আমাজনের নাম শুনলেই বিশাল এক ই-কমার্স সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের নাম চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কিন্তু আমাজন এখন আর শুধু ই-কমার্সেই সীমাবদ্ধ নেই। ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই অনেক নাটকীয় রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গেছে আজকের প্রযুক্তিবিশ্বের জায়ান্ট হয়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানটি। খুচরা বই বিক্রি থেকে শুরু করে ই-বুক, ব্যক্তিগত পণ্য বিক্রি, এমনকি ক্লাউড সেবার মতো নানা সেবার পাশাপাশি অনলাইন ভিডিওর দুনিয়ায় আমাজনের রাজত্ব এখন। তবে আমাজন এখানেই থেমে নেই। ছুটে চলেছে আকর্ষণীয় ‘ডিজিটাল বিজ্ঞাপন’ ব্যবসা জগতে শক্ত অবস্থান তৈরিতে। ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে আমাজনের নতুন ক্ষেত্রের ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা।
ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের জগৎটাকে আকর্ষণীয় বলার পেছনে অনেক কারণই আছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের হিসাব করলেই চোখ কপালে উঠবে। এখানে ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের বাজার ১১ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের। এ বাজার ধরতে হলে আমাজনকে অবশ্য অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। আমাজনের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে রয়েছে গুগল আর ফেসবুক। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ৩৭ শতাংশই দখল করে রেখেছে গুগল আর ২১ শতাংশ দখলে রেখেছে ফেসবুক। সেখানে আমাজনের দখলে মাত্র ৪ শতাংশ। তবে আমাজনের জন্য ভালো খবর হচ্ছে, তারা পরে শুরু করলেও দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে। ২০১২ সালে শুরু করে আমাজন ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের বাজারে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।
বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ই–মার্কেটার বলছে, এ বছরের শেষ নাগাদ মাইক্রোসফট ও ভেরিজনকে পেছনে ফেলে ডিজিটাল বিজ্ঞাপন বাজারের তৃতীয় স্থানে চলে আসবে আমাজন।
ইকোনমিস্ট বলছে, আমাজনের আরেকটি বড় সুবিধা হচ্ছে, তাদের হাতে থাকা বিশাল তথ্যভান্ডার। গুগল আর ফেসবুকের অনেক পেছনে থাকলেও আমাজনের বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠানটির ওপর দারুণ প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। ২০১৮ সালে আমাজনের বিজ্ঞাপন বিক্রি থেকে আয় ৮০০ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এখানে তাদের পরিচালন ব্যয়ও অনেক কম। অর্থাৎ এ খাতে তাদের পরিচালন মুনাফা ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি।
ব্রোকারেজ হাউস পাইপার জাফরির মাইকেল ওলসন বলেছেন, ২০২১ সাল নাগাদ আমাজনের বিজ্ঞাপন থেকে আয়ের পরিমাণ তাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যবসা ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের চেয়ে বেশি হবে। আমাজন এখন তাদের মূল ই-কমার্স ব্যবসায় লোকসান দিচ্ছে। কিন্তু বিজ্ঞাপন থেকে আসা মোটা আয় তা পুষিয়ে দিতে পারবে।
বিনিয়োগ ব্যাংক মর্গ্যান স্ট্যানলির বিশ্লেষক ব্রায়ান নোয়াক বলেন, ডিজিটাল বিজ্ঞাপন ও ক্লাউড সেবা থেকে আসা ব্যাপক মুনাফা আমাজন নতুন দেশে ব্যবসা প্রসারে ব্যবহার করবে আমাজন।
তবে আমাজনের জন্য গুগল ও ফেসবুকের সঙ্গে এখনই টক্কর দেওয়া কঠিন হলেও অসম্ভব কিছু নয়। ফেসবুক ও গুগলের কাছে যেমন তথ্যভান্ডার আছে, তেমনি আমাজনের কাছে থাকা তথ্য বিজ্ঞাপন প্রচারে কাজে লাগানো হতে পারে। ক্রেতাদের পণ্য কেনার পুরোনো ইতিহাস, ক্রেতাদের পর্যালোচনা দেখার ইতিহাসসহ তাদের ইন্টারনেট ব্রাউজিং–বিষয়ক তথ্য আমাজনের কাছে আছে। আমাজনের কাছে বাড়তি সুবিধা হচ্ছে ক্রেতার পণ্য কেনার অভ্যাস বিশ্লেষণ করা। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের ৫৬ শতাংশই বর্তমানে কোনো পণ্য কেনার আগে আমাজনে সার্চ দেন।
আমাজনের জন্য ব্র্যান্ড হিসেবে খুচরা বিক্রেতাদের টেনে আনা কঠিন হবে না। খুচরা বিক্রেতাদের বিভিন্ন পণ্য প্রস্তুতকারকেরা নানা রকম অফার দিয়ে টেনে আনতে চাইবেন। যুক্তরাষ্ট্রে এ বাজার ২০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের। এ ধরনের পণ্য প্রস্তুতকারকদের কাছে আমাজন আকর্ষণীয়।
তবে আশার পিঠে কিছুটা আশঙ্কাও রয়েছে। আমাজনের বিজ্ঞাপন কিন্তু সব ব্যবসাকে টানবে না। যেসব প্রতিষ্ঠান তাদের সাইটের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করে না, তারা বিজ্ঞাপন দিতে আমাজনে হয়তো যাবে না। বিশেষ করে ফ্যাশন ব্র্যান্ড, গাড়ি নির্মাতা বা ট্রাভেল কোম্পানিগুলো আমাজনে যেতে অনীহা দেখাতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অনলাইন ভিডিও হতে পারে তাদের টেনে আনার মোক্ষম অস্ত্র। আমাজন তাদের অনলাইন গেমিং সাইট ‘টুইচে’ ভিডিও বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে। আমাজন চাইলে বিজ্ঞাপনদাতাদের আকর্ষণ করতে তাদের প্রাইম সেবাতেও বিজ্ঞাপন যুক্ত করতে পারে।
আমাজন চাইলে তাদের কণ্ঠস্বর সহকারী বা ভার্চ্যুয়াল সফটওয়্যার অ্যালেক্সাকেও বিজ্ঞাপনের আওতায় আনতে পারে। আমাজনের স্মার্ট স্পিকার ইকোতেও সে সম্ভাবনা আছে। ভবিষ্যতে মানুষ যখন অ্যালেক্সার সঙ্গে কথা বলবে বা কণ্ঠের মাধ্যমে কোনো নির্দেশ দেবে, তখন তাতে বিজ্ঞাপন শোনানো হতে পারে। এ বছরের শুরুতে এ ধরনের বিজ্ঞাপনের জন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করেছিল আমাজন কর্তৃপক্ষ।
ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের এ দৌড়ে আমাজনের জন্য মোট তিনটি বাধা রয়েছে। প্রথম বাধা হচ্ছে আমাজনের বিজ্ঞাপনে গ্রাহককে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে কি না, তা বিবেচনা করে। কথা বলার সময় বিজ্ঞাপন শোনানো হলে তা বিরক্তি তৈরি করবে। যারা টাকা দিয়ে ভিডিও দেখবে, তারা বিজ্ঞাপন দেখতে চাইবে না। যে গ্রাহকদের এত দিন সন্তুষ্ট করেছে, তাদের চটাতে চাইবে না আমাজন।
দ্বিতীয় বিবেচনার বিষয় হবে আমাজনের ভেন্ডর বা ব্যবসায়ীর সঙ্গে স্বার্থের সংঘাত। বিজ্ঞাপনদাতারা প্রোডাক্ট সার্চের ওপরে বিজ্ঞাপন দেখানোর জায়গা কিনে নিতে পারে। এতে বিক্রেতার সঙ্গে আমাজনের সম্পর্ক খারাপ হবে। আমাজন নিজেই যেহেতু উৎপাদনকারী ও বিক্রেতা, তাই তাদের নিজেদের পণ্যের সঙ্গে পার্থক্য তৈরি হবে। তাই আমাজনকে বিজ্ঞাপনদাতাদের পণ্য বা নিজেদের পণ্যের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টি নির্ধারণ করতে হবে।
বিনিয়োগকারী ব্যাংক আরবিসি ক্যাপিটালের গবেষণা অনুযায়ী, আমাজন অ্যাপে ১০০ পণ্যে সার্চ করলে মাত্র তিনবার শীর্ষ অনুসন্ধান ফল হিসেবে স্পনসরড বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করে না। ওই তিনটি পণ্য হচ্ছে আমাজনের তৈরি দুই ধরনের স্মার্ট স্পিকার ও কিন্ডল ই-রিডার। প্রতিদ্বন্দ্বীর পণ্য নির্মাতা আমাজনের পক্ষপাতিত্বে রেগে যেতে পারে।
তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে আমাজনে সক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার একটি পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। গত সেপ্টেম্বর মাসে ইউরোপিয়ান কমিশন আমাজনের তথ্য ব্যবহারের ওপর অনুসন্ধানের ঘোষণা দিয়েছে। তদন্ত সামনে এগোলে আমাজনে বিজ্ঞাপন চর্চার বিষয়টি আরও আগ্রহের জন্ম দেবে।
আমাজন এখন পর্যন্ত প্রাইভেসি–বিষয়ক সমস্যা নিয়ে গ্রাহকের রোষে পড়েনি। অমনিকম নামের ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের এজেন্সির জোনাথন নেলসন বলেন, ফেসবুক ব্যক্তিগত জীবন ও ফ্রেন্ডগ্রাফ ব্যবহার করে বিজ্ঞাপনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে। আমাজন সেটা বাণিজ্যিক সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে পরিচালনা করে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান এন্ডার্স অ্যানালাইসিসের গবেষক ম্যাটি লিটুনেন বলেন, আমাজনের বিজ্ঞাপনের ব্যবসা বাড়লে এর ওপর নিয়ন্ত্রণও বাড়বে। আমাজন ব্যবহারকারীদের হাতে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ রাখে। এতে ব্যবহারকারী কতটুকু তথ্য বিজ্ঞাপনের জন্য শেয়ার করবেন, তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
আমাজন যতই ব্যবহারকারীর তথ্য তাদের হাতে নিয়ে পারবে এবং তাদের কেনাকাটার অভ্যাস সম্পর্কে জানতে পারবে, ততই তাদের তথ্যভান্ডার সমৃদ্ধ হবে। এতে আমাজনের প্রবৃদ্ধির চাকা আরও দ্রুত ঘুরবে।