তথ্যপ্রযুক্তি

ডোমেইন কিনে রেখে ‘ব্যবসা’

সরকারি প্রতিষ্ঠান বিটিসিএলের কাছ থেকে নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান, টিকটক, আমাজন, আলী এক্সপ্রেসসহ সুপরিচিত প্রতিষ্ঠানের নামে ডোমেইন কেনা হয়েছে।

বৈশ্বিকভাবে সুপরিচিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটের নামে বাংলাদেশে ডোমেইন কিনে রেখেছে কিছু লোক। ডোমেইনগুলো কেনা হয়েছে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) কাছ থেকে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এভাবে সুপরিচিত প্রতিষ্ঠানের নামে ডোমেইন কিনে রাখা একটি ব্যবসা। কোনো প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে ডোমেইন কিনতে গেলে দেখবে, তাদের নামে আগেই কেনা হয়ে গেছে। তখন কিনে রাখা ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে চড়া দাম চাইতে পারবেন।

ডোমেইন নাম বিক্রির বিজ্ঞাপন দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের নামে ফেসবুকডটকমডটবিডি দিয়ে একটি ডোমেইন কিনে রাখেন এস কে শামসুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। তিনি ওয়েবসাইটে ডোমেইনটি ৬০ লাখ ডলারে বিক্রির বিজ্ঞাপন দেন, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫১ কোটি টাকা। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে মামলা করার পর ঢাকার আদালত সম্প্রতি ডোমেইনটি ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন।

বিটিসিএলের ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস, ফক্স নিউজ, যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান, চীনের ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপ টিকটক, ই-কমার্স সাইট আলী এক্সপ্রেসসহ আরও অনেক সুপরিচিত প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটের নামের শেষে ডটবিডি যোগ করে ডোমেইন নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। সুপরিচিত কফিহাউস চেইন স্টোর স্টারবাকস, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আমাজনও বাদ যায়নি।

এ ধরনের ডোমেইন কিনে রাখা হয় ব্যবসার উদ্দেশ্যে। ওই জনপ্রিয় সাইটগুলো যদি কখনো বাংলাদেশে আসে, তখন তাদের কাছে এই ডোমেইনগুলো বিক্রির একটা উদ্দেশ্য থাকতে পারে। বিটিসিএলের এসব বিষয়ে নীতিমালা করা উচিত। চাইলেই যেন কাউকে নিবন্ধন না দেওয়া হয়
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির

বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিকুল মতিন এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফেসবুকেরটা অনেক আগে নিবন্ধন করা হয়েছিল। তখন দেশে ফেসবুক ওভাবে জনপ্রিয় ছিল না। ফেসবুকও আমাদের এখনো কিছু জানায়নি। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী বিষয়টির সমাধান করব।’ তিনি জানান, এখন জনপ্রিয় সাইটের নামে ডোমেইন চাইলে কাউকে নিবন্ধন দেওয়া হয় না।

অন্যান্য জনপ্রিয় সাইটের ডোমেইন থাকা প্রসঙ্গে রফিকুল মতিন বলেন, এগুলো তিনি খতিয়ে দেখবেন। এ ধরনের ইস্যু সামনে এলে আইনগত ব্যবস্থা কী হবে, সে বিষয়ে তাঁরা একটি নীতিমালা তৈরির কাজ করছেন বলে জানান।

ডোমেইন নাম বলতে সাধারণভাবে কোনো একটি ওয়েবসাইটের নামকে বোঝায়। এই নামের শেষাংশে ডটকম, ডটওআরজি ইত্যাদি সংকেত থাকে। ডটকম মানে হলো প্রতিষ্ঠানটি কমার্শিয়াল বা বাণিজ্যিক। আর ডটওআরজি মানে হলো, এটি একটি অর্গানাইজেশন বা সংস্থা। বৈশ্বিকভাবে ডোমেইন কেনার জন্য বিভিন্ন ওয়েবসাইট রয়েছে। সেখানে নতুন কোনো প্রতিষ্ঠান নিজেদের নামে ডোমেইন কেনার আগে অনেক অসাধু ব্যক্তি কিনে রাখেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পরে তা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কাছে বেশি দামে বিক্রি করেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা বেশ কয়েকটি ঘটেছে। তবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো এ নিয়ে কথা বলতে রাজি নয়।

অন্যদিকে নামের শেষে বিডি যুক্ত হলে বুঝতে হয় যে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশি। বিটিসিএল দেশে ডটকমডটবিডি, ডটইনফোডটবিডি, ডটওআরজিডটবিডি ইত্যাদি শ্রেণির অধীনে ডোমেইন নিবন্ধন দেয়। এ ক্ষেত্রেও সুপরিচিত প্রতিষ্ঠানের নামে ডোমেইন কিনে রাখার ঘটনা সামনে এল।

বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিকুল মতিন বলেন, ফেসবুকেরটা অনেক আগে নিবন্ধন করা হয়েছিল। তখন দেশে ফেসবুক ওভাবে জনপ্রিয় ছিল না। ফেসবুকও আমাদের এখনো কিছু জানায়নি। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী বিষয়টির সমাধান করব। এখন জনপ্রিয় সাইটের নামে ডোমেইন চাইলে কাউকে নিবন্ধন দেওয়া হয় না

কী বলছে তারা

যুক্তরাষ্ট্রের স্বনামধন্য গণমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস-এর ওয়েবসাইট হলো nytimes.com। বাংলাদেশে ৭ ডিসেম্বর nytimes.com.bd নাম দিয়ে একটি ডোমেইন নিবন্ধন নেন নাইম নামের এক ব্যক্তি। বিটিসিএলের ওয়েবসাইটে শুধু নাইমের নাম এবং একটি ই-মেইল ঠিকানা দেওয়া রয়েছে। আর কোনো তথ্য নেই। নিউইয়র্ক টাইমস–এর নামে নিবন্ধন নেওয়া ব্যক্তি নাইমের দেওয়া ই-মেইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তাঁর সঙ্গে নিউইয়র্ক টাইমস–এর কোনো সম্পর্ক নেই। গুগলের ‘অ্যাডসেন্সে’ কাজ করার জন্য তিনি ডোমেইনটি নিয়েছেন। তবে একজন তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বলেন, নাইম যে প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করেন, সেই প্রতিষ্ঠানের নামে ডোমেইন নেবেন। নিউইয়র্ক টাইমস–এর নামে কেন?

বাংলাদেশে ডোমেইন কিনে রাখার বিষয়ে মন্তব্য জানতে নিউইয়র্ক টাইমস ও যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ানকে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আট দিন আগে ই-মেইল করা হয়। গতকাল বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত জবাব পাওয়া যায়নি।

আমাজনডটকমডটবিডি নামে একটি ডোমেইন নিবন্ধন করে রেখেছে বাংলাদেশি সুপরিচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান চালডাল লিমিটেড। ২০১৪ সালে তারা এ নিবন্ধন নেয়। এ বিষয়ে ১৫ ডিসেম্বর চালডাল কর্তৃপক্ষ ই-মেইলের জবাবে প্রথম আলোকে জানায়, অর্থনৈতিক কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে তারা এটা করেনি। তারা কপিরাইট ও ট্রেডমার্ক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমাজন যদি কখনো তাদের কাছে এসে দাবি করে, তাহলে তারা বিনা মূল্যেই ডোমেইনটি হস্তান্তর করবে।

‘নীতিমালা করা উচিত’

বিটিসিএলের ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, ডোমেইন কিনতে ব্যক্তির ক্ষেত্রে শুধু জাতীয় পরিচয়পত্র থাকলেই হয়। আর প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে শুধু কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) অথবা ট্রেড লাইসেন্স দরকার হয়। নিবন্ধন নিতে দুই বছরের জন্য ১ হাজার ৬০০ টাকা ও তিন বছরের জন্য ২ হাজার ৪০০ টাকা ফি দিতে হয়। এরপর নিয়মিত বিরতিতে নবায়ন করতে হয়।

সুপরিচিত প্রতিষ্ঠানের নামে ডোমেইন কেনা ঠেকানোর ক্ষেত্রে সুরক্ষা কী আছে, জানতে যোগাযোগ করা হয়েছিল বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস এবং পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের সঙ্গে। কপিরাইট অফিসের নিবন্ধন কর্মকর্তা জাফর রাজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কপিরাইট চাইতে হলে প্রত্যেককে একটি অঙ্গীকারনামা দিতে হয় যে এটা মৌলিক, হুবহু অনুকরণ করে করা নয়। কিন্তু যখন এ রকম জনপ্রিয় কোনো সাইট বা নামের জন্য আসে, তখন আমরা কপিরাইট নিবন্ধন দিই না।’

অন্যদিকে পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের সহকারী রেজিস্ট্রার (ট্রেডমার্কস) মো. শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আগে থেকেই তাদের কাছ থেকে নিবন্ধন নিয়েছে। সুপরিচিত প্রতিষ্ঠানের নামে কেউ নিবন্ধন চাইতে এলে তা দেওয়া হয় না।

কাছাকাছি নামের ডোমেইনের নিবন্ধন দিলে প্রতারণারও সুযোগ থাকে। গত অক্টোবর মাসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আদলে ভুয়া ওয়েবসাইট খুলে জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগে দুজনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।

সার্বিক বিষয়ে তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ডোমেইন কিনে রাখা হয় ব্যবসার উদ্দেশ্যে। ওই জনপ্রিয় সাইটগুলো যদি কখনো বাংলাদেশে আসে, তখন তাদের কাছে এই ডোমেইনগুলো বিক্রির একটা উদ্দেশ্য থাকতে পারে। তিনি বলেন, বিটিসিএলের এসব বিষয়ে নীতিমালা করা উচিত। চাইলেই যেন কাউকে নিবন্ধন না দেওয়া হয়।