। পাখির মধ্যে ২১৯ প্রজাতির পাখির শব্দ শুনে শনাক্তকরণের সুবিধা রয়েছে। জেনোকান্ত নামের একটি বিদেশি সংগঠন পাখির ডাক বিনা মূল্যে এই অ্যাপের জন্য দিয়েছে, তারা ব্যবহারকারীদের জন্য স্বত্ব মুক্ত করে দিয়েছে।
অ্যাপে একটি বাটন থাকবে, যেখানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রাণী শনাক্তকরণের সহযোগিতা পাওয়া যাবে। যেমন অ্যাপটি ইনস্টল করা আছে মুঠোফোনে। কেউ কোনো প্রাণীর ছবি তুললে অ্যাপটি প্রাণীটি সম্পর্কে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তথ্য দেবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কীভাবে অ্যাপটিকে উপযোগী করা যায়, সে সম্পর্কে প্রয়োজনীয় উপদেশ, পরামর্শ দিয়ে এতে যুক্ত রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম নিয়ামুল নাসের, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. মনোয়ার হোসেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুল আলীম, বন বিভাগের ড. আবু নাসের মহসিন হোসেইন, গবেষক খন্দকার শাহানুর সাব্বির এবং গবেষক জান্নাতুল রাফিয়া।
প্রাণী বিষয়ে তথ্যভান্ডার হবে অ্যাপটি
এই অ্যাপের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত রোখসানা সুলতানা (৩৯)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকে মাস্টার্স করার পর রোখসানা ২০১২ সাল থেকে সাড়ে তিন বছর বন বিভাগে কাজ করেন। ২০১৬ সালে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় চলে যান। এখন সিডনির ম্যাককোয়েরি ইউনিভার্সিটিতে এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের ওপর পিএইচডি করছেন। ইউরোপ, আমেরিকা ও বাংলাদেশের যে বিজ্ঞানীরা এই অ্যাপের সঙ্গে যুক্ত আছেন, তাঁদের সঙ্গে সমন্বয়ের কাজটি করেন তিনি।
অস্ট্রেলিয়া থেকে টেলিফোনে রোখসানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরেও ছোট ছোট গবেষণা হয়। তাই শফিকুল অ্যাপ তৈরির কথা বলা মাত্র মনে হয়েছে, এটা আমাদের দেশের মানুষের কাজে লাগবে। এই অ্যাপের মাধ্যমে লোকজন প্রাণী সম্পর্কে জানতে পারবেন, সচেতনও হতে পারবেন। কিছু বন্য প্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে। কেন হারিয়ে যাচ্ছে, আমরা জানতে পারছি না। এই অ্যাপের মাধ্যমে কেউ তথ্য দিলে আমরা বুঝতে পারব কী কী হারাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, অনেক মানুষ সাপের কামড়ে মারা যান বাংলাদেশে। এই অ্যাপে বিষধর ও বিষহীন সাপের বর্ণনা ছবি থাকবে, সাপের কামড়ের প্রাথমিক চিকিৎসার উপায়ও থাকবে। ব্যবহারকারীরা চটজলদি জানতে পারবেন সাপ কামড় দিলে কী করতে হবে।
অ্যাপ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম নিয়ামুল নাসের প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভারতসহ আমাদের আশপাশের অনেক দেশে এ ধরনের জীববৈচিত্র্য চেনার অ্যাপ আছে। আমাদের দেশে মাছ, পাখি, প্রাণী চেনার অ্যাপ নেই। দেশ থেকে তরুণ প্রাণিবিদেরা বিদেশে গিয়ে এ ধরনের একটি অ্যাপের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন।’ তিনি আরও বলেন, প্রাণী সংরক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে অ্যাপটি তৈরি হয়েছে। এই অ্যাপের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবেন, কোন প্রাণী বিপন্ন, কোন প্রাণী খাওয়া যাবে না। অ্যাপটি তথ্যভান্ডার হিসেবেও কাজ করবে। এতে অন্যদের তথ্য যুক্ত করার সুযোগ থাকায় প্রাণীর নতুন প্রজাতি বেরিয়ে আসারও সম্ভাবনা রয়েছে। প্রাণীবিষয়ক গবেষণা ও নীতিনির্ধারণী কাজেও লাগবে অ্যাপটি।
শফিকুল জানান, এই অ্যাপ নিয়ে তাঁর আরও নানা পরিকল্পনা রয়েছে। আগামী ১০ বছরে এটা যা হবে, তা ভাবলে কাজের গতি আরও বেড়ে যায়। তাঁর ভাষায়, স্বপ্নের পেছনে ছুটতে কে না ভালোবাসে!
অ্যাপটি দেখতে ক্লিক করুন