উইলিয়াম বি পাউচার
উইলিয়াম বি পাউচার

ডিজিটাল সহস্রাব্দে মানুষই পৃথিবীর মূল সম্পদ: উইলিয়াম বি পাউচার

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ কম্পিউটার প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা ‘ইন্টারন্যাশনাল কলেজিয়েট প্রোগ্রামিং কনটেস্ট (আইসিপিসি)’। বছরব্যাপী পৃথিবীজুড়ে আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার পর অনুষ্ঠিত হয় চূড়ান্ত পর্ব (ওয়ার্ল্ড ফাইনাল)। এই প্রথমবারের মতো আইসিপিসির ৪৫তম ওয়ার্ল্ড ফাইনাল হতে যাচ্ছে ঢাকায়। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের সহযোগিতায় ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া-প্যাসিফিক (ইউএপি) এবার আইসিপিসির আয়োজক। আইসিপিসি চূড়ান্ত পর্বের ঘোষণা উপলক্ষে কয়েক দিন আগে ঢাকায় এসেছিলেন আইসিপিসি ফাউন্ডেশনের সভাপতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের বেলর ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার বিজ্ঞানের অধ্যাপক উইলিয়াম বি পাউচার। ৯ মার্চ সন্ধ্যায় ওয়েস্টিন ঢাকায় তিনি কথা বলেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পল্লব মোহাইমেন।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: আমাদের দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া-প্যাসিফিকের উপাচার্য প্রয়াত অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর স্বপ্ন ছিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজিয়েট প্রোগ্রামিং কনটেস্টের (আইসিপিসি) চূড়ান্ত পর্ব বাংলাদেশে আয়োজন করার। এ বছর তাঁর সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে...।

উইলিয়াম বি পাউচার: এবার ঢাকায় এসে তাঁর কথা খুবই মনে পড়ছে। আইসিপিসির জন্য তাঁর অবদান সব সময়ই স্মরণ করি।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: আইসিপিসির চূড়ান্ত পর্ব আয়োজনের জন্য কেন বাংলাদেশ বেছে নিলেন?

উইলিয়াম বি পাউচার: প্রথমত, পৃথিবীজুড়ে আমরা যে এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করি, তার পূর্ব-পশ্চিম অঞ্চলে চ্যাম্পিয়ন হলো বাংলাদেশ। পূর্ব-পশ্চিম অঞ্চলে কিন্তু ভারত, পাকিস্তান, ইরান, ইরাকের মতো দেশও রয়েছে। প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় এ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সেরা।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে অনেক মেধা রয়েছে। ১৯৯৭-৯৮ সাল থেকে বাংলাদেশ আইসিপিসিতে অংশগ্রহণ করছে। এখন তাদের সময় এসেছে ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য চ্যাম্পিয়নস’ (সেরাদের সেরা) হওয়ার। আইসিপিসির চূড়ান্ত পর্ব নিজেদের দেশে হলে পরবর্তী ধাপে উত্তরণের ক্ষেত্রে তারা অনুপ্রাণিত হবে। অভিজ্ঞতাও বাড়বে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: কম্পিউটার প্রোগ্রামিং বা তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তরুণদের অবস্থান কেমন বলে মনে করেন?

উইলিয়াম বি পাউচার: আগে প্রাকৃতিক সম্পদ ছিল দেশগুলোর উন্নত হওয়ার মূল উপাদান। এখনো তা-ই। তবে এখন প্রাকৃতিক সম্পদ হলো মানুষ। ডিজিটাল সহস্রাব্দে (মিলেনিয়াম) মানুষই পৃথিবীর মূল সম্পদ। বাংলাদেশের আছে বিপুল পরিমাণ তরুণ, যাঁদের অনেকেই প্রোগ্রামিংয়ের মতো অ্যালগরিদমনির্ভর কাজে দক্ষ। সফটওয়্যার বা অবকাঠামো নির্মাণে তাঁদের কার্যক্ষমতা অতি উচ্চ। পরবর্তী ৫০ বছরে তাঁরাই নেতৃত্বে চলে আসবে। আমরা এই তরুণদের মধ্যে মেধা খুঁজে পাব। আপনি যখন শুরু করবেন, তখন ভাবতে হবে, কী দিয়ে কী পাবেন। আর জানতে হবে, আপনি কী পেতে চান। তাই এই তরুণদের সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে।

উইলিয়াম বি পাউচার
প্রশ্ন

প্রথম আলো: আইসিপিসির চূড়ান্ত পর্বে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ফলাফলে সপ্তম। সেটিও ২০-২১ বছর আগের অর্জন। এরপর এর চেয়ে আর এগোতে পারিনি আমরা। এর কী কারণ?

উইলিয়াম বি পাউচার: প্রতিবছর কমবেশি ১১১ দেশ, ৩৫০ বিশ্ববিদ্যালয়, ৬০ হাজার শিক্ষার্থী অংশ নেয় আইসিপিসিতে। এ রকম পর্যায়ে হয় প্রতিযোগিতাটি। ওয়ার্ল্ড ফাইনাল খুবই কঠিন ৩০ বছর আগে থেকেই। দিন দিন প্রতিযোগিতা বেড়েছে। ফলে মেডেল পাওয়া কঠিন।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: আগের ৪৪টি আইসিপিসির চূড়ান্ত পর্ব দেখে বোঝা যায়, শীর্ষ তিনটি স্থানে চীন, তাইওয়ান ও রাশিয়ার প্রোগ্রামাররা বেশি থাকেন।

উইলিয়াম বি পাউচার: তারা ‘গিফটেড স্টুডেন্টস’ (বিশেষ প্রতিভাবান শিক্ষার্থী)। আর চূড়ান্ত পর্বে ভালো করার মূলে আছে কোচিং, প্র্যাকটিস (অনুশীলন) ও রিহার্সাল (প্রতিযোগিতার মতো করে মহড়া)। এগুলোর আংশিক এখানে (বাংলাদেশ) হচ্ছে। এখানে প্রচুর মেধা আছে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: পেশাগত জীবনে প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা সহযোগিতা করে?

উইলিয়াম বি পাউচার: অ্যালগরিদমের দক্ষতা সব ধরনের প্রকৌশল পেশায় সহযোগিতা করে। নিজের পেশায় পারফর্ম করা থেকে শুরু করে উৎপাদনপ্রক্রিয়া ও লজিস্টিক সাপোর্ট দেওয়ার কাজেও এটি সহায়ক।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: আইসিপিসিতে প্রতিযোগীদের কয়েকটি প্রোগ্রামিং সমস্যা দেওয়া হয়। প্রতিযোগীরা যুক্তি, অ্যালগরিদম দিয়ে সেসবের সমাধান করেন। সমাধানের প্রক্রিয়ায় সৃজনশীলতার প্রয়োগ ঘটানোর সুযোগ বা প্রয়োজন আছে কি না।

উইলিয়াম বি পাউচার: সৃজনশীল না হলে কোনো প্রতিযোগীই পারফর্ম করতে পারবেন না। সৃজনশীলতা দিয়েই চিন্তা, যুক্তি ও অ্যালগরিদমের প্রয়োগ ঘটাতে হয়। শেষ কথা হলো চর্চা। সংগীত, ক্রীড়া, সফটওয়্যার—সব ক্ষেত্রে চর্চাই হলো উৎকর্ষের সোপান।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: ঢাকায় এবারের আইসিপিসির চূড়ান্ত পর্বে কতজন প্রতিযোগী অংশ নেবেন?

উইলিয়াম বি পাউচার: এখন পর্যন্ত ৭৫টি দেশের ১৪০টি দল অংশ নেবে। দলের সংখ্যা একটু কমবেশি হতে পারে। প্রতিটি দলে ৩ জন প্রোগ্রামার ও ১ জন কোচ থাকেন। ২০২০ সালে কোভিডের জন্য প্রতিযোগিতা হয়নি, রিজওনালসও (আঞ্চলিক পর্ব) হয়নি। গত বছর হয়েছে ভার্চ্যুয়ালি। দুই বছর পর ঢাকা থেকেই আবার সরাসরি আইসিপিসি ওয়ার্ল্ড ফাইনাল শুরু হচ্ছে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: বাংলাদেশ থেকে শাহরিয়ার মঞ্জুর দীর্ঘদিন আইসিপিসির চূড়ান্ত পর্বের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন...

উইলিয়াম বি পাউচার: আমার মতে, আপনাদের শাহরিয়ার মঞ্জুর আইসিপিসির একজন ‘ফার্স্ট ক্লাস জাজ (প্রথম শ্রেণির বিচারক)’।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: আইসিপিসি ফাউন্ডেশনের কাজ সম্পর্কে কিছু বলুন।

উইলিয়াম বি পাউচার: আইসিপিসি ফাউন্ডেশন বিশ্বব্যাপী আইসিপিসি আয়োজন করে। অন্য ধরনের প্রতিযোগিতার আয়োজনও করা হয়। যেমন ভারতে শুধু মেয়েদের জন্য আমরা অ্যালগো কুইন প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং চর্চার জন্য আমরা অবকাঠামোগত সুবিধা দিয়ে থাকি। আমরা সরাসরি পিছিয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটারবিজ্ঞান শিক্ষায় সহায়তা করে থাকি। সমস্যার সমাধান করে দিই, যাতে ভবিষ্যতে তাঁদের ও আমাদের জন্য সুবিধা হয়।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: আইসিপিসি ফাউন্ডেশন কী ধরনের সংগঠন?

উইলিয়াম বি পাউচার: এটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে স্পনসর নেওয়া হয়। এই যেমন ঢাকার ওয়ার্ল্ড ফাইনালের জন্যও আঞ্চলিক স্পনসর রয়েছে। পৃষ্ঠপোষকদের সহায়তায় আমাদের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। স্পনসরদের আমরা সম্মান করি।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: ঢাকায় আইসিপিসি চূড়ান্ত পর্ব আয়োজনের প্রস্তুতি কেমন বলে মনে হচ্ছে?

উইলিয়াম বি পাউচার: ইউএপি আইসিপিসি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এরই মধ্যে নিজেদের প্রমাণ করেছে। প্রস্তুতিও খুব ভালো, আমি খুব খুশি। আশা করছি, আগামী নভেম্বরে ঢাকায় আইসিপিসি ওয়ার্ল্ড ফাইনাল সফলভাবে সম্পন্ন হবে।

প্রথম আলো: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
উইলিয়াম বি পাউচার: আপনাকেও।


১৯৪৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালাবামায় জন্ম উইলিয়াম বি পাউচারের। বাবা ছিলেন শিক্ষক। তিনি প্যারামিলিটারির সঙ্গে জড়িত থাকায় উইলিয়ামের প্রথম ১০ বছর কেটেছে ১৪টি জায়গায়। ১৯৭২ সালে উইলিয়াম বি পাউচার কম্পিউটারবিজ্ঞানে শিক্ষকতা শুরু করেন। চলতি বছর তাঁর শিক্ষকতা জীবনের সুবর্ণজয়ন্তী। এর মধ্যে ৪৭ বছর ধরে তিনি অধ্যাপক। টেক্সাসের বেলর ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করছেন ৩৯ বছর ধরে। কম্পিউটারবিজ্ঞানের তত্ত্ব, স্থাপত্যশৈলী ও সফটওয়্যার ডিজাইনে তিনি পারদর্শী। অ্যালাবামার অবার্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটারবিজ্ঞানে ১৯৭১ সালে স্নাতক, ১৯৭২ সালে স্নাতকোত্তর এবং ১৯৭৫ সালে তিনি পিএইচডি অর্জন করেন। ১৯৮৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আইসিপিসির নির্বাহী পরিচালক (বিভিন্ন পদবিতে) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত এ প্রতিযোগিতার সহকোচ ও আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন। বর্তমানে আইসিপিসি ফাউন্ডেশনের সভাপতি উইলিয়াম বি পাউচারের স্ত্রী মার্শা ২০ বছর আইসিপিসির পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন, এখন অবসরে আছেন।