>মানুষের কাজের জায়গা দখল করে নিচ্ছে রোবট। ৪৬টি দেশের ৮০০ পেশা বিশ্লেষণ করে গ্লোবাল বিশ্লেষক ম্যাককিনসে বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ৮০ কোটি কাজ চলে যাবে রোবটের হাতে। অতএব এখন যারা স্কুল-কলেজে পড়ছ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কথা ভাবছ, তৈরি হয়ে যাও। আসছে রোবট, আসছে নতুন চ্যালেঞ্জ! লিখেছেন মুনির হাসান
দুবাই বিমানবন্দরে ম্যাকডোনাল্ডসের দোকানে অর্ডার নেওয়ার একটা কিয়স্কে কোনো মানুষ থাকে না। গ্রাহক নিজেই অর্ডার আর টাকা দিয়ে দিতে পারে। এ যেন ভবিষ্যতের পথে যাত্রা! কদিন পর হয়তো রেস্তোরাঁর টেবিলের ওপরটাই হবে মেন্যু। সেখানেই তুমি অর্ডার দেবে, পেমেন্ট করবে এবং বসে থাকবে। খাবার তৈরি হলে কিচেনের রোবটরা ড্রোনে করে তোমার টেবিলে খাবার পাঠিয়ে দেবে!
তোমরা যারা ইন্টারনেটে অনেক সময় কাটাও, তারা কিন্তু এরই মধ্যে রোবটের মুখোমুখি হচ্ছ প্রতিনিয়ত, দিচ্ছ ‘মনুষ্যত্বের’ পরীক্ষা। ওয়েবসাইটে ‘আই অ্যাম নট আ রোবট’ লেখা চেক বক্সে টিক দেওয়া বা ক্যাপচা পূরণ করার মাধ্যমে যে যাচাই করে তুমি রোবট কি না, সে নিজেই কিন্তু একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম বা ‘রোবট’! ১৯২০ সালে চেক নাট্যকার ক্যারেল চ্যাপেক তাঁর আরইউআর নাটকে রোবট কথাটা প্রথম ব্যবহার করেন। সেই নাটকের ‘অধিকারবিহীন শ্রমিক রোবটরা’ বিদ্রোহ করে মানবজাতিকে নিশ্চিহ্ন করার কাজে নেমে পড়েছিল! সায়েন্স ফিকশনের মানবাকৃতির ভয়ংকর রোবটের দেখা পেতে এখনো হয়তো অনেক সময় বাকি। কিন্তু এরই মধ্যে রোবট মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে নানা জায়গায়।
দুবাইয়ের ম্যাকডোনাল্ডস কিংবা চীনের একাধিক হোটেলের ক্লিনারের চাকরি খেয়ে ফেলেছে তারা এরই মধ্যে। সামনে রোবট দিয়ে কাজ করানোর হার বেড়ে যাবে আরও বেশি। অ্যামাজন নামের বিশ্বের সবচেয়ে বড় দোকানটার কথা ভাবো। সেখানে এখন মাত্র এক লাখ রোবটশ্রমিক আছে! হ্যাঁ, এক লাখ! ২০১৯ সালের মধ্যে এই সংখ্যা দেড় লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। তাদের ওয়্যারহাউসে মানুষ কর্মীর সংখ্যা ১ লাখ ২৫ হাজার।
প্রযুক্তির বিকাশ একদিকে কর্মসংস্থান কমিয়ে ফেলে। সিলিকন ভ্যালির উত্থানের আগে, ১৯৯০ সালে ভারী শিল্পের রাজধানী ডেট্রয়েটের শীর্ষ তিন কোম্পানির বাজার মূলধন ছিল ৩ হাজার ৬০০ কোটি ডলার, রাজস্ব ছিল ২৫ হাজার কোটি ডলার এবং কর্মীর সংখ্যা ছিল ১২ লাখ। ২০১৪ সালে সিলিকন ভ্যালির শীর্ষ তিন কোম্পানির বাজার মূলধন ছিল ১ লাখ ৯ হাজার কোটি ডলার।
রাজস্ব প্রায় ২৪ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। কিন্তু কর্মীর সংখ্যা ১০ ভাগের ১ ভাগ, মাত্র ১ লাখ ৩৭ হাজার! ২০১৮ সালের প্রথম তিন মাস শেষে সিলিকন ভ্যালির তিন শীর্ষ কোম্পানির বাজার মূলধন দ্বিগুণ হয়ে ২ লাখ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে, কিন্তু তাদের কর্মীর সংখ্যা কিন্তু দ্বিগুণ হয়নি। মাত্র কয়েক বছর আগে ৫৫ জন কর্মীর তৈরি করা হোয়াটসঅ্যাপ নামের একটি যোগাযোগ সফটওয়্যার ফেসবুক কিনে নিয়েছিল ১ হাজার ৯০০ কোটি ডলারে!
২১ বছর বয়সী নিশা স্কট ২০১৬ সালে অ্যামাজনে চাকরি নেন। তাঁর কাজ ছিল ছোট ছোট বাক্সে জিনিসপত্র ভরে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া। এখন তিনি বসে বসে তিনটি রোবটের দেখাশোনা করেন, যারা তাঁর কাজগুলো করে দেয়! কয়েকদিন পরে হয়তো সেই কাজটাও একটা রোবট করবে। এভাবে রোবটরা ক্রমাগত আমাদের তরুণদের কর্মবাজারে ঢুকে পড়ছে। বিশ্বের ৪৬টি দেশের ৮০০ পেশা বিশ্লেষণ করে গ্লোবাল বিশ্লেষক ম্যাককিনসে জানাচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ৮০ কোটি কাজ চলে যাবে রোবটের হাতে। মেশিন অপারেটর, ক্লিনার, গাড়িচালক, ক্যাশিয়ার এবং ম্যাকডোনাল্ডসের মতো খাবার দোকানের কর্মীরা সবচেয়ে বেশি চাকরি হারাবেন।
এ লড়াইয়ে কারা টিকে থাকবে?
ম্যাককিনসের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব কাজ ‘মানবিক’ সেগুলো টিকে যাবে। যেমন স্বাস্থ্যকর্মী, উকিল, শিক্ষক, এমনকি বারটেন্ডারসহ বাগানের মালি, কেয়ারটেকার। তা ছাড়া সম্পূর্ণ নতুন অনেক ক্ষেত্র তৈরি হবে, যাতে প্রয়োজন হবে ‘মানবিক মিথস্ক্রিয়ার’। এসবের জন্য তিনটি প্রধান অস্ত্র হবে—তুরীয় চিন্তার (ক্রিটিক্যাল থিংকিং) অধিকারী হওয়া, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং সৃজনশীলতা।
যেমন ধরা যাক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। মানবসভ্যতার ইতিহাসে ফেসবুকই একমাত্র প্রোডাক্ট, যা প্রতি তিনজনে একজন ব্যবহার করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কেন্দ্র করে নতুন একটি কর্মক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। সেখানে বিপণন, যোগাযোগ ইত্যাদি কাজে এক বিরাট কর্মগোষ্ঠী তৎপর থাকবে। বাড়বে অফিস সময়ে ফেসবুক খুলে বসে থাকার লোক (এটাই তাঁদের কাজ!)। ফলে কম্পিউটার প্রোগ্রামারদের কাজও বাড়বে। দুই বছর পর থেকে আমেরিকা ও ইউরোপে প্রতিবছর ২০ লাখ প্রোগ্রামারের পদ খালি থাকবে, ৬০ লাখ কম্পিউটার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞের দরকার হবে।
নানা দক্ষতা গড়ার লড়াইয়ে নিজেকে সঁপে দিলেই তুমি পেয়ে যাবে আগামী দিনে তোমার সেরা সম্পদ—তুরীয় চিন্তা (ক্রিটিক্যাল থিংকিং), সমস্যা সমাধান (প্রবলেম সলভিং) এবং সৃজনশীলতা (ক্রিয়েটিভিটি)।